মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখা, ফসিল ফুয়েল বিশেষ করে কয়লা থেকে সরে আসা আর ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ আর অর্থায়নের মতো ইস্যুতে কপ-২৬ সম্মেলনকে ঘিরে ছিল অনেক প্রত্যাশা। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলন শেষে হতাশা যেমন দেখা গেছে তেমন কিছু ক্ষেত্রে অগ্রগতিতে আশাবাদীও বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্বকে বাঁচাতে কপ২৬ সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা কী সিদ্ধান্তে আসেন আর বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য কী প্রতিশ্রুতি আসে - সেদিকে দৃষ্টি ছিল অনেকের। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি এখন সারা বিশ্বই টের পাচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঝড়, জলোচ্ছাস বন্যা খরা দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন বৈশ্বিক বাস্তবতা। সম্মেলনে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সার্বিক বিচারে এ সম্মেলনে যে প্রতিশ্রুতি এসেছে এবং বিশ্ব যে চুক্তিতে উপনীত হয়েছে, সেটিকে একেবারে ব্যর্থ হয়েছে সেটি যেমন ঠিক নয়, তেমনি প্রত্যাশা অনুযায়ী সবকিছু পাওয়া গেছে তাও নয়। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে কপ২৬ সম্মেলন থেকে বিশ্ব তাহলে কী পেল?
২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের সকল বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। সেটাকে এটাকে আইনগত বাধ্য করার একটি রুলস বা আইন প্রণীত হয়েছে এই সম্মেলন থেকে। ২০১৫ সালের আইনটি বাস্তবায়নের জন্য রুলবুক প্রয়োজন সেটি গ্লাসগো মিটিংয়ে সম্পন্ন হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের মূল সংকট তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ শতকে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির বেশি বাড়লে বিশ্বে মারাত্মক খাদ্যঘাটতি দেখা দেবে। পরিবেশে এর বিরুপ প্রতিক্রিয়া হবে মারাত্মক। কপ ২৬ সম্মেলনকে ঘিরে আলোচিত অন্যতম ইস্যুও ছিল বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে ধরে রাখা।
শিল্প বিপ্লব পূর্ব সময়ের চেয়ে তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি যেন না বাড়ে, সেজন্য শীর্ষ গ্যাস উদগীরণকারী দেশগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আশা করা হয়েছিল এবারের সম্মেলন থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে প্রতিশ্রুতী মিলেছে সেখানে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। কপ ২৬ সম্মেলনে উপস্থিত থাকা বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, "২০২১ সালে উন্নত দেশগুলো যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা ১.৭ থেকে ২.৭ পর্যন্ত হয়। যেটা অর্জিত হয়েছে প্রত্যেকটা দেশ তাদের টার্গেট রিভাইস করতে রাজী হয়েছে।" "কিন্তু এখনো টার্গেটটা পর্যাপ্ত নয়।। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এখন উদগীরনকারী প্রধান দেশ হলো, চীন, তারপর যুক্তরাষ্ট্র এবং তারপর ভারত। চীন এবং ভারত রাজি হয়নি কমাতে।"। মি. নিশাত মনে করেন, এ বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত এসেছে সেটি একেবারে হতাশাজনক বলা যায় না। "তারা (চীন, ভারত) রাজি হয়েছে প্রতিবছর রাষ্ট্রপ্রধান পর্যায়ে বৈঠক করে এটা পর্যালোচনা করার জন্য। এবং প্রতিবছর এটা হিসাব-নিকাশ করা হবে। কাজে চাপ অব্যাহত থাকছে। লক্ষ্যমাত্রাটা বিজ্ঞান দেয়া লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। কিন্তু রাজনীতিবিদরা অনেকদূর এগিয়েছেন।"
এ সম্মেলনেই চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র আগামী দশকজুড়ে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে সম্মত হয়েছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনকারী দেশ হলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। কপ২৬ সম্মেলন থেকে তারা বলেছে যে ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে নির্ধারিত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য অর্জনে একসাথে কাজ করবে। বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য সহায়তা দিতে প্যারিস চুক্তিতে বলা হয়েছিল ২০২০ সাল থেকে প্রতিবছর ১শ বিলিয়ন ডলার একটি তহবিলের নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু এখনো সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। এবারের সম্মেলন থেকে ১শ বিলিয়ন ডলারের তহবিলের নিশ্চিত করতে ২০২৩ সালের সময়সীমা দেয়া হয়েছে।
অর্থায়নের বিষয়ে ড. আইননুন নিশাত বলেন, "১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতির জায়গায় এখন পর্যন্ত ৭০-৮০ বিলিয়নের মতো জোগাড় হয়েছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে প্রতিবছর ৭০-৮০ বিলিয়ন ডলার প্রতিবছর অ্যাবজর্ব করার ক্ষমতা দরিদ্র দেশগুলোর নেই।" "দরিদ্র দেশের অর্থায়নের ব্যাপারে জন কেরি বা জো বাইডেনের আশার বানীর ওপর ভরসা করেছিলেন। আমি বলতে চাই প্রত্যাশা অনুযায়ী অর্থায়নের বিষয়টি পূর্ন হয়নি, কিন্তু যতটুকু এগিয়েছে এটাই যথেষ্ট।" ড. নিশাত জানান, "অ্যাডাপটেশনের জন্য আলাদা যেসমস্ত ফান্ড আছে, অ্যাডাপটেশন ফান্ড, এলডিসি কান্ট্রির জন্য ফান্ড, সেগুলো কোনো কোনোটা দ্বিগুণ তিনগুণ বরাদ্দ করা হয়েছে।"
এবারের সম্মেলনে 'লস অ্যন্ড ড্যামেজ ফান্ড' সৃষ্টি করে ক্ষতিপূরণের পেতে বিপন্ন দেশগুলোর একটি প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু এই তহবিলের প্রতিশ্রুতি না মেলায় ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। সম্মেলন শেষে বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. সালিমুল হক কড়া ভাষায় এর নিন্দা করেন। তার ভাষায়, "ঝুকিপূর্ণ এবং গরিব দেশগুলো এই ক্ষতিপূরণের জন্য এসেছিল। কিন্তু তাদের মুখে চড় মারা হয়েছে। আমি হতাশ না ক্ষুব্ধ, হতাশ বললে কম বলা হবে।"
এবারের সম্মেলন থেকে জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার থেকে সরে আসার একটা প্রতিশ্রতির প্রত্যাশা করেছিল সবাই। খসড়া চুক্তিতে ২০৫০ সালের পর কয়লা 'ফেইজ আউট' হবে এমন ভাষা পরিবর্তন করে 'ফেইস ডাউন' ব্যবহার করা হয়েছে। এর পেছনে ছিল ভারত ও চীনের বিরোধীতা। চীন আর ভারতের বক্তব্য হচ্ছে কয়লা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলে উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে। কাজেই তারা সময় চাচ্ছে। ভারত বলছে, তাদের ২০৭০ সাল লাগবে। প্রত্যাশা ছিল তাদের ২০৫০ সালের মধ্যে কয়লা থেকে সরে আসার। কয়লা থেকে সরে আসার ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে হতাশা দেখা দেয় মারাত্মক। তারপরও কয়লা নিয়ে একেবারে আশাহত নন বিশেষজ্ঞরা।
সম্মেলন শেষে জলবায়ু বিষয়ক ইউরোপীয় কমিশনার ফ্রানস টিমারম্যানস তার প্রতিক্রিয়া বলেন, "আমি অত্যন্ত আনন্দিত ছিলাম কয়লা 'ফেইজ আউট' শব্দ ব্যবহারের কারণে। কিন্তু তারপরও যেটা হলো আমি বলবো ২৪ ক্যারটের পরিবর্তে ১৮ ক্যারট গোল্ড। তবুও এটি স্বর্ণ। অর্থাৎ জ্বালানি হিসেবে কয়লা থেকে সরে আসার ব্যাপারে দৃঢ় পদক্ষেপ এটি।" তার মতে, "যেখানে ছয় মাস আগেও চীন ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ কয়লার ক্ষতির বিষয়টি মানতেই নারাজ ছিল। কিন্তু আইপিসিসি রিপোর্ট দেয়ার পর এখন সবাই একমত যে আমরা গভীর সংকটে। ওই দেশগুলো ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিয়েছে।"
এবারের সম্মেলনে আশাব্যঞ্জক যেসব সিদ্ধান্ত তার মধ্যে অভিযোজনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের বিষয়টি অন্যতম বলে মনের করেন বিশেষজ্ঞরা। প্যারিস চুক্তিতে অন্যতম লক্ষ্যমাত্রা হলো অভিযোজন বা অ্যাডাপটেশনের লক্ষ্যামাত্রা। এটা নিয়ে এবারই প্রথম কথাবার্তা শুরু হয়েছে। প্রতিটি দেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সম্ভাব্য ক্ষতি মোকাবেলা এবং খাপ খাইয়ে নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ইনটেনসিটি এবং ফ্রিকোয়েন্সি বাড়বে। এই লক্ষ্যে এবার এগ্রিমেন্ট হলো আগামী দুই বছরের মধ্যে লক্ষ্যামাত্রা নির্ধারিত হবে। এবং দুই বছরে আটটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে সমূদ্র বিষয়ে যেসব প্রতিশ্রুতি এসেছে সেটি নিয়ে আশাবাদী হয়েছে অনেক দেশ। চুক্তিতে বন্যা ঠেকাতে বাধ দেয়া, খরা সহিষ্ণু শষ্য উৎপাদন আর সেচের জন্য বৃষ্টির পানি ধরে রাখার মতো বিষয়ে যেসব প্রতিশ্রুতি এসেছে সেগুলোকে আশাব্যঞ্জক হিসেবে দেখছে অনেক দেশ।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত বলেন, "আমি মনে করি গ্লাসগো মিটিং সফল হয়েছে। যদিও বহু সিভিল সোসাইটি লিডার বলবেন এটা সফল হয়নি অনেক গ্যাপ আছে।" "আমার মতে এ সম্মেলন থেকে অনেক দূর এগিয়েছে। সম্মেলনে ৫০ ধরনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তার মধ্যে কেন যেন কার্বনডাই অক্সাইড আর ১.৫ এর ব্যাপার এবং অর্থায়নের ব্যাপারটা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু প্রতিটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।"
সবমিলিয়ে এবারের জলবায়ু সম্মেলনকে ঘিরে হতাশা যেমন আছে, তেমনি অগ্রগতিও রয়েছে। যদিও জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়াও হলো এ অগ্রগতি প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়। তারপরও বলা হচ্ছে যে প্রতিশ্রুতিগুলো এসেছে সেগুলো বাস্তবায়ন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারবে জলবায়ু পরিবর্তনের হ্রাস টেনে ধরতে। সূত্র: বিবিসি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।