নারী দিবস ম্যারাথনে পাপিয়া চ্যাম্পিয়ন
‘নিরাপদ সমাজ, নিরাপদ নারী’-স্লোগানে অনুষ্ঠিত নারী দিবস রেগুলার ম্যারাথনে রেগুলার বাংলাদেশের পাপিয়া খাতুন চ্যাম্পিয়ন, হামিদা
সালটা ১৯৭৩! দিনটি ২৬ জুলাই। ভেন্যু মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর। আন্তর্জাতিক ফুটবলে বাংলাদেশ নিজেদের প্রথম ম্যাচটি খেলতে নেমেছিল থাইল্যান্ডের বিপক্ষে। মারদেকা কাপের ম্যাচটি বাংলাদেশ সেদিন ২-২ গোলে ড্র করে থাইদের সঙ্গে। বিদেশের মাটিতে সে ম্যাচ দেখে মনে হয়েছিল খেলাধুলায় এগিয়ে যাওয়ার উপাদান সদ্য স্বাধীন দেশে যথেষ্টই আছে। কিন্তু এরপর অর্ধশতাব্দী কেটে যাওয়ার পরও প্রশ্ন ওঠে, সে লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছে? খেলার দুনিয়ায় নিজেদের স্বপ্নগুলো কি ছোঁয়া সম্ভব হয়েছে?
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে হতাশই হতে হয় ক্রীড়াপ্রেমীদের। গত ৫০ বছরে খেলাধুলায় বাংলাদেশের অর্জন কম না হলেও ক্রীড়াপ্রেমীদের তৃপ্ত হওয়ার মতো অনেক অর্জনই যে বাকি! চিরদিনের খেলাপ্রেমী বাঙালি খেলাধুলা নিয়ে স্বাধীনতার লগ্নে যেসব স্বপ্ন দেখেছিল, তার অনেক কিছুই পূরণ হয়নি। আশপাশের দেশের অর্জনগুলো দেখলে খেলার জগতে দৈন্য যেন আরও বেশি করেই প্রকাশ পায়। অথচ এই ৫০ বছরে দেশ হিসেবে অর্জন অজস্র। একসময় যে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে তাচ্ছিল্য করেছিলেন, সে দেশই এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। হতদরিদ্র সেই দেশই এখন বিশ্বের অন্যতম দ্রুত অগ্রসরমান অর্থনীতির ধারক। বিদেশি সাহায্যের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল দেশটিই এখন অন্য দেশকে ঋণ সাহায্য দেয়। নিজেদের বেশির ভাগ চাহিদা মেটায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকেই। পরিশ্রমী জনসম্পদ বিদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রার জোগান দিয়ে যাচ্ছে নিরন্তর। সেই বৈদেশিক মুদ্রা শক্তিশালী করছে দেশের অর্থনীতির ভিত। শিক্ষার হার বেড়েছে, বেড়েছে গড় আয়ু। একসময় মাতৃমৃত্যুহার যেখানে আশঙ্কাজনক ছিল, সেটি এখন নেমে এসেছে অনেক নিচে। এই বাংলাদেশ এখন অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ।
অর্জন আর প্রাপ্তির মধ্যেও খেলার দুনিয়ায় নিজেদের অবস্থান দেখে বাংলাদেশের মানুষের মন খারাপ হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অর্থনীতির উন্নতির সঙ্গে খেলাধুলায় নিজেদের অবস্থান তুলনা করলে মন খারাপ যেন হতাশায় রূপ নেয়। প্রশ্ন জাগে, সব জায়গায় এত অর্জনের মধ্যেও খেলাধুলায় কীভাবে পিছিয়ে থাকে এই দেশ? তাহলে কী আমরা গত ৫০ বছরে খেলাধুলাকে অবহেলা করেছি? নাকি খেলাধুলায় পিছিয়ে থাকাটা আমাদের জাতিগত খামতি!
এ দেশের মুক্তিসংগ্রামে খেলাধুলার বড় অবদান আছে। দুনিয়াতে এমন উদাহরণ খুঁজে পাওয়া কঠিন, যেখানে একটি দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন শীর্ষ ক্রীড়াবিদেরা। এমন উদাহরণ পাওয়াও কঠিন, যেখানে দেশের সৃষ্টির আগেই তৈরি হয়ে গেছে পুরোদস্তুর একটি জাতীয় দল। এমন নজির আর নেই, যেখানে দেশের জন্মের আগেই ক্রীড়াবিদেরা বিদেশের মাটিতে বাজিয়েছেন সে দেশের জাতীয় সংগীত। এখন সেই দেশ যদি খেলাধুলায় পিছিয়ে থাকে, সেটি হতাশারই!
স্বাধীনতার ৫০ বছরে খেলাধুলায় অর্জন আছে। বেশির ভাগই পুরোপুরি ক্রিকেটকেন্দ্রিক। শূন্য থেকে শুরু করেই দেশের স্বাধীনতার ৩০ বছরের মাথায় দুনিয়ার অন্যতম শীর্ষ ক্রিকেট খেলিয়ে দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আবির্ভূত হয়েছিল টেস্ট মর্যাদার মাধ্যমে। ক্রিকেট দল দুনিয়ার সব শীর্ষ ক্রিকেট খেলুড়ে দেশকেই মাঠের খেলায় হারিয়েছে। খেলছে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে। বিশ্বকাপে সাফল্যও আছে। কিন্তু কোনো দেশ ও জাতি তো কেবল একটি খেলা নিয়ে পড়ে থাকতে পারে না! ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিকস, সাঁতারসহ অন্য খেলাগুলোয় অর্জন কি! অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে দেশের অনেক প্রশংসা শোনা হয়, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষকে এ-ও শুনতে হয়, যে জনবহুল দেশ হিসেবে এটিই একমাত্র দেশ যারা এখনো পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞ অলিম্পিকে কোনো পদক জিততে পারেনি।
আজ থেকে ৩৬ বছর আগে এশিয়ার সবচেয়ে বড় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ একটি ব্যক্তিগত পদক জিতেছিল। আনন্দে উদ্বেল হয়েছিল গোটা দেশ। সিউলে সেই সাফল্যের পর আরও অনেকবার এশিয়াডে খেলা হয়েছে। বক্সিংয়ে মোশাররফ হোসেনের পর আর কেউ তাতে ব্যক্তিগত পদক জিততে পারেনি। এশিয়ান গেমসে সোনার পদকও জেতা হয়েছে, কিন্তু সেটি দলীয় খেলা ক্রিকেটে। রুপা, ব্রোঞ্জও একাধিকবার জেতা হয়েছে—সবই দলীয় খেলায়। এসব তো ক্রীড়াপ্রেমী বাঙালিকে কষ্ট দেয়-ই।
১৯৯০ সালে শুটিং সম্ভাবনাময় খেলা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। অকল্যান্ডে কমনওয়েলথ গেমসে দেশের হয়ে দলগতভাবে সোনার পদক জিতেছিলেন আবদুস সাত্তার নিনি ও আতিকুর রহমান। কমনওয়েলথ গেমসে এরপরেও সোনার পদক ধরা দিয়েছে। ২০০২ সালে শুটিংয়েই দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন আসিফ হোসেন খান, কিন্তু এরপর একটি-দুটি ঝলক ছাড়া অর্জনের ভাঁড়ার শূন্য। আবদুস সাত্তার নিনি, আতিকুর রহমান, আসিফ খানদের অর্জনগুলোকে ধরে রাখা যায়নি। অন্যভাবে বলা যায়, আরও একজন আবদুস সাত্তার নিনি, আতিকুর রহমান কিংবা আসিফ হোসেন খান তৈরি করা যায়নি। দক্ষিণ এশীয় পর্যায়ে সাইফুল ইসলাম রিংকি, সাবরিনা সুলতানারা একাধিকবার সাফল্য পেয়েছেন, কিন্তু সে সাফল্যগুলোকে আরও বড় পর্যায়ে নিতে এই ক্রীড়াবিদদের যে ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, সেসব কি হয়েছে?
অ্যাথলেটিক্স, সাঁতারে সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনাও হেলায় হারিয়ে যায়। ১৯৮৫ ও ১৯৮৭ সাফ গেমসে শাহ আলম ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জিতে হয়েছিলেন দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব। ১৯৯৩ সাফে বিমল চন্দ্র তরফদার আবারও দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হয়েছিলেন। এরপর কেবলই শূন্যতা। এই দেশে আরও একজন দক্ষ স্প্রিন্টার খুঁজে বের করতে ব্যর্থ হয়েছেন অ্যাথলেটিক্সের প্রশাসকেরা। সাঁতার নিয়েও একই কথা খাটে। একজন মোশাররফ হোসেন, একজন বজলুর রহমান, একজন মোখলেসুর রহমান কিংবা কারার মিজানুর রহমানের পর আর কাউকেই তো দেখা গেল না! যে দেশে আর কয়েক দিনের মধ্যেই মেট্রোরেল চলবে, যে দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির বিপ্লব হয়ে গেছে, সে দেশে এখনো অ্যাথলেট ও সাঁতারুরা প্রযুক্তির সুবিধাসহ অন্যান্য মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এটা কি লজ্জা নয়!
হকিতে একসময় সম্ভাবনা ছিল। ১৯৯৩ সালে এশিয়া কাপ হকিতে বাংলাদেশ ষষ্ঠ হয়েছিল। সেই হকির আজ দৈন্যদশা। মাঠে খেলা নেই। কর্মকর্তারা দ্বন্দ্বে মেতে আছেন। একসময়ের সম্ভাবনাময় খেলাটি কেবলই পেছাচ্ছে। নতুন প্রতিভার অন্বেষণ নেই, খেলাটাকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো উদ্যোগ নেই।
ফুটবলের কথা বলার কিছু নেই। খেলাটিকে তো ক্রমান্বয়ে পেছনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। একসময় যে দেশের ক্লাব ফুটবল খেলাপ্রেমীদের রক্তে আগুন ঝরাত, সেই ক্লাব ফুটবলেই মানুষ এখন আগ্রহ হারিয়েছে। বড় বড় ক্লাবগুলো নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির লড়াইয়ে ব্যস্ত। নতুন প্রতিভা তুলে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেই। সারা দুনিয়ার ক্লাব ফুটবল কোথায় এগিয়ে গেছে, আর বাংলাদেশ এখনো পড়ে আছে মান্ধাতার ধ্যান-ধারণায়। লেখাটা বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচের প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করা হয়েছিল। থাইল্যান্ডের সঙ্গে ড্র করে আন্তর্জাতিক ফুটবলে পথচলা শুরু করা বাংলাদেশ ফুটবলে ১৯৮০ সালে এশিয়ান কাপের বাছাই পেরিয়ে চূড়ান্ত পর্বেও জায়গা করে নিয়েছিল। সেই ফুটবলই স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে নিজেদের অবস্থান দেখছে বিশ্ব ফুটবলের তলানিতে। খেলাটি নিয়ে এর প্রশাসকেরা পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছেন, এমন কোনো নিদর্শন নেই।
এত ‘নেই’ আর অপ্রাপ্তির পরও ক্রিকেটে একজন সাকিব আল হাসান তৈরি করা গেছে, এ দেশেই তৈরি হয়েছেন তামিম ইকবাল, মাশরাফি বিন মুর্তজা, মুশফিকুর রহিমরা। একটু পেছনে ফিরে গেলে ক্রিকেটই জন্ম দিয়েছে রকিবুল হাসান, গাজী আশরাফ হোসেন, মিনহাজুল আবেদীন, আমিনুল ইসলাম, আকরাম খানদের মতো তারকা। ফুটবলে তৈরি হয়েছে হাফিজউদ্দিন আহমেদ, কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান খান, মোনেম মুন্না, রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির, রিজভি করিম রুমি কিংবা শেখ মোহাম্মদ আসলাম ও আশরাফউদ্দিন চুন্নুরা।
বাংলাদেশের খেলাধুলার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হচ্ছে, এই নামগুলোর পরম্পরা তৈরি করতে না পারা। এ দেশ দ্বিতীয় কোনো সাকিব আল হাসান, দ্বিতীয় কোনো কাজী সালাউদ্দিন, কিংবা মোনেম মুন্নাদের তৈরি করতে পারেনি। যেমনটি তৈরি করা যায়নি একজন বক্সার মোশাররফ, অ্যাথলেট শাহ আলম কিংবা আসিফ হোসেন খানদের- স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে অজস্র সাকিব, মোনেম মুন্না, শাহ আলমদের তৈরি করারই ব্রত হোক। পরিকল্পনা তৈরি হোক। আনন্দের এই দিনে এটাই হোক প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।