Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বরখাস্ত হলেন বনানীর বিতর্কিত ওসি (তদন্ত) সোহেল রানা

ভারতে রিমান্ডে চলছে জিজ্ঞাসাবাদ আমাকে ধরতে এক হাজার বছর লাগবে-সোহেল রানার অডিও গোয়েন্দাদের হাতে

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০০ এএম

গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক বনানী থানার সাবেক ওসি (তদন্ত) সোহেল রানা ভারতে পালিয়ে গেছেন এমন পুলিশ রিপোর্ট পাবার পর অবশেষে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তার স্থলে নতুন কর্মকর্তাকেও বদলি করা হয়েছে। তবে সোহেল রানার বিপুল পরিমান টাকা বিদেশে পাচার এবং বেশ কয়েকজন সহযোগিকে খুঁজছে পুলিশসহ একাধিক সংস্থার কর্মকর্তারা। একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দুনীতির ও বিদেশে টাকা পাচারের সাথে সম্পৃক্ত থাকার প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার পর ছায়া তদন্ত শুরু করেছে সিআইডি। একটি দায়িত্বশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

তদন্ত-সংশ্নিষ্ট সূত্র বলছে, ই-অরেঞ্জের অর্থ আত্মসাতের মামলায় আসামি হওয়ার পরপরই দেশ থেকে পালাতে গিয়ে শুক্রবার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের চ্যাংড়াবান্ধা এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে আটক হন সোহেল। বিনা ভিসায় ভারতে প্রবেশের দায়ে করা মামলায় দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে বর্তমানে তিনি তিনদিনের রিমান্ডে রয়েছেন। ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের সময় সোহেলের কাছ থেকে থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশের পাঁচটি ডেবিট কার্ড জব্দ করা হয়। তার পাসপোর্টে ভারতের ভিসা না থাকলেও ছিল থাইল্যান্ড, সৌদি আরব, চীন ও শেনজেন ভিসা।

সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, সোহেল রানা নামে-বেনামে দেশে-বিদেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। থাইল্যান্ডের পাতায়ায় হিলটন হোটেলের পাশে একটি পাঁচতারকা হোটেল করার জন্য শতকোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে তার। দেশেও একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। এই অঙ্কও প্রায় একশ কোটি টাকার কাছাকাছি। এ ছাড়া পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে সুপারশপ, বার ও রেস্টুরেন্টও রয়েছে। সম্প্রতি ই-অরেঞ্জে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি সামনে আসার পরপরই সোহেলের অর্থ-সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে একাধিক সংস্থা। এখন পর্যন্ত ই-অরেঞ্জের দুটি ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় ৩৪৯ কোটি টাকা বেহাত হওয়ার তথ্য মিলেছে। এই অর্থ ই-অরেঞ্জ থেকে সরিয়ে দেশে-বিদেশে অন্যান্য ব্যবসায় সোহেল বিনিয়োগ করেছেন- এমনটি বলছেন সংশ্নিষ্টরা।

ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, রোববার তার স্থলে নতুন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মামলা ছিল। তিনি ভারতে পালিয়ে গেছেন, গুলশান পুলিশের পক্ষ থেকে এমন রিপোর্ট আসার পর বনানীর পরিদর্শক (তদন্ত) সোহেল রানাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগের মধ্যে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারত-নেপাল সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক আটক হন বনানী থানার ওসি (তদন্ত) সোহেল রানা। এমন অবস্থার মধ্যে তার স্থলে গত রোববার নতুন কর্মকর্তা হিসেবে উত্তরা পূর্ব থানার ওসি (তদন্ত) আলমগীর গাজীকে বদলী করা হয়েছে। বিএসএফের হাতে আটক সোহেল রানা গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারী বহুল আলোচিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের পৃষ্ঠপোষক। তিনি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে কর্মরত ছিলেন। বনানী থানার এই পুলিশ পরিদর্শকের বোন ও ভগ্নিপতি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘ই-অরেঞ্জ’ পরিচালনা করতেন।

ভারতীয় ওই সংবাদমাধ্যম বলেছে, গা ঢাকা দেয়ার লক্ষ্যে ভারতে প্রবেশ করেন সোহেল রানা। বর্তমানে রিমান্ডে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
আমি বড় খেলোয়াড়, আমাকে ধরতে এক হাজার বছর লাগবে: শোনো আমি তোমাকে একটা কথা বলি। আমি বাংলাদেশের কতটা পাওয়ার নিয়ে চলি, আমি নিজে জানি। তুমি আমারে মনে করো না যে, আমি কম বড় খেলোয়াড়। আমাকে যদি ধরতে হয়, তাহলে তোমার থেকে বড় খেলোয়াড় লাগবে। আলোচিত ‘ই-অরেঞ্জে’র পৃষ্ঠপোষক বনানী থানার সাবেক পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) শেখ সোহেল রানার এ রকমই দম্ভোক্তি-ভরা একটি কথোপকথনের অডিও পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিস্ট একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা। একজন গ্রাহক ই-অরেঞ্জে তার বিনিয়োগের টাকা চাইলে তাকে হুমকি দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমাকে ধরতে এক হাজার বছর লাগবে। পণ্য ডেলিভারি না দেয়া এবং অগ্রিম অর্থ ফেরত না দেয়ায় ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে গ্রাহকদের ১১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দায়ের করা এক মামলায় প্রতিষ্ঠানটির মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান এখন কারাগারে। এ ছাড়া রাজধানীর গুলশান থানায় এক গ্রাহকের প্রায় কোটি টাকা আত্মসাতের ঘটনায় একটি মামলা হয়। সেই মামলায় দশ অভিযুক্তের মধ্যে সোহেল রানার নাম রয়েছে।

একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা গতকাল বলেন, ই-অরেঞ্জের প্রতারণার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে একজন গ্রাহক সরাসরি সোহেল রানাকে ফোন দিয়েছিলেন। এ সময় ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তি সোহেলের কাছে টাকা ফেরত চাইলে তাকে নানাভাবে হুমকি দেয়া হয়। ফোনের অডিওতে শোনা যায়, সোহেল রানা দম্ভ করে বলছেন, তিনি বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী। তাকে কিছুই করা যাবে না। পুলিশে তার চাকরির ১৯ বছরের ১২ বছরই গুলশান বিভাগে চাকরি করেছেন বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

কথোপকথনের মধ্যে সোহেল রানা বলেন, শোনো, আমি তোমাকে একটা কথা বলি। আমি বাংলাদেশের কতটা পাওয়ার নিয়ে চলি, আমি নিজে জানি। তুমি আমারে মনে করো না যে আমি কম বড় খেলোয়াড়। আমাকে যদি ধরতে হয়, তাহলে তোমার থেকে বড় খেলোয়াড় লাগবে।

আপনি (সোহেল রানা) চারটি বিয়ে করেছেন বা টাকা নিয়ে হয়রানি করছেন- এই কথা বলে ওই ভুক্তভোগী পুলিশের ঊচ্চপর্যায়ে অভিযোগ করবেন জানালে সোহেল রানা হুমকি দিয়ে বলেন, এসব অভিযোগ দিয়ে কোনো লাভ হবে না।আমার চারটা বউ, পাঁচটা বউ, দশটা বউ তাতে কার কী? আমার বউরা কি কোনো কিছু বলেছে? যতক্ষণ পর্যন্ত আমার বউয়েরা না অভিযোগ করবে ততক্ষণ পর্যন্ত কিছু হবে না। তোমাকে আমি ডেকে নিয়ে এসেছি, তারপরও তুমি আমার এডিসির কাছে গিয়েছো কেন? বলেই গালি দেন সোহেল রানা।

পুলিশ সূত্র জানায়, সোহেল রানা গুলশান এলাকায় নানা কারবারে জড়িত ছিলেন। তার সঙ্গে বিভিন্ন দুতাবাসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে ছিল গভীর সখ্যতা। মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে উন্নত দেশগুলোর ভিসার ব্যবস্থা করে দিতেন। চাকরী জীবনে বেশিরভাগ সময়ই থেকেছেন ডিএমপির গুলশান ডিভিশনে।

গুলশান এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, চীন, থাইল্যান্ড, পর্তুগাাল ও ইংল্যান্ডে আছে হরেক রকমের ব্যবসা। আর গুলশানে আছে স্প্রা থেকে শুরু করে কাচাবাজারের ব্যবসা। গুলশান ২ নম্বর ডিসিসি মার্কের্টেও ২য় তলায় আছে তার একটি নামিদামি সেলুন। ল্যাান্ডভিউ মার্কেটে আছে একটি মানিএক্সচেঞ্জ। ডিসিসি মার্কেট সংলগ্ন কাচাবাজারে আছে একটি দোকান। গুলশান এক নম্বর নাভানা টাওয়ারেও তার আছে একটি দোকান। ডিসিসির মার্কেটের মিস্টার বাকেরের দোকান ছিল তার নিয়মিত আড্ডাস্থল। তার গলা ও হাতে পড়তেন অন্তত ৩০ ভরি ওজনের সোনার চেইন। গুলশান ২ নম্বরের ১২৩ নম্বর রোডে আছে একটি ফ্ল্যাট। আছে ১২টি প্রাইভেটকার। চাকরী জীবনে সোহেল রানা চীন, পর্তুগাল, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, ইংল্যান্ড, নেপাল ও ইতালিতে যাতায়ত করেছেন বহুবার। ওই ব্যবসায়ীরা আরও জানান, সোহেল রানা নিয়মিত যে সানগ্লাসটি ব্যবহার করতেন সেটি বছর দুয়েক আগে আমেরিকা থেকে ২২শ ডলার দিয়ে কিনেছেন। তার একেকটি টি শার্টের দাম ১১শ থেখে ১২শ ডলার। গুলশান এলাকার মাহবুব ও সুমন নামে অপর দুই ব্যবসায়ী তার গুলশানের ব্যবসাগুলো নিয়মিত দেখাশুনা করতেন। একটি গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা জানান, সোহেল রানা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নানা অপকর্ম করেছেন। তিনি অর্থের পেছনে ছুটেছেন নিয়মিত। তার নামে-বেনামে অন্তত শত কোটি টাকার সম্পদ আছে বলে আমাদের কাছে তথ্য এসেছে। উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশেই আমরা সোহেল রানার প্রতিটি বিষয় তদন্ত করছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সোহেল রানার অডিও গোয়েন্দাদের হাতে
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ