ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য
মুসলিম ঈদোৎসবগুলির মধ্যে ঈদুল ফেতর ও ঈদুল আজহা- এই দুই ঈদকে প্রধান উৎসব বলে খোদ
হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কোনো তুলনা নেই। কোনো ক্ষেত্রেই নয়। দৈহিক চেহারা, সৌন্দর্য, চারিত্রিক মাধুর্য, মানবিক গুণাবলী- সব ক্ষেত্রেই তিনি অতুল্য। হযরত আলী (রা.) রাসুলেপাক (সা.) সম্পর্কে বলেছেন: ‘তাঁর মতো মানুষ তাঁর আগেও দেখিনি, পরেও দেখিনি।’ তাঁর এই সাক্ষ্যের বরাবর আর কোনো সাক্ষ্য হতে পারে না। রাসূলুল্লাহ (সা.) কেমন ছিলেন তার বিবরণ-বর্ণনা অনেকেই দিয়েছেন। আমরা এখানে দুটি বিবরণ উল্লেখ করবো।
এক.
সিরাতে ইবনে হিশামে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আলী ইবনে আবু তালিবের পুত্র মুহাম্মদের পুত্র ইব্রাহিম থেকে গুফরার আজাদকৃত দাস উমার রাসূল (সা.) এর দৈহিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের যে বর্ণনা দেন, তা নিম্নরূপ: ‘আলী ইবনে আবু তালিব যখনই রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রশংসা করতেন তখনই বলতেন, ‘তিনি অধিক লম্বা ছিলেন না। আবার খুব বেটেও ছিলেন না। বরং তিনি উচ্চতায় সবার মধ্যে মধ্যম আকৃতির ছিলেন। তাঁর চুল অত্যাধিক কুঞ্চিত ছিল না, আবার একেবারে অকুঞ্চিতও ছিল না। বরং তা কিঞ্চিত কোঁকড়ানো ছিল। তিনি খুব বেশি স্থূল বা মোটা দেহের অধিকারী ছিলেন না। তাঁর মুখমণ্ডল একেবারে গোলাকার ও ক্ষুদ্র ছিল না। চোখ দুটি ছিল কালো। ভ্রু যুগল ছিল লম্বা। গ্রন্থির হাড়গুলো ও দুই স্কন্ধের মধ্যবর্তী হাড়টি ছিল উঁচু ও সুস্পষ্ট। বক্ষ থেকে নাভি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল ছিল হালকা লোমে আবৃত। হাত ও পায়ের পাতা ছিল পুষ্ট, চলার সময় পা দাবিয়ে দিতেন না, মনে হতো যেন কোনো নিম্নভূমিতে নামছেন। কোনো দিকে ফিরে তাকালে গোটা শরীর নিয়ে ফিরতেন। তাঁর দুই স্কন্ধের মাঝখানে নবুয়তের সিল বা মোহর লক্ষণীয় ছিল। বস্তুত: তিনি ছিলেন শেষ নবী, শ্রেষ্ঠ দানশীল, শ্রেষ্ঠতম সাহসী, অতুলনীয় সত্যবাদী, সবচেয়ে দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন, সবচেয়ে অমায়িক, মিশুক। প্রথম নজরে তাঁকে দেখে সবাই ঘাবড়ে যেতো।’
দুই.
রাসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার সময় পথিমধ্যে অবস্থিত উম্মে মা’বদ ও তাঁর স্বামী আবু মা’বদের কুটিরে উপস্থিত হন। এই পুণ্যাত্মা দম্পতি ক্লান্ত-শ্রান্ত পথিকদের তাঁদের কুটিরে আশ্রয় দিয়ে খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা করেন। হুজুর (সা.) যখন তাঁদের কুটিরে উপস্থিত হন তখন আবু মা’বদ ঘরে ছিলেন না। মেষ চরাতে গিয়েছিলেন। হুজুর (সা.) ও তাঁর সঙ্গীরা উম্মে মা’বদের কাছে জানতে চান, সেখানে খাদ্য ও পানীয় কেনার সুযোগ আছে কিনা। উম্মে মা’বদ বিষণ্ন বদনে উত্তর দেন, সে রকম কোনো ব্যবস্থা নেই। থাকলে মূল্য দিতে হতো না। কুটিরের এক প্রান্তে একটি ছাগী শুয়ে ছিল। হযরত (সা.) উম্মে মা’বদের কাছে জানতে চাইলেন, ছাগী দোহন করে দুধ সংগ্রহ করা যাবে কিনা। উত্তরে উম্মে মা’বদ বলেন, ছাগীটি কৃষ ও দুর্বল। যদি তার স্তনে দুধ থাকে তবে তা তিনি দোহন করতে পারেন। হুজুর (সা.) ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তাকে দোহন করলেন। আল্লাহর ফযলে যথেষ্ট দুধ পাওয়া গেলো এবং তিনি ও তাঁর তিন সঙ্গী তা পান করলেন। দুধের একটা অংশ গৃহমালিকদের জন্যও রইল। অতঃপর তাঁরা সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।
আবু মা’বদ ঘরে ফিরে দুধের কথা জিজ্ঞাসা করায় উম্মে মা’বদ পুরো ঘটনা তাকে বিবৃত করে শোনান। উম্মে মা’বদ রাসূল (সা.) এর যে বর্ণনা দেন, বিভিন্ন সিরাত গ্রন্থে তার উল্লেখ রয়েছে। মোহাম্মদ আকরম খাঁ রচিত ‘মোস্তফা-চরিতে’ তিনি আরবি থেকে বাংলায় সে বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন, এখানে তা উদ্ধৃত হলো।
‘তাঁহার উজ্জ্বল বদনকান্তি, প্রফুল্ল মুখশ্রী, অতিভদ্র ও নম্র ব্যবহার। তাঁহার উদরে স্ফীতি নাই, মস্তকে খালিও নাই। সুন্দর, সুদর্শন, সুবিস্তীর্ণ কৃষবর্ণ নয়ন যুগল। কেশকলাপ দীর্ঘ ঘন সন্নিবেশিত। তার স্বর গম্ভীর, গ্রীবা উচ্চ, নয়নযুগলে যেন প্রকৃতি নিজেই কাজল দিয়া রাখিয়াছে, চোখের পুতুলি দুইটি সদা উজ্জ্বল, চঞ্চল, ভুরু যুগল নাতিযুগ্ম পরস্পর সংযোজিত, স্বত কুঞ্চিত ঘনকৃষ কেশদাম। মৌনাবলম্বন করিলে তাঁহার বদনমণ্ডল হইতে গুরুগম্ভীর ভাবের অভিব্যক্তি হইতে থাকে আবার কথা বলিলে মনপ্রাণ মোহিত হইয়া যায়। দূর হইতে দেখিলে কেমন মোহন, কেমন মনোমুগ্ধকর সে রূপরাশি, নিকটে আসিলে কত মধুর, কত সুন্দর তাহার প্রকৃতি, ভাষা অতি মিষ্ট ও প্রাঞ্জল, তাহাতে ত্রুটি নাই, অতিরঞ্জন নাই, বাক্যগুলি যেন মুক্তার হার। তাঁহার দেহ এত খর্ব নহে যাহা দর্শনে ক্ষুদ্রত্বের ভাব মনে আসে বা এমন দীর্ঘ নহে, নয়ন যাহা দেখিতে বিরক্তি বোধ করে, তাহা নাতিদীর্ঘ নাতিখর্ব। পুষ্ট ও পুলকে সে দেহ যেন ফুল্লকুসুমিত নববিটপীর সদ্য পল্লবিত প্রশাখা। সে মুখশ্রী বড় সুন্দর, বড় সুদর্শন ও সুমহান। তাঁহার সঙ্গীরা সর্বদাই তাহাকে বেষ্টন করিয়া থাকে। তাঁহারা তাঁহার কথা আগ্রহ সহকারে শ্রবণ করে এবং তাঁহার আদেশ উৎফুল্লচিত্তে পালন করে।’
‘স্ত্রীর মুখে এই বর্ণনা শ্রবণ করিয়া আবু মা’বদ উত্তেজিত স্বরে বলিলেন, আল্লাহর দিব্যি, ইনি কোরেশের সেই ব্যক্তি, ইহারই সম্বন্ধে আমরা কত সত্য মিথ্যা শ্রবণ করিয়াছি। আমার দূরদৃষ্ট, এমন সময় অনুপস্থিত ছিলাম। নচেৎ আমি নিশ্চয়ই তাঁহার স্মরণ লইতাম, সুযোগ পাইলে এখনো তাঁহার চেষ্টা করিব।’ (মোস্তফা চরিত)।
কবি বলেছেন: ‘নিখিলের চির সুন্দর সৃষ্টি আমার মোহাম্মদ রাসুল’। বস্তুত তাঁর তুলনা তিনি নিজেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।