দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মানবজাতির রিজিক বণ্টিত। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীর খাবার সংস্থানের দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা গ্রহণ করেছেন। মানুষের জন্মের পূর্বেই তার খাদ্যের বিষয়টি নির্ধারণ হয়ে যায়। জীবদ্দশায় মানুষ তার স্থিরীকৃত খাবার গ্রহণ করে থাকে। ভাগ্যে লিপিবদ্ধ খাবার সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কারোর মৃত্যু সংঘটিত হয় না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী এমন কোনো প্রাণী নেই, যার রিজিক আল্লাহ তায়ালা নিজ দায়িত্বে রাখেননি।’ (সুরা হুদ: ৬) অপর আয়াতে বলেছেন, ‘আসমানেই আছে তোমাদের রিজিক এবং তোমাদেরকে যার প্রতিশ্রæতি দেয়া হয় তাও।’ (সুরা জারিয়াত: ২২)
তবে বাহ্যিক উপকরণ ও মাধ্যম হিসেবে আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে রিজিক অন্বেষণ ও খাবার জোগানোর লক্ষ্যে চেষ্টা-প্রচেষ্টা ব্যয়ের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। বলেছেন, ‘তিনিই তোমাদের জন্য ভূমিকে বশ্য করে দিয়েছেন। সুতরাং তোমরা তার কাঁধে চলাফেরা কর ও তাঁর রিজিক খাও। তাঁরই কাছে তোমাদেরকে পুনর্জীবিত হয়ে যেতে হবে।’ (সুরা মুলক: ১৫) অপর আয়াতে বলেছেন, ‘নামাজ শেষ হয়ে গেলে তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকার) সন্ধান কর। যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা জুমা: ১০) আয়াতদ্বয় থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই রিজিক দাতা। কিন্তু অন্বেষণ পরিত্যাগ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকা ইসলামে সমর্থনযোগ্য নয়। বরং মানুষের কর্তব্য হল, রিজিকের চাহিদা মেটাতে আল্লাহ তায়ালার উপর ভরসা করে হালাল পন্থায় সাধ্যানুযায়ী অবিরত প্রচেষ্টা চালানো।
রিজিক দ্বারা উদ্দেশ্য ধন-সম্পদ, এমন ধারণা ভুল। আল্লাহ তায়ালা বান্দাকে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ যত প্রকার নেয়ামত দান করেছেন সবই রিজিকের অন্তর্ভুক্ত। যেমন: ধন-সম্পদ, নেককার স্ত্রী-সন্তান-পরিজন, সুস্থতা-গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি। এ সবকিছু আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্ণীত। সুতরাং আল্লাহ তায়ালার অশেষ অনুগ্রহে এসব নেয়ামত প্রাপ্তিতে এসে গেলে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা আবশ্যক। তেমনি নেয়ামত হস্তচ্যুত হয়ে যাওয়ার মত কার্যকারণ থেকে দূরে থাকাও অবশ্য কর্তব্য।
রিজিক বৃদ্ধির মাধ্যমসমূহ:
(ক) হারাম পরিত্যাগ করা: আল্লাহ তায়ালার নিকট থেকে হালাল রিজিক পাওয়ার আশায়, শাস্তির ভয়ে ভীত হয়ে সর্বপ্রকার হারাম উপার্জন থেকে নিবৃত্ত থাকা। অবশ্যই এর বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা উত্তম রিজিক প্রদান করবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালাকে খুশি করার লক্ষ্যে হারাম বর্জন করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে তার চেয়েও শ্রেষ্ঠ কিছু দান করেন। হাদিসে বর্ণিত বনি ইসরাইলের বিখ্যাত ঘটনাসহ সাহাবায়ে কেরামের এ সংক্রান্ত ঘটনাবলি স্বরণযোগ্য।
(খ) অধিক পরিমাণে জিকির করা: হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ তায়ালার নিকট কিছু কামনাকারীর তুলনায় জিকিরকারীকে তিনি বেশি দান করেন। (তিরমিজি: ৩১৭৪) আল্লাহ তায়ালার জিকির-স্বরণ বিভিন্নভাবে হতে পারে। যেমন: নামাজ-দোয়া, বিশেষ করে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ নামাজ ও তাহাজ্জুদ নামাজ। ইস্তিগফার-বিনয় ইত্যাদি। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তাদেরকে বলেছি, নিজ প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চিতভাবে জেন, তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতিতে উন্নতি দান করবেন।’ (সুরা নুহ: ১০-১২) বোঝা গেল, জিকির-তওবা, বিনয় ইত্যাদি রিজিক বৃদ্ধি, সম্পদ বৃদ্ধি, আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও বরকত অবতীর্ণ হওয়ার সেরা মাধ্যম। হাদিস শরিফে বিভিন্ন প্রকার জিকিরকে জান্নাতের খনি এবং দুশ্চিন্তা দূরকারী হিসেবে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
(গ) অধিক পরিমাণে দান-সদকা করা: অধিকহারে দান-সদকা করা রিজিক বৃদ্ধির অন্যতম মাধ্যম। বর্ণিত হয়েছে, ‘হে আদম সন্তান, তুমি আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় কর, তাহলে তোমার জন্যও ব্যয় করা হবে।’ (বুখারি: ৫৪০৬) রিজিকের প্রশস্ততা কামনাকারীর জন্য হাদিসটি বিরাট সুসংবাদবাহী। তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান গনিকে (রা.) তার সম্পদ বৃদ্ধির কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘সকাল বেলায় আমি একশত দিনার দান করলে সন্ধ্যায় আমার এক হাজার দিনার অর্জন হয়ে যায়!’ এসব মনীষীদের ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে, ‘সৎ মানুষের হাতের সৎ সম্পদই শ্রেষ্ঠ!’
(ঘ) আল্লাহ তায়ালার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা: পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘এবং সেই সময়টাও স্মরণ কর, যখন তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেছিলেন, তোমরা সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে, আমি তোমাদেরকে আরও বেশি দেব, আর যদি অকৃতজ্ঞতা কর, তবে নিশ্চিত জেন আমার শাস্তি অতি কঠিন।’ (সুরা ইবরাহিম: ৭) বোঝা গেল, রিজিকের প্রশস্ততা আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করার সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। কৃতজ্ঞতা আদায় না করলে আল্লাহ তায়ালা রিজিক সংকীর্ণতার আজাব চাপিয়ে দেন।
(ঙ) পিতা-মাতার আনুগত্য করা, আত্মীয়তা বজায় রাখা: রিজিক বৃদ্ধির জন্য এগুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নবী করিম (সা.) এর নিকট কোনো ব্যক্তি রিজিক সংকীর্ণতার অভিযোগ করলে নবী করিম (সা.) তাকে উক্ত কাজগুলি করার প্রতি জোর তাকিদ দিতেন। বর্ণিত হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কামনা করে তার রিজিক বৃদ্ধি লাভ করুক, সে যেন আত্মীয়তার বন্ধন বজায় রাখে।’ (বুখারি: ২০৬৭) পিতা-মাতা ও আত্মীয়ের হক আদায় করা, তাদের সাথে সুন্দর আচরণ করা মানুষের নিকটতম অধিকার। তাছাড়া পিতা-মাতার খুশি ও দোয়ার বরকতে মানুষ সৌভাগ্যশীল হয় এবং দুনিয়া ও আখেরাতে উত্তম জীবন ধারণ করতে সক্ষম হয়। এগুলির সাথে সাথে আমানত রক্ষা করা, সততা বজায় রাখা, নিয়ত সঠিক রাখাও রিজিক বৃদ্ধির প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
রিজিক বৃদ্ধির আমল: প্রত্যেক মানুষের ভাগ্যে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে কিছু নেয়ামত দান করা হয়। যেগুলি অর্জন করতে হয়। পরিত্যাগ করলে অধিকারে আসে না। মানুষের জন্য আসমানে দুটি দরজা থাকে। একটির মাধ্যমে তার আমলসমূহ আল্লাহ তায়ালার নিকট উপস্থাপিত হয়। আরেকটির মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে তার রিজিক অবতীর্ণ হয়ে থাকে। আসমান ও জমিনের মালিক আল্লাহ তায়ালার নিকট এই দরজা দুটির চাবি রয়েছে। আল্লাহ তায়ালার আরোপিত বিধি-বিধান পালনের মাধ্যমে দরজা দুটি প্রশস্ত হয়। এর সাথে রিজিক বৃদ্ধির কিছু আমলের কথাও কুরআন-হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। যেমন:
# সুরা ওয়াকেয়া, সুরা ফাতেহা, সুরা জারিয়াত এবং ঋণপরিশোধ সংক্রান্ত আয়াত পাঠ।
# রিজিক বৃদ্ধি-হ্রাসের কথা বর্ণিত হয়েছে এমন আয়াত পাঠ।
# রিজিক বৃদ্ধির দোয়াসমূহ পাঠ।
# আল্লাহ তায়ালার নিরানব্বইটি নাম পাঠ।
# দুরুদ শরিফ পাঠ।
# যে কোনো কাজ বিসমিল্লাহ বলে শুরু করা ইত্যাদি।
উপরোক্ত আমলগুলি বেশি পরিমাণে আদায় করা আবশ্যক। আমলগুলির বিনিময়ে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে রিজিক বৃদ্ধির ওয়াদা করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে তৌফিক দান করুন। আমিন!
লেখক: খতিব, আল মক্কা জামে মসজিদ হরপাড়া, শ্রীনগর, মুন্সিগঞ্জ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।