Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাসূল নামের সুবাস

হোসেন মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ২১ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি শেষ নবীও বটে। সমগ্র সৃষ্টির জন্যই তিনি আল্লাহর রহমত। এ বিশ্বে তাঁর মত অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব, অনুপম চরিত্র, মধুর স্বভাবের মানুষ কেউই আসেননি। প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়েই তাঁর জন্য সঞ্চিত রয়েছে গভীর ভক্তি ও ভালোবাসা। আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় নবী ও রাসূল (সা.)-এর নামের সাথে যে সুবাস মেখে দিয়েছেন তা কাল-কালান্তরের সীমা পেরিয়ে আজো অফুরান ঘ্রাণ ছড়িয়ে চলেছে নবী-প্রেমীদের হৃদয়ে।
আমরা জানি, মানুষ বরাবরই শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্তে¡র কাছে ভক্তি ও শ্রদ্ধাবশত মাথা অবনত করে। বিশে^ এ পর্যন্ত যে সব মহান ব্যক্তি এসেছেন অমুসলিম গবেষক-পন্ডিতগণও শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে তাদের সারিতে স্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে ‘দি হান্ড্রেডস’ গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করা যায়। তাতে পৃথিবীর যুগনায়ক, অবিস্মরণীয় প্রতিভাবানদের সাথে তাঁকে স্থান দেয়া হয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই যাঁদের কথা বলা হয়েছে তাঁরা সবাই মানবকুলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা বিশে^র শ্রেষ্ঠতম মনীষী ও জ্ঞানী। কিন্তু এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে রাসূল (সা.) তাঁদের যে কারো চেয়েই যে কোনো দিক দিয়ে ও সার্বিক ভাবে অনেক বেশি উজ্জ্বল ও উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। ব্যক্তিত্ব, সহিষ্ণুতা, ধৈর্য, মানবতা, দয়া, উদারতা, বিচক্ষণতা, সৌজন্য, মহত্ত¡ প্রভৃতি মানবিক যত গুণ আছে তার প্রতিটির সর্বোচ্চ, সৌন্দর্যময়, অনুপম প্রকাশ তাঁর মধ্যে পরিলক্ষিত হয় যাঁর সাথে কারোরই আসলে তুলনা হয় না। যে কোনো অর্থেই তিনি অনন্য। আল্লাহতা’লা যাঁকে ‘উসওয়াতুন হাসানা’ করে প্রেরণ করেছেন, তিনি সর্বোত্তম আদর্শ হবেন এটাই স্বাভাবিক। ফরাসি লেখক আলফন্স দ্য লামার্টিন বলেছেন, “দার্শনিক, বক্তা, ধর্মপ্রচারক, যোদ্ধা, আইন রচয়িতা, ভাবের বিজয়কর্তা, ধর্মমতের ও প্রতিমাবিহীন কর্মপদ্ধতির সংস্থাপক, কুড়িটি পার্থিব রাজ্যের ও একটি ধর্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সেই মুহাম্মদ (সা.)কে মানুষের মহত্তে¡র যতগুলো মাপকাঠি আছে তা দিয়ে মাপলে কোন লোক তাঁর চেয়ে মহত্তর হতে পারে? হজরত মুহাম্মদ (সা.) আমাদের সকলের আদর্শ। স্বামী দেখতে পাবে তাঁর মধ্যে স্ত্রী অনুরাগী আদর্শ স্বামী, পুত্র দেখতে পাবে তাঁর মধ্যে মাতা-পিতা ভক্ত আদর্শ পুত্র, পিতা দেখতে পাবে তাঁর মধ্যে মমতাশীল, কর্তব্যপরায়ণ আদর্শ পিতা, গৃহী দেখতে পাবে তাঁর মধ্যে স্বহস্তে গৃহকর্ম সম্পাদনরত আদর্শ গৃহী, দরবেশ তাঁর মধ্যে দেখতে পাবেন সংসার মধ্যে ইবাদতে নিরত আদর্শ দরবেশকে, প্রভু তাঁর মধ্যে দেখতে পাবেন সদয় হাসিমুখ প্রভু, ভৃত্য তাঁর মধ্যে দেখতে পাবে কর্তব্যনিষ্ঠ পরিশ্রমী আদর্শ ভৃত্য, বণিক তাঁর মধ্যে দেখতে পাবে আদর্শ বণিক, যোদ্ধা তাঁর মধ্যে দেখতে পাবে নির্ভীক আদর্শ যোদ্ধা, সেনাপতি দেখতে পাবেন তাঁর মধ্যে রণকুশলী ও স্থির মস্তিষ্কের আদর্শ সেনাপতি, নেতা দেখতে পাবেন তাঁর মধ্যে হিতৈষী জনসেবক আদর্শ নেতা, বিচারক তাঁর মধ্যে দেখতে পাবেন নিরপেক্ষ ন্যায়নিষ্ঠ আদর্শ বিচারক।” (উদ্ধৃতঃ তুরস্কের ইতিহাস, ২য় খন্ড) বস্তুত হজরত মুহাম্মদ ((সা.) জীবনে কখনো এমন কোনো কথা বলেননি যা নিন্দা বা সমালোচনার যোগ্য। তিনি এমন কোনো চিন্তা করেননি যাতে অন্যের অনিষ্ট হতে পারে, এমন কোনো কাজ করেননি যাতে কারো অমঙ্গল হতে পারে, এমন কোনো পদক্ষেপ নেননি যা কারো জন্য বিপর্যয়কর হতে পারে। কোনো মানুষের জন্য কখনোই কোনো অবস্থায়ই ক্ষতিকর ছিলেন না। তার জীবনে তিনি কোনো মিথ্যা কথা বলেননি, অন্যের ক্ষতি বা অসুবিধা করারা জন্য কোনো কৌশল বা চাতুর্যের আশ্রয় নেননি। তিনি সেই অতুলনীয় মানুষ যার বিরুদ্ধে কখনো কোনো মানুষ দুর্ব্যবহার, ওয়াদা খেলাফ, মিথ্যাচার, অহমিকা, স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষের কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেনি। তিনি জীবনভর অন্যের উপকার, মঙ্গল, কল্যাণই করেছেন। সকল ভাবে মানুষকে সাহায্য করেছেন, কোনোভাবেই কারো মনস্তাপের কারণ হননি। মানব ইতিহাসে এত সব গুণের সু-সমন্বয়পূর্ণ পূর্ণাঙ্গ মানুষ কার্যত একজনই এসেছেনÑ তিনি হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
মানুষ চিত্তের অস্থিরতায়, মানসিক যন্ত্রণায় দিশাহারা হয়ে যখন আশ্রয় সন্ধান করে বা সান্ত¡না চায় তখন এমন কাউকে খোঁজে যার কাছে, যার কথায়, যার ব্যবহারে শান্তি পাওয়া যায়। রাসূল (সা.) তাঁর অনন্য জীবনাদর্শ নিয়ে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন সেই আশ্রয় হয়ে। তাঁর গোটা জীবন যেমন সুষমা মন্ডিত তেমনি পরিপূর্ণ। সেখানে কোনো অস্পষ্টতা, ঘাটতি, কলংকের দাগ নেই। সূর্যের উজ্জ্বল আলোর মত, চাঁদের আলোর স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের মত, উত্তপ্ত মরুভ‚মিতে প্রান্তরের ওপার থেকে মধুর পরশ নিয়ে বইতে থাকা মৃদুমন্দ বাতাসের মত ছিল তাঁর জীবন। আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় হাবিবকে, আখেরি নবীকে সমগ্র মানবকুলের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী করে তাঁকে কিয়ামতের দিন উম্মতের শাফায়াতকারী করেছেন। আর কোনো নবী, বিশে^র আর কোনো ধর্মের, সমাজের কোনো মহামানব এ সম্মানে সম্মানিত হননি।
বর্তমান বিশে^ উগ্রপন্থা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসের প্রাবল্যের প্রেক্ষাপটে রাসূল (সা.)-এর শিক্ষা ও আদর্শের অনুসরণ অত্যন্ত ফলপ্রসূ হতে পারে, হতে পারে সেসব থেকে পরিত্রাণের প্রেরণা। তিনি কখনো কাউকে শত্রæ ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধের আঙ্গুল উঁচু করেননি বা প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে রক্তপাতের নিষ্ঠুর পন্থা অবলম্বন করেননি। তিনি যুগের পর যুগ ধরে অন্ধকার হৃদয়ে বিবেচনাহীন সহিংসতাকে লালন করেননি। তিনি আপন জনসমাজের বর্বরতা ও রক্তপিপাসার নিন্দিত চারিত্র থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন। প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার নিষ্ঠুর মানসিকতা কখনো তাকে আবিষ্ট করেনি। মায়া-মমতাহীন আরব ভ‚খন্ডের তিনিই প্রথম উড্ডীন করেছিলেন মানুষ ও মানবতার বিজয় নিশান। ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, সংযম, সহনশীলতা গড়ে তুলেছিল তাঁর ভবিষ্যত মহৎ বৈশিষ্ট্যের ভিত্তি। আরব মরুভূমির রুক্ষ ভয়ংকরত্ব নয়- সীমাহীন বিস্তৃতির নীল-নীলিমা মাখা আকাশের উদারতা তাঁর চরিত্রকে মহিমান্বিত করেছিল।
আজকের বিশে^ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু ক্রমাগত বিলীন হচ্ছে মানবতা। ক্ষমতাশালী, সম্পদশালীরা সকল কিছুর নিয়ন্ত্রণ কুক্ষিগত করছে আর ক্ষমতাহীন, দরিদ্র, অসহায় মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে অপমান, লাঞ্ছনা আর দুরবস্থার দিকে। পবিত্র কুরআন যে সাম্যের কথা ঘোষণা করেছে, তার অনুসরণে ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনা কালে রাসূল (সা.) সমাজে সমতার যে সুষ্ঠু বিন্যাস করেছিলেন, তার তুলনা নেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে মানবিক বৈশিষ্ট্যে সম্পূর্ণ ত্রæটিহীন করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। আর তিনিও মানব সমাজের জন্য প্রকৃত কল্যাণমুখী ব্যবস্থাই কায়েম করেছিলেন। খুলাফায়ে রাশেদার আমলে তা অধিকতর জোরদার হয়। কিন্তু মানব সমাজের দুর্ভাগ্য যে পরবর্তীতে তা একেবারে লোপ পায় যা কিনা বিশ^কে ইনসাফহীন, ব্যাপকভাবে মানবিক বিবেচনাহীন করে তুলেছে। আজ সুস্পষ্টভাবে এটা পরিলক্ষিত যে বিশ^ মানবের শ্রেষ্ঠতম আদর্শ হিসেবে তিনি যতটা সম্মানিত ও স্মরিত, খোদ মুসলিম মুসলিম সমাজেই তিনি সার্বিকভাবে অনুসৃত নন। এর নেতিবাচক ফলও দৃশ্যমান। মুসলিম বিশে^ শাসক আছে, আল্লাহর খলিফা নেই। মানুষ আছে, মানবতা ক্রম ক্ষীয়মান। রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু ইনসাফের নিশ্চয়তা কোথাও নিশ্চিত নয়।
শীর্ষ সত্যগুলোর একটি সত্য হচ্ছে কিয়ামত-তক ইসলাম স্পন্দনশীল থাকবে। মানব সমাজ আল্লাহর কাছ থেকে উপহার হিসেবে ইসলাম ধর্মকে পেয়েছে। আর এ ধর্মের প্রাণস্পন্দন মহানবী মুহাম্মদ (সা.)। মুসলিম ধর্মীয় জীবনে আল্লাহর প্রস্বস্তি বা হামদের পরই তাই নাতে রাসূল স্পন্দিত হয়। এই স্পন্দন প্রতিটি মুসলিমের দেহে, প্রতিটি রক্তকণিকায় অনুভ‚ত হোক, প্রতিটি মুসলিম আল্লাহর প্রকৃত বান্দা ও নিখাদ রাসূলপ্রেমী হোক।
লেখক, সাংবাদিক, গবেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুহানবী (সা.)
আরও পড়ুন