Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা জয়নাল আবেদীন হাজারীর চির প্রস্থান

কারো কাছে ছিলেন আতংকের, অনুসারীদের ছিলেন মুকুটহীন সম্রাট

ফেনী জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ৩:৫২ পিএম

জীবনভর কখনো ঘৃণা,কখনো আক্রোশ-বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন,কখনো দেশের জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছেন,কখনো কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে লড়াই করেছেন। আবার কখনো নন্দিত হয়েছেন, কখনো নিন্দিত। ২০০১ সালের পর থেকে আমৃত্যু নিজের সাজানো গোছানো মুজিব উদ্যান ছেড়ে দূরে থাকতে হয়েছে তাকে। কিন্তু ৭৬ বছর বয়সী জয়নাল আবেদীন হাজারীর জীবনে যত ঝড়-তুফান,বাধা বিপত্তিই আসুক,কখনোই তিনি মুখ থুবড়ে পড়েননি,নত স্বীকার করেন নি। সবকিছু সামলে ফের উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করেছেন। কখনো হার স্বীকার করেননি নিজস্ব নীতি এবং আদর্শের কাছে। দীর্ঘ ২১ বছর পর ফেনীতে ফিরে আসছেন তিনি,তবে জীবিত নয় নিথর দেহে। আওয়ামীলীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ফেনীর সাবেক ৩ বারের সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন হাজারী গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানীর ল্যাব এইড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। মৃত্যুকালে তিনি চিরকুমার ছিলেন। তার মৃত্যুতে সমগ্র ফেনী জেলায় শোকের ছায়া নেমে আসে। বর্ণাট্য রাজনীতির অধিকারী জয়নাল হাজারী ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি শুরু করেছেন। ছাত্রাবস্থায় ফেনী কলেজের তৎকালীন ছাত্র মজলিশ (বর্তমান ছাত্র সংসদ)এর জিএস ছিলেন। এরপর বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদেও দায়িত্ব পালন করেন। ফেনী শহরের মাষ্টারপাড়ার অধিবাসী জয়নাল হাজারী ১৯৮০ সালে প্রথম জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৮৮ এবং ১৯৯৯ সালে আরও দুইবার জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন তিনি। পরে ২০০৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৪ বছর এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৬,১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনী-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭৫ পরবর্তী দলের কঠিন দু:সময়ে রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত করা,বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধের ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে যারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ফেনীর জয়নাল হাজারী ছিলেন অন্যতম। তিনি ফেনীর রাজনীতিতে আওয়ামীলীগকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আলোচিত জয়নাল হাজারী ছিলেন একজন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ১৯৭১ সালে ২নং সেক্টরের অধিনে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের পরামর্শে রাজনগর এলাকায় সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার পর রাজনগরে গিয়ে ওই এলাকার বেকার যুবকদের নিয়ে তিনি একটি সিভিল ডিফেন্স টিমও গঠন করেছিলেন। জয়নাল হাজারী ১৯৪৫ সালের ২৪ আগষ্ট ফেনীর মাস্টার পাড়ার সহদেবপুর নানা হাবীবুল্লাহ পন্ডিতের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা গণি হাজারী ছিলেন পেশায় একজন ব্যবসায়ী,মা রিজিয়া বেগম ছিলেন একজন গৃহিনী। জয়নাল আবেদীন হাজারী আজীবন আওয়ামীলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একসময় ফেনীর গডফাদার নামেও পরিচিত ছিলেন তিনি। যাকে নিয়ে শেষ নেই তর্ক-বিতর্কের সেই জয়নাল হাজারী ১৯৯৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পর ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ফেনীতে তার সন্ত্রাসের শিকার হয়ে ১২০ জন রাজনৈতিক নেতা কর্মীর মৃত্যু হয়। এই প্রেক্ষাপটের পেছনে হাজারীকে সন্দেহ করা হয় এবং ২০০১ সালে তৎকালীন তত্ববধায়ক সরকারের আমলে ১৬ আগস্ট রাতে হাজারীর বাসভবনে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। এরপরই তিনি আত্মগোপনে চলে যান। পরে ২০০৫ সালের মে মাসে দল থেকে তাকে বহিস্কার করা হয়। চার বছর পর ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর তিনি ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম হত্যাকান্ডের পর নানান কারনে জয়নাল হাজারী আবার আলোচনায় আসেন। এছাড়া হাজারিকা প্রতিদিন নামে একটি আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা সম্পাদনার সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি। তিনি এই পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা,প্রকাশক এবং সম্পাদক ছিলেন। হাজারী বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নিজের দলের নেতাকর্মীদেরকে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ ছিলো। তার এই নির্যাতন ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে খবর পরিবেশনের কারনে নানা সময় সাংবাদিকরাও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তার ভয়ে অনেকে এলাকা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সর্বশেষ সংসদ সদস্য থাকাকালে তিনি ও তার বাহিনীর নির্যাতনের কথা সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি আওয়ামীলীগের বাইরে ‘স্টিয়ারিং’ কমিটি নামে একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে সন্ত্রাসের রাজত্ব গড়ে তোলেন। তবে ২০১৯ সালে ডয়সে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন স্টিয়ারিং কমিটি মানুষের জন্য কাজ করেছে। আমার প্রধান শত্রু জামাত-শিবির। তাদের সঙ্গে লড়াই করে আমাকে বাঁচতে হয়েছে। তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে। তিনি বলেছিলেন যারা আমাকে নিয়ে বিতর্কিত বলে তারাই বলতে পারবে কেন বলে। জয়নাল হাজারী দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকায় ফেনীর রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তার নাগালের বাইরে। এরপর আমৃত্যু ফেনীর বাইরেই কাটাতে হয়েছিল ফেনীর এককালের ত্রাস খ্যাত জয়নাল হাজারীকে। সর্বশেষ পরে দলে ফিরিয়ে ২০১৯ সালে জয়নাল হাজারীকে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করে আওয়ামীলীগ। তার অসুস্থতার জন্য চিকিৎসা ব্যয় হিসেবে একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ত্রাণ তহবিল থেকে জয়নাল হাজারীকে ৪০ লাখ টাকার অনুদান প্রদান করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ