Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভোলায় মেঘনার ভাঙনে আতঙ্কিত রাজাপুরবাসী, অব্যাহত ভাঙনে চরম ঝুঁকিতে ভোলা শহর রক্ষাবাঁধ

ভোলা জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০২১, ২:৪৩ পিএম

উজানের পানির তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নে মেঘনার ভয়াভব ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। এতে হঠাৎ করে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে মেঘনা। গত কয়েক দিনের নদী ভাঙ্গনে এরই মধ্যে বহু বসতঘর ও দোকানপাট,মাছঘাট,মসজিদ সহ প্রায় ৪০০ মিটার এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্ষার মধ্যে ঘরবাড়ি হারা পরিবার গুলো রয়েছে নানা ভোগান্তিতে। এছাড়া ভাংঙ্গনের আতঙ্কে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি। ভাঙ্গন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে গোটা এলাকা জুড়ে। ভাঙ্গন রোধে জরুরী ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী স্থানীয়দের। এদিকে ভাঙন প্রতিরোধে বালুভর্তি জিও টিউব ফেলার কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড ।
উজান থেকে নেমে আসা পানির তীব্র স্রোতে ভোলার মেঘনা নদীর উত্তর ভোলার রাজাপুর ইউনিয়নে জোড়খাল এলাকায় এসে আঘাত হানে। এতে নদীর প্রায় প্রায় আধা কি.মি. এলাকা জুড়ে ঘূর্নিস্রতের সৃষ্টি হয়ে তীব্র ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ফলে হঠাৎ করে যেন ভয়ংকর রূপ নিয়েছে মেঘনা। এরই মধ্যে ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের কয়েকটি পয়েন্টে দীর্ঘ ৪( চার) কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। এরমধ্যে ইউনিয়নের জোড়খাল এলাকায় তীব্র ভাঙ্গনের ফলে ৪০০ মিটার এলাকা নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙ্গনের ফলে প্রায় ৭০ মিটার ভিতরে নদী চলে আসছে। নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বহু মানুষের ঘরবাড়ি, কৃষিজমি,দোকানপাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ভাঙন কবলিত পরিবারগুলো ঘরবাড়ি ও গাছপালা কেটে সরিয়ে নিচ্ছে।এছাড়া ভাংঙ্গনের আতঙ্কে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি । তবে নতুন করে ঘর তোলার জায়গা না থাকায় দিশেহার দরিদ্র পরিবার গুলো। ভাঙ্গন প্রতিরোধে জরুরী ভিত্তিতে কার্যকরি পদক্ষেপ না নেয়া হলে ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কায় ভোলা রক্ষাবাঁধ।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান,প্রতি বছর বর্ষা এলেই মেঘনা ভয়ঙ্কর রুপ ধারণ করে ভাঙ্গন শুরু হয়। গত বছর থেকে রাজাপুরের জোড়খাল এই পয়েন্টে ভাঙ্গন শুরু হয়। তখন পানি উন্নয়ন বোর্ড নাম মাত্র জিও ব্যাগ ফেললেও তা চলে গেছে নদীতে।
এই এলাকার নদী ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত কামাল উদ্দিন বলেন, প্রতি বছর বর্ষা মৌসুম আইলেই নদী ভাঙ্গন শুরু হয়। আমাদের বাড়ি নদীতে নিয়ে গেছে এই পর্যন্ত ৫ বার।গয়েক বছর আগে আমাগো বাড়ি ছিলো নদী থেকে কয়েক মাইল দূরে। সেইখানেও ভাঙ্গছে। এখন এইখানে আশ্রয় নিয়েছি এখানেও ভাঙ্গছে। এখন নিজেস্ব কোন জায়গা নেই।
এই এলাকার কৃষক রহমত উল্লাহ্ জানান, এই খানে আমার বাড়ি ছিলো। কৃষি জমি ছিলো। মেঘনার ভাঙ্গনে সব নিয়ে গেছে। এখন আমার সব শেষ।
রাজাপুর এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, উজানের তীব্র পানির স্রোতে আমাদের উত্তর রাজাপুর এর জোড়খাল এলাকার ২ নং ওয়ার্ড ভাইঙ্গা বিলিন হইয়া যাইতাছে। এইখানে ভাঙ্গন এতো বেশি যে মানুষ ঘরবাড়ি সড়ানোর সময়টাও পাইতাছেনা।এই খান থেকে মূল শহর রক্ষা বাঁধ মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে। ঐ বাঁধ ভাইঙ্গা গেলে পুরা শহর পানিতে তলাইয়া যাইবো। তারপর এই খানে ভাঙ্গনের পাশে বড় একটি প্রকল্পে কাজ করছে ব্লকের। এই খানে ভাইঙ্গা গেলে ঐ বড় প্রকল্পটাও হুমকীর মধ্যে পইড়া যাইবো। দ্রুত রাত-দিন খাইটা ভাঙন প্রতিরোধে বালুভর্তি জিও টিউব ফালাইতে হবে। যাতে পানির স্রোতটা অন্যদিকে যায়। তাহলে ভাঙ্গন কিছুটা রোধ হইবো।
নদী ভাঙ্গনের স্বীকার মো: নূরনবী জানায়, প্রথম ঘর করছিলাম রামদাসপুর সেখানেও নদীতে ভাঙ্গছে। তারপর আইলাম রাজাপুর সেখানে ভাঙ্গছে। এই ভাবে একে একে ৫ বার নদী ভাঙ্গনের স্বীকার হইছি। নদীতে ভাঙ্গতে ভাঙ্গেত পূর্ব পুরুষের ভিটা সব শেষ হইয়া গেছে। এখন কোন রকম নদীর পারে জমি কিইনা আশ্রয় নিয়া ছিলাম। সেই শেষ আশ্রয় স্থল টুকু নদীতে লইয়া গেলো। এখন পোলাই সায়ন বাপ-মা লইয়া খোলা আকাশের নিচে তাহন ছাড়া কোন উপায় নাই। সরকার যদি আমাগো দিকে চায়া ইকটু আশ্রয়ে ব্যবস্থা করে তাহলে মাথা খোঁজার ঠাই হবে। তা নাহলে সব শেষ।
ভাঙ্গনের স্বীকার বিবি মরিয়ম বলেন,নদীতে এই পর্যন্ত ৫ ভাড় ভাঙ্গছে। এই ভাঙ্গা লইয়া ৬ ভাঙ্গা দিছে। আমারা যে কোথায় আশ্রয় নিবো সেই ডাল কূল নেই। জোয়ার আইলে ভিডার উপরে খারাইয়া থাকি। এহন আমাগো ভিডাডাও লইয়া গেলো নদীতে। এরতোন আমাগো মইরা যাওনো ভালা। সরকার এরতন আমাগোরে মাইরা লাইলেও ভালা হয়। বাড়ি নাই ঘর নাই দূয়ার নাই। এহন থাকমু কই আর খামু কই।
ভাঙ্গনের স্বীকার আল-আমিন,কুলুসুম,আমেনা সহ আরো অনেকে জানায়, আগুনে পুড়লে তো বিডাটা থাকে,আর নদীতে ভাঙ্গলে তো সেই বিডাও থাকেনা। এহন বিডা-বাড়ি আড়াই এই রাজাপুরে জোড়খাল এলাকায় আমরা মানবতর জীবন কাটাচ্ছি। সরকারের কাছে দাবী আমাগো দ্রুত ভাঙ্গন রোধে যেন ব্যবস্থা নেয়।
ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: মিজানুর রহমান জানান, ভোলার উত্তর ভোলার রাজাপুর ইউনিয়ন একটি প্রাচীন এলাকা। বর্তমানে এই ইউনিয়নের জোড়খাল এলাকা মেঘনা নদীর ভাঙ্গনে তীব্র আকার ধারণ করেছে। ইতিমধ্যে শতাধিক বাড়িঘর,ব্যবসাপ্রতিষ্ঠিান,মাছঘাট ভাঙ্গনের মুখে পড়ে সড়িয়ে নিয়েছে। মেঘনার ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধ,৬ টি বাজার ,২৫ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ১০ হাজার পরিবার ও কয়েক হেক্টর ফসলি জমি।
এই ইউনিয়টিকে রক্ষা করতে জিও ব্যাগ ও সিসি ব্লক দ্বারা স্থায়ী ভাবে বাঁধা নির্মামের মাধ্যমে ভাঙ্গন মুক্ত করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহন করার দাবি জানান তিনি।
এদিকে ভাঙ্গন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক তৌফিক ই লাহী চৌধুরী, ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক মো বাবুল আকতার, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মিজানুর রহমান,নির্বাহী পপ্রকৌশলী মোঃ হাসানুজ্জামান সহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ অসহায় মানুষের পাশে রয়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
জেলা প্রশাসক মো: তৌফিক-ই-লাহী চৌধুরী বলেন, আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ড একসাথে মিলে এই জোড়খাল এলাকার মেঘনা নদীর ভাঙ্গন রোধে কাজ করছি। ইতিমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে জিও টিউব ফেলা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক মনিটরিং করা হচ্ছে যেন ভাঙ্গন রোধে দ্রুত কাজ বাস্তবায়ন করা হয়। এছাড়াও যেসব পরিবার নদী ভাঙ্গনের স্বীকার হয়েছে তাদের খাবার সহায়তা সহ পূর্নবাসনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা) ডক্টর.মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, রাজাপুর এর জোড়খাল এই এলাকাটি হচ্ছে মেঘনা-তেতুঁলিয়া নদীর মোহনা। তার সাথে যুক্ত হয়েছে উজান থেকে নেমে আসা পানি। তার জন্য এই স্পটটিতে নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে আমরা রাজাপুর এলাকা ভাঙ্গন রোধে বাংলাদেশ সরকারের ৩৪২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। ইতিমধ্যে রাজাপুর জোড়খাল এলাকার ভাঙ্গন রোধ সহ বেশ কয়েকটি ভাঙ্গন এলাকার জন্য ১৩ শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে সেই প্রকল্পটি প্রক্রিয়াধীন আছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে রাজাপুর এলাকাকে নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে টেকসই ভাবে রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে জানান। ইতিমধ্যে ভাঙ্গন রোধে প্রাথমিক ভাবে জিও টিউব দিচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভাঙ্গন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ