Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

যুদ্ধস্মৃতি

ড. কর্নেল অলি আহমদ বীরবিক্রম (অব.) | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:১২ এএম

১৯৭১ সালে আমি ছিলাম চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত তরুণ এক অফিসার। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুজিবুর রহমান, মেজর জিয়াউর রহমান প্রমুখের সান্নিধ্যে থাকার কারণে তখন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য হয়েও জনগণের পক্ষে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল।

স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং সঠিক সময়ে বিদ্রোহ করে অস্ত্রশস্ত্রসহ সদলবলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল খুবই রোমহর্ষক। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর ক্র্যাকডাউনের খবর আমরা নিজেদের মতো পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে আমি সর্বপ্রথম অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি। সে সময় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন কর্নেল আবদুর রশিদ জানজুয়া এবং সহ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান।

বিদ্রোহের শুরুতেই কর্নেল জানজুয়াসহ মেজর আবদুল হামিদ, ক্যাপ্টেন আহমদ আলী, লেফটেন্যান্ট আজম, বিডিআর অফিসার ক্যাপ্টেন নজর নিহত হন। এ বিদ্রোহ ক্ষণিকের কোনো উত্তেজনা ছিল না, ছিল পরিকল্পিত এবং এভাবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ’৭১-এর ফেব্রুয়ারিতেই শৃঙ্খলাবাহিনীর পক্ষ থেকে আমরা পরিষ্কারভাবে জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের প্রস্তুতির কথা জেনারেল এম এ জি ওসমানীর মাধ্যমে অবহিত করেছিলাম। কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। পরে আমরা নিজেরা নিজেদের মতো করে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করি। সিদ্ধান্ত নিই, জনগণের ওপর আঘাত এলে আমরা পাল্টা আঘাত করব। এ পরিকল্পনায় শরিক ছিলাম সিলেটের লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুজিবুর রহমান চৌধুরী, মেজর জিয়াউর রহমান ও আমি। অনেক পরে এর সঙ্গে আমিন আহম্মেদ চৌধুরীও যোগ দেন। পরিকল্পনামতো আমরা অপেক্ষায় ছিলাম সঠিক সময়টি বেছে নেওয়ার। বিদ্রোহের পর মেজর জিয়ার নেতৃত্বে আমরা প্রথমেই চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করি এবং বেতার থেকে মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান।

মেজর জিয়ার ঘোষণা দেশে-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত সব পক্ষকে বহুমাত্রিক প্রেরণা জোগায় এবং জনগণকে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়তে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করে। ’৭১ সালে দেশের সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেখানে কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা ছিল না। বিবেচনায় ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ।
১৩ এপ্রিল রাতে মেজর জিয়া আমাকে মিরসরাইয়ে যেতে বলেন এবং ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার নির্দেশ দেন। নির্দেশনা পেয়ে রাতেই রামগড় থেকে ৩৫ মাইল দূরে মিরসরাইয়ে এসে উপস্থিত হই। এ সময় আমার সঙ্গে ছিল দুই প্লাটুন প্রাক্তন ইপিআর সদস্য এবং এক প্লাটুন নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। অস্ত্রের মধ্যে ছিল একটি তিন ইঞ্চি মর্টার, একটি মেশিনগান আর একটি ৭৫ মিলিমিটার-বিধ্বংসী ছোট কামান। আমরা যুদ্ধে গেরিলা কৌশল অবলম্বন করলাম। স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় গোপনে রাস্তার দুই পাশে বাংকার তৈরি করে সেখানে অবস্থান নিলাম। আর শত্রুবাহিনীকে আমাদের পাতা ফাঁদে ফেলার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

১৯ এপ্রিল ভোরে কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে আমি নায়েক ফয়েজ আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে আক্রমণের প্রস্তুতি পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখলাম, প্লাটুন কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম ও প্লাটুন হাবিলদার স্ব স্ব বাংকারে নেই। খবর দিয়ে দ্রুত তাদের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা হয়। প্রস্তুতি শেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম প্রধান সড়কে উঠেই চমকে গেলাম। দেখলাম, একটি মাইক্রোবাস আসছে। তার একটু পেছনে একটি সাধারণ ৩ টনি ট্রাক। তার একটু পেছনেই সারিবদ্ধভাবে আসছে ২০টি সামরিক ট্রাকের বহর। প্রতিটিই সৈন্যবাহী ট্রাক। আমি দ্রুত আড়াল নিলাম। পুরো শত্রুবাহিনী আমাদের অবস্থানে ঢুকে পড়তেই আমি ফায়ার ওপেন করলাম। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে ধার করা ৭৫ মিলিমিটার-বিধ্বংসী কামান দিয়ে আমি সবচেয়ে পেছনের ট্রাকটি ধ্বংস করে দিই। হাবিলদার সিদ্দিক মর্টার ফায়ার করে সামনে ও মাঝখানের তিনটি সামরিক ট্রাক উড়িয়ে দেন। অধিকাংশ শত্রুসেনা নিজ গাড়ির মধ্যেই নিহত হয়। আমার কোম্পানি সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শত্রুসেনাদের মিরসরাইয়ে আটকে রাখে। এর মধ্যে ইপিআরের আরেকটি প্লাটুন সুবেদার সাইদুলের নেতৃত্বে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। যুদ্ধের একপর্যায়ে শত্রুবাহিনীর গুলিতে হাবিলদার সিদ্দিক আহত হন। ল্যান্সনায়েক আবুল কালামও অতর্কিত এক মর্টার শেলের আঘাতে ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। এ সময় আরও চারজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। তবে আমরা এ যুদ্ধে ১৫০ জন শত্রুসেনাকে খতম করি এবং তাদের আটটি সামরিক যান ধ্বংস করে দিই, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ সাফল্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। এ যুদ্ধে সাহসী ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকার আমাকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে।

লেখক: প্রেসিডেন্ট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যুদ্ধস্মৃতি

১৬ ডিসেম্বর, ২০২১
আরও পড়ুন