Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাকিস্তানের জয় উদযাপন করে ভারতে যারা জেলে যাচ্ছেন

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৫ নভেম্বর, ২০২১, ১১:৪৩ এএম | আপডেট : ১১:৪৪ এএম, ৫ নভেম্বর, ২০২১

পৃথিবী নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা লাখ লাখ ভক্তের মতো নাফিসা আতারি টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপে পাকিস্তান ও ভারতের ম্যাচ দেখতে চোখে রেখেছিলেন টেলিভিশন পর্দায়। ভারতের উত্তরের শহর উদয়পুরের এই শিক্ষিকা পাকিস্তানের দাপুটে জয় দেখেন। এর কয়েকদিন পরে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। আপাতত তার অপরাধ: পাকিস্তানের জয় উদযাপন করে একটি হোয়াটস্যাপ স্ট্যাটাস।

ভারতে পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে সমর্থনের জন্য সস্প্রতি যে কজন মুসলিম নাগরিককে গ্রেফতার বা আটক করা হয়েছে নাফিসা আতারি তাদেরই একজন- যা বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের বাকস্বাধীনতা নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এটা ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক সংগঠনের ভারতীয় জনতা পার্টি- বিজেপির যে উদ্দেশ্য তাতে নতুন অস্ত্র হিসেবে যোগ হয়েছে এই ধরপাকড়। যদিও বিজেপি সেটা জোরালোভাবে নাকচ করে আসছে।

আতারি হোয়াটস্যাপ স্ট্যাটাসে ক্রিকেটারদের ছবি দিয়ে লিখেছিলেন, `জিতে গেছি..... আমরা জিতে গেছি।‘ এই শিক্ষিকার কোন এক শিক্ষার্থীর মা-বাবার নজরে আসে এই হোয়াটস্যাপ পোস্ট, তিনি এটি অন্যদের পাঠান এরপর এটা ভাইরাল হয়ে যায়। নাফিসা আতারিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে, ভারতের পেনাল কোডের অধীনে গ্রেফতার করা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে 'জাতীয় সংহতির জন্য ক্ষতিকর’ বক্তব্য দিয়েছেন।

স্থানীয় একটি টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকার দিয়ে তিনি অপরাধের জন্য ক্ষমা চান, সেখানে তাকে বিক্ষিপ্ত লাগছিল। টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘কেউ একজন আমাকে মেসেজ করে জিগেস করেছিল আমি পাকিস্তান সমর্থন করছি কি না। সেই বার্তায় কিছু ইমোজি ছিল এবং খুব আনন্দময় পরিবেশ ছিল, আমি বলেছি হ্যা। কিন্তু এটা বুঝাইনি যে আমি পাকিস্তান সমর্থন করি। আমি ভারতীয় এবং ভারত ভালোবাসি।’

জামিন পাওয়ার পর তিনি ঘরে ফিরেছেন স্বামী ও সন্তানের সাথে এবং তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মোকাবেলা করছেন। তার আইনজীবী রাজেশ সিংভি বলেছেন, পুলিশ যা করেছে তা সম্পূর্ণ ভুল। যদি কেউ ভুল করে বা যদি আপনি কারো সাথে একমত না হন সেটা অপরাধ না বা জাতীয়তা বিরোধী না। ‘এটা (পুলিশ যেটা করেছে) সংবিধান ও আইনের বিরুদ্ধে।’

কট্টরপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী বাজরং দলের একজন সদস্য রাজেন্দ্র পরমার মিজ আতারিকে নিয়ে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি বলেন, ‘এদের উচিৎ পাকিস্তান চলে যাওয়া। আপনি ভারতে আছেন, আয় করছেন কিন্তু আপনি পাকিস্তানের জয় উদযাপন করছেন।’ পরমারের কোনও অনুতাপ নেই এই অভিযোগ দায়ের নিয়ে। তিনি বলেছেন, ‘এটা তার জন্য একটা শিক্ষা হওয়া উচিৎ। সে স্কুলের শিক্ষিকা। সে কী পড়াবে বাচ্চাদের?’

তার এই মন্তব্যে ১৯৪৭ সালে আলাদা হওয়া দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার আভ্যন্তরীণ শত্রুতার গভীরতা ফুটে ওঠে। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সম্পর্কটা বেশ নড়বড়ে, যেখানে ১৯৮০ সাল থেকেই ভারতের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চলছে। কাশ্মীরে একদল মেডিকেল শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সমর্থন করার অভিযোগে কঠোর একটি সন্ত্রাস বিরোধী আইনে মামলা করা হয়েছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে সাবেক বিজেপি সাংসদ ভিক্রাম রান্ধওয়া বলছেন, এই ছাত্রদের 'চামড়া ছিলে ফেলা উচিৎ’ এবং ভারতের মাটিতে পাকিস্তানপন্থী স্লোগান দেয়ার কারণে তাদের ডিগ্রী ও নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া উচিৎ। ঘৃণা ছড়ানোর দায়ে রান্ধওয়ার বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ দায়ের করেছে, বিজেপিও তাকে তিরস্কার করেছে এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাকে ক্ষমা চাইতে বলা হয়েছে।

বিজেপি যদিও পার্টি হিসেবে এমন উগ্র ভাষা ব্যবহার থেকে নিজেদের বিরত রাখছে কিন্তু দলটির সিনিয়র সদস্যরা পাকিস্তানের সমর্থন দেয়ার বিরোধিতা জানিয়েছেন এবং কেউ কেউ বলছেন এটা অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা উচিৎ। ভারতের সাবেক ক্রিকেটার যিনি এখন বিজেপির রাজনীতি করেন, সেই গৌতম গম্ভীর মনে করেন পাকিস্তানের জয় উদযাপন করাটা 'লজ্জাজনক’। টুইটারে গৌতম গম্ভীর লিখেছেন, ‘পাকিস্তানের জয়ে যারা আতশবাজি ফুটিয়েছেন তারা ভারতীয় হতে পারেন না। আমরা আমাদের ছেলেদের সাথে আছি।’

ইয়োগি আদিত্যনাথ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী একটি পত্রিকায় বলেছেন, ভারতীয় যারা এই জয়ে উল্লাস করেছেন তাদের রাষ্ট্রদোহী মামলা দেয়া উচিৎ। ভারতের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রদোহ মামলায় সরকারের সমালোচনাও একটি অপরাধ, অনেকেই মনে করেন মুক্তকণ্ঠ রোধে এটাকে ব্যবহার করা বাড়ছে।

একটি পডকাস্ট, দ্য সিন অ্যান্ড দ্য আনসিনের উপস্থাপক অমিত ভার্মা বলছেন, ‘আমরা দেখছি এখানে বিজেপি মুসলিমদের আলাদা করে রেখে হিন্দুদের ভোট আদায় করছে। বেশ কিছু বিষয় যা অনেক দশক ধরে আলোচনায় নেই সেগুলো নিয়ে এসেছে বিজেপি; যেমন গো-হত্যা, হিন্দু-মুসলিম বিবাহ, এমনকি ভারতীয় হয়ে পাকিস্তানের সমর্থন।’ তিনি মনে করেন, ‘এগুলো আসলে তাদের কাছে কোনও বিষয় না। এগুলো মুসলিম-বিরোধী যে চেতনা সেটাকে উষ্কে দেয়া, দুঃখজনকভাবে এটা ছড়িয়ে যাচ্ছে।’

তবে ভারত সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ মুখপাত্র বলেছেন, কেউ যদি বলে এই অল্প কয়েকজন মুসলমানের বিরুদ্ধে নেয়া পদক্ষেপ ভারতে থাকা লাখো মুসলমানের জন্য শাস্তিস্বরূপ হয়ে দাঁড়াবে তবে সেটা 'অযৌক্তিক'। ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা কাঞ্চন গুপ্তা এই সাম্প্রতিক ধরপাকড়ের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, তারা ভারতের হার উদযাপন করছিলেন। এমন যেকোনও কর্মকে আইনশৃঙ্খলার আওতায় আনা উচিত। এটা যেকোনও উপায়ে থামানো দরকার। তিনি আরো যোগ করেছেন, "যদি এখানে দুজন ছাত্র, ওখানে পাঁচজন ছাত্র, কোথাও কোন শিক্ষক এমন কিছু করে যা উষ্কানিমূলক এবং এতে আরো সমস্যা তৈরির আভাস থাকে তাহলে সেটা খতিয়ে দেখা দরকার, তদন্ত দরকার।"

যেসব পরিবারের লোক আটক করা হয়েছে তারা মনে করেন পুরো ব্যাপারটা অসামঞ্জস্যপূর্ণ। উত্তর প্রদেশেও সাতজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে পাকিস্তানের জয় উদযাপনের। পুলিশ বলছে, তারা ভারতীয় ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে অসম্মানজনক কথা বলেছে এবং তাদের মন্তব্য জাতীয়তা বিরোধী যা শান্তি নষ্ট করতে পারে।

আরশাদ ইউসেফ, ইনায়াত আলতাফ ও সওকত আহমদ আগ্রার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল নিয়ে পড়ছেন। তারা এখন জেলে আছেন। তাদের কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে এবং তারা কোনও আইনজীবী খুঁজে পাচ্ছেন না। শহরের ইয়ং লইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নিতিন ভার্মা বলেছেন, "তাদের আমরা কোনও আইনী সহায়তা দেব না। তারা ভারতের থেকে পাকিস্তানের জয় উদযাপন করেছে।" "এটা দেশের বিরুদ্ধে এবং জাতীয়তা বিরোধী। আমাদের দায়িত্ব তাদের রুখে দেয়া। এমন যেকোনও কর্ম কোনওভাবেই উৎসাহ দেয়া হবে না সামনে।"

ভারতীয়দের মননে ক্রিকেট সবসময় বড় একটা জায়গা নিয়ে আছে, কিন্তু সম্প্রতি পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় দেখা গেছে পরিণত বয়সের খুবই স্বল্প সংখ্যক মানুষ (৫৬%) মনে করেন ভারতীয় হতে হলে ভারতের ক্রিকেট দলের সমর্থক হতে হবে। ক্রিকেট সাংবাদিক ও সামাজিক বিষয় নিয়ে মন্তব্য করেন এমন একজন শার্দা উগ্রা প্রশ্ন রেখেছেন, "প্রতিপক্ষ দলের সমর্থন দেয়া অপরাধ কোন আইনে?" তিনি আরও বলে, "যুক্তরাজ্য কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় বংশোদ্ভূত কেউ কি ভারতকে সমর্থন দেয়ার জন্য গ্রেফতার হবেন? এটা নিশ্চিতভাবেই একটা উদ্দেশ্যপূর্ণ ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করছে।" সূত্র: বিবিসি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ