Inqilab Logo

বুধবার, ২৯ মে ২০২৪, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২০ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

রোমান ক্যাথলিক ও রুশ অর্থডক্স চার্চের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ

প্রকাশের সময় : ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:৩২ এএম, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬

ইনকিলাব ডেস্ক : পোপ ফ্রান্সিস রুশ ধর্মগুরু কিরিলের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হচ্ছেন। একাদশ শতকে চার্চের বিভাজনের পর রোমান ক্যাথলিক চার্চের নেতা পোপ ফ্রান্সিস ও রুশ অর্থডক্স চার্চের একজন আধ্যাত্মিক নেতার মধ্যে প্রথমবারের মতো এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মূলতঃ পোপের কর্তৃত্বের ইস্যুকে কেন্দ্র করে গির্জাসমুহের মধ্যে এই বিভাজন সৃষ্টি হয়।
রোমান ক্যাথলিক চার্চ এবং রুশ অর্থডক্স উভয় চার্চের জন্যই এর গুরুত্ব খুবই অপরিসীম। আজ শুক্রবার তারা কিউবায় মিলিত হচ্ছেন। এই বৈঠকে যে ঘোষণাপত্রেই তারা স্বাক্ষর করুন না কেন তার গুরুত্ব অপরিসীম। এর মধ্যদিয়ে এটাই সুস্পষ্ট হচ্ছে যে হাজার বছর ধরে উভয় চার্চের মধ্যেকার বিরাজমান বৈরিতা ও শীতলতার অবসান ঘটিয়ে তাদের মধ্যে সম্পর্কের নতুন যুগের সুচনা হতে যাচ্ছে।
রুশ অর্থডক্স চার্চের সঙ্গে রোমান ক্যাথলিক চার্চের সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিশ্বের ২০ কোটিরও বেশী অর্থডক্স খ্রিস্টানদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই হচ্ছে রুশ অর্থডক্স খ্রিস্টান।
এর আগে রোমান ক্যাথলিক পোপগণ মস্কোর সঙ্গে এ ধরনের একটি সমঝোতা গড়ে তোলার পথ সুগম করার চেষ্টা করেছেন। বিশেষকরে পোপ সেইন্ট দ্বিতীয় জন পল রুশ অর্থডক্স চার্চের সঙ্গে একটি আন্তরিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালান।
পোপ দ্বিতীয় জনপল সøাভিক জাতিগোষ্ঠির হলেও মস্কোয় স্নায়ূ-যুদ্ধ পরবর্তী সন্দেহের কারণে অবশ্য সেসব প্রচেষ্টা সফল হয়নি
সাম্প্রতিক বিশ্বের ভূরাজনৈতিক ঘটনাবলীর গতিধারা কিউবার রাজধানী হাভানায় হোসে মার্তি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুই নেতার এই ‘ব্যক্তিগত কথপোকথন’কে সম্ভব করে তুলেছে।
এই বৈঠকের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হচ্ছে বিগত কয়েক বছরের উপলব্ধি। যখন মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় খ্রিস্টানরা নির্যাতিত হচ্ছে বা তাদের বাড়িঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে এবং এসব খ্রিস্টান কোন চার্চের অনুসারী সে ব্যাপারে তাদের ঘাতকদের কোন আগ্রহ নেই। চার্চ নির্বিশেষে তারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তখন খ্রিস্টান ধর্মগুরুরা তাদের নিজেদের মধ্যেকার হাজার বছরের  বৈরিতা-বিভেদ দূর করে ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন।
পোপ ফ্রান্সিস এই ঐক্য প্রতিষ্ঠাকে রক্তের মিলন হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং পোপ, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুটিন এবং রুশ অর্থডক্স চার্চের প্রধান সবাই সিরিয়া ও ইরাকে খ্রিস্টানদের সম্পর্কে অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন। তারা সিরিয়া ও ইরাকে খ্রিস্টান হত্যাকে গণহত্যা হিসেবে মনে করেন।
বিশ্বের প্রথম ল্যাটিম আমেরিকান পোপ হিসেবে বর্তমান পোপের নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। কিউবা, মস্কো ও অন্যত্র তার সম্প্রতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তার এই উদ্যোগই এধরণের একটি বৈঠকে রাজী হতে অর্থডক্স চার্চকে উৎসাহিত করেছে।
পোপ ফ্রান্সিসকে মস্কোয় এমন একজন নেতা হিসেবে দেখা হয় যিনি গত তিন বছরে বেশ উষ্ণ সংবর্ধনা সত্ত্বেও অনেক বিষয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একমত নন। তার সহজাত আগ্রহ হচ্ছে সংঘাতের বদলে সংলাপ।
পশ্চিমা চার্চের প্রভাব নিয়ে রাশিয়ায় এখনো অনেকের মধ্যে সংশয় রয়েছে বিশেষকরে ইউক্রেনের ঘটনাবলীতে তারা উদ্বিগ্ন। অনেক রুশ অর্থডক্স  ইউক্রেনের গ্রিক ক্যাথলিক চার্চকে তাদের বৈরি হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। তারা গ্রিক চার্চকে মস্কোর ধর্মীয় অঙ্গণে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বিবেচনা করে যা তাদের মতে এটি মূলত রাশিয়ার রাজনীতির বিরুদ্ধেই অবস্থান নিচ্ছে।
জোসেফ স্ট্যালিনের সময়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রাচ্যের চার্চগুলোকে অর্থডক্স চার্চের কাছে হস্তান্তর করেছিলো। তবে কমিউনিজমের পতনের পর ক্যাথলিকরা ৫ শোর মতো গির্জা পুনরায় নিজেদের হাতে তুলে নেয়। বিশেষ করে ১৯৮০ ও ১৯৯০ এর দশকে পশ্চিম ইউক্রেনে বিভিন্ন গির্জার কর্তৃত্ব ফিরে পাওয়ার ঘটনা রুশ অর্থডক্স চার্চকে আতংকিত করে তোলে।
অনুরূপভাবে বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করার মাধ্যমে অর্থডক্স অনুসারীদের নিজেদের কব্জায় আনার ক্যাথলিকদের প্রচেষ্টা সোভিয়েত পরবর্তী রাশিয়াকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। বার্লিন প্রাচীরের পতনের পর অর্থডক্সদের রোমান ক্যাথলিক ভাবধারায় আনতে মিশনারীদের ব্যাপক তৎপরতা ছিল খুবই লক্ষ্যণীয়। অবশ্য তারা অনেক চেষ্টা চালালেও খুব কম সংখ্যক অর্থডক্সই রোমান ক্যাথলিজমে দীক্ষিত হয়েছে।
অবশ্য রাশিয়ার বর্তমান অর্থডক্স ধর্মগুরু কিরিল তার পূর্বসুরীদের তুলনায় ক্যাথলিকদের প্রতি বিগত বছরগুলোতে অনেক বেশী সহনশীলতা প্রদর্শন করেছেন।
আগের ধর্মগুরুদের চেয়ে তিনি ক্রেমলিনের সঙ্গেও অনেক ঘনিষ্ঠ। তাই অনেকেই মনে করেন যে প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুটিনের এক ধরণের কৌশলগত সম্মতি ও আগ্রহের ফলেই তিনি পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হতে আগ্রহী হয়েছেন। পুটিন ইতিমধ্যে ক্যাথলিকদের শীর্ষ ধর্মীয় কেন্দ্র ভ্যাটিকান সফর করেছেন এবং কয়েকজন পোপের সঙ্গে সাক্ষাতও করেছেন।
কয়েক দশকের নাস্তিক্যবাদের পর রাশিয়া তার ধর্মনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির পাশাপাশি বৈশ্বিক ধর্মীয় অঙ্গনে তার প্রাসঙ্গিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায়ও গভীরভাবে আগ্রহী।
এখন ভ্যাটিকান নিজেকে কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে আবার প্রমাণ করেছে যা নিয়ে সবাই হিসেব-নিকেশ করছে এবং সম্ভবত ভ্যাটিকানের এই গুরুত্বকে রাশিয়া কাজে লাগাতে আগ্রহী।
সিরিয়া যুদ্ধ থেকে শুরু করে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে খ্রিস্টানদের রক্ষাকরাসহ বিভিন্ন ইস্যূতে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে কথোপকথনের প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হিসেবেও ভ্যটিকান নিজেকে প্রমাণ করছে। একই সঙ্গে ইসলামী চরমপন্থীদের হুমকি থেকে বিশ্বকে রক্ষার প্রশ্নেও ভ্যাটিকানকে এক সম্ভাব্য মিত্র হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে এখনই উভয় চার্চের মধ্যে মহামিলন হয়ে যাচ্ছে বা ১০৫৪ সালের পূর্ব-পশ্চিমের বিভেদ-বিভাজানের অবসান ঘটছে। খ্রিস্টান ঐক্য নিকটবর্তীও এতে হচ্ছেনা। তবে এটা নিশ্চিত যে কিউবায় উভয় চার্চের গুরুদের মধ্যে যে বৈঠক হচ্ছে তাতে একটি শ্রদ্ধাপূর্ণ সংলাপের সূচনা হচ্ছে যা আগামীদিনে বিশ্ব রাজনীতিকে প্রভাবিত করবে।
এ পর্যন্ত কোন পোপ রাশিয়া সফর করেন নি। তাই কিউবার এই বৈঠক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত এর মধ্যদিয়ে এমন একটি পথ উন্মোচিত হবে যা ভবিষ্যতে উভয় চার্চের মধ্যে অব্যাহত থাকবে এবং অনেক নাটকীয় ঘটনাও ঘটবে।
অর্থডক্স কারা?
খ্রিস্টানদের তিনটি ভাগের একটি হচ্ছে অর্থডক্স। অপর দুটি গ্রুপ হচ্ছে রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেসট্যান্ট। প্রতিটি গ্রুপের নিজস্ব গির্জা রয়েছে। এগুলো স্বশাসিত অর্থাৎ প্রতিটি চার্চের নিজস্ব প্রধান যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছে পৃথক রীতি ও ঐতিহ্য। একটির সঙ্গে আরেকটির কোন সম্পর্ক নেই। অর্থডক্স শব্দটি এসেছে গ্রীক ভাষা থেকে। গ্রীক ভাষায় অর্থ হচ্ছে ‘সঠিক’ এবং ডোক্সা হচ্ছে ‘বিশ্বাস।’
বিশ্বাসের দিক থেকে অর্থডক্স গির্জাগুলো ঐক্যবদ্ধ এবং ধর্মীয় বিশ্বাস, রীতিনীতি ও অনুশাসন মেনে চলার ক্ষেত্রে অভিন্ন নিয়মনীতি মেনে চলে। তারা গ্রীক, মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়া ও সøাভিক সংস্কৃতির উপাদানে সমৃদ্ধ।
প্রাচ্যের রোমান ক্যাথলিক সাম্রাজ্যের খ্রিস্টানিটি থেকে অর্থডক্স ঐতিহ্যের সূচনা হয় এবং সেখানকার ভৌগোলিক অঞ্চলের জনগণ, রাজনীতি ও বাস্তবতার আলোকে এটি বিকশিত হয় এবং সুনির্দিষ্ট একটি রূপ ধারণ করে।
যেহেতু রোমান সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলীয় রাজধানী ছিল বাইজেন্টাইন তাই এখনকার খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বাইজেন্টানিয়ান খ্রিস্টান হিসেবেও ইতিহাসে উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যান্য চার্চের মতো অর্থডক্সরাও ঈশ্বর, যিশুর জন্ম, তার ক্রুশবিদ্ধ ও পুনরুত্থান সম্পর্কে অভিন্ন বিশ্বাস পোষণ করে। তবে জীবনযাপন, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন ও ধর্মতত্ত্বের বেশ কিছু বিষয়ে অন্যান্য চার্চের সঙ্গে অর্থডক্সের মতপার্থক্য খুবই ব্যাপক এবং হাজার বছর ধরে তাদের মধ্যে এই মতপার্থক্য ও বিভেদ রয়েছে। এখন উভয় চার্চের নেতারা নিজেদের মধ্যে বিরাজমান এই বৈরিতা-বিভেদ দূর করতে সচেষ্ট হয়েছেন। Ñসূত্র : এএফপি



 

Show all comments
  • ruhul. amin ১৫ অক্টোবর, ২০১৭, ৪:০৮ পিএম says : 0
    help me
    Total Reply(0) Reply
  • MD.Younus mia ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ৯:৪৩ পিএম says : 0
    অর্থোডক্স খ্রিস্টান সম্পর্কে আর ও কিছু জানতে চাই,,
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোমান ক্যাথলিক ও রুশ অর্থডক্স চার্চের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ