Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

লৌহজংয়ে নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম

লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২২ আগস্ট, ২০২১, ২:৪৪ পিএম

মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় ইছামতি নদীর (ডহরি-তালতলা খাল) তীরবর্তী এলাকায় নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। অনিয়ন্ত্রীত বাল্কহেড চলাচল উত্তাল ঢেউ আর প্রবল স্রোতের কারণে ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে নদীর তীরবর্তী ঘেঁষা বাজার মসজিদ মাদ্রাসা সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ আশ্রয়ণ প্রকল্প। আশপাশের গ্রাম ও বসতভিটা। গত ১ সপ্তাহে পশ্চিম নওপাড়া গ্রামের ১০টি পারবারের জমি বসত-ঘর নদীতে বিলীন হয়েছে। উপজেলার নদী-তীরবর্তী গ্রামের শত শত পরিবার নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন বলে জানা গেছে।
জানা যায়, ধলেশ্বরী নদীর তালতলা দিয়ে এই খালটি লৌহজংয়ের ডহরি দিয়ে পদ্মায় গিয়ে মিলিত হয়েছে। ইছামতী নদীর শাখা নদী হিসেবে পরিচিত (ডহরি-তালতলা খাল) ভাঙনে উপজেলার নদী পাড়ের ইউনিয়নগুলোর বেশিরভাগ এলাকা নদী ভাঙনের কবলে পরেছে। হুমকির মুখে রয়েছে কলমা ও গাঁওদিয়া ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে বসত-ঘর বাজার মাদ্রাসা সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আশ্রয়ণ প্রকল্প।
খালের দুইপাড় ভাঙন দেখা দেয়ায় পশ্চিম নওপাড়া গ্রামের অর্ধেক অংশ এখন নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙনরোধে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে ভাঙন আরও বড় আকার ধারণ করার আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। তীব্র ভাঙনে বসতবাড়ি বিলিন হয়ে গেলেও জনপ্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় সংশ্লিষ্টদের প্রতি হতাশ ও ক্ষুব্ধ এলাকার ভাঙন কবলিতরা।
গ্রামবাসী জানায়, অনিয়ন্ত্রীত ভাবে চলাচল কারি বালুর বাল্কহেড বন্ধের পাশাপাশি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা না হলে তীরবর্তী গ্রামগুলো বিলীন হয়ে যাবে। এমনিতেই করোনা আতঙ্কের মধ্যে দিনযাপন করছে মানুষ। এর মধ্যে নদী ভাঙ্গন নামের আরেক আতঙ্ক যুক্ত হওয়ায় পরিস্থিতি মোকাবেলায় নদীর পাড়ের খেটে খাওয়া মানুষের ঘুম নেই চোখে।
পশ্চিম নওপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আল-আমিন (অরুন ফকির) জানান, কয়েক বছর ধরে এখানে নদীভাঙন চলছে। এই নদীতে তাদের ৪ একর জমি বিলীন হয়েছে। তাদের অবশিষ্ট বসতবাড়ীতে ও ভাঙ্গন অব্যাহত রয়েছে। সরকারের পক্ষথেকে স্থায়ী বাঁধের ব্যাবস্থা না নিলে তাদের বসত-ভিটা শেষ অংশটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তিনি আরোও জানান এ গ্রামটির চার ভাগের তিন ভাগ অংশ ইতিমধ্যে বিলীন হয়ে হয়ে গেছে। তার বাড়ির নদীর অপরপ্রান্তে অল্প কয়দিন আগে হাড়িদিয়া আশ্রায়ণ প্রকল্পটির বাউন্ডারিতে ভাঙন দেখা দিলে সাথে সাথে জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন রোধ করা হয়। এবং শামুরবাড়ী ও ডহরির কিছু অংশে জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদেরও এই সুবিধা পাওয়ার অধিকার আছে। তিনি সরকার,স্থানিয় সংসদ ও সংশ্লিষ্টদে নিকট তাদের ভিটাবাড়ীর শেষ অংশ ও গ্রামটিকে রক্ষার জন্য এখানে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান।
নদীর তীরের বাসিন্দা সলিম মোল্লা জানান তার বাড়িটি সাড়ে তিন শতাংশ জমি ছিলো। নদীতে তার আড়াই শতাংশ বসতবাড়ী বিলীন হয়ে গেছে। এখন এক শতাংশের মত আছে। তার দুইটি ঘরে তাদের সাতজন সদস্য বসবাস করে। তিনি এই নদীতে মাঝির কাজ করেন। বাল্কহেডর ঢেউয়ে প্রতিদিনই তার বসতভিটা ভাঙছে।
পশ্চিম নওপাড়া গ্রামের নদীর তীরের বাসিন্দা জসীম মোল্লা জানান,এই নদী ভাঙনে তিনি বাড়ির ২০ শতাংশ জমি হারিয়েছেন। প্রতিবছর তার ২ শতাংশর মত জমি এই নদীতে ভাঙছে। বর্তমানে মাথা গোঁজার শেষ অংশ জমিটিও রয়েছে ভাঙনে মুখে। এটি বিলীন হয়ে গেলে পরিবার সন্তানদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকতে হবে তাকে। তিনি আরোও জানান বর্ষা নদীতে প্রচুর স্রোত থাকে এ মৌসুমে বালুর বাল্কহেড এই নদী দিয়ে বেপরোয়া চলাচলের কারনে নদী ভাঙন বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বাল্কহেড যখন যায় তখন প্রচুর ঢেউ ও স্রোত সৃষ্টি হয় তখন নিচ থেকে মাটি ছিরে নিয়ে যায়। সরকারের পক্ষথেকে ব্যাবস্থা না নিলে তার সর্বশেষ অবশিষ্ট বসতবাড়ী নদীর গর্ভে বিলিন হয়ে যাবে বলে জানান। পশ্চিম নওপাড়া গ্রামের আরেক বাসিন্দা শহিদুল্লাহ জানান,গত দুইদিন আগে আমাদের একটি ঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। বাকি অর্ধেক বাড়ি নদীতে গিলতে বসেছে সেই চিন্তায় পরিবারের লোকজন নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে ভাঙন আতঙ্কে। অব্যাহত নদী ভাঙনে ভিটে-মাটি, গাছপালা ও ফসলি জমি হারিয়ে সর্বশান্ত হয়ে যাচ্ছে এ এলাকার মানুষ। স্থানীয় কলমা ইউপি সদস্য ৭নং ওয়ার্ড মেম্বার ও নওপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. রুহুল আমিন বেপারী জানান, ডহরির উত্তর পাশ থেকে পশ্চিম নওপাড়া গুদার ঘাট পর্যন্ত প্রতি বছর কমবেশি নদীতে ভাঙছে। তবে পশ্চিম নওপাড়া গ্রামেটি বেশি ভাঙতেছে, ইতিমধ্যে অনেক বাড়ি-ঘর স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। যাদের পেছনে জমি আছে তারা ঘর গুলো সরিয়ে সাইডে নিচ্ছে ,যাদের জমি নেই তারা অন্যত্র চলে যাচ্ছে। দ্রুত ভাঙন ঠেকাতে না পারলে এ গ্রামটি বাড়ী-ঘর স্থাপনা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
হাড়িদিয়া গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম শিকদার জানান,বর্ষায় নদীর তীব্র স্রোত ও নিয়ন্ত্রনহীন বাল্কহেড চলাচলে কারনে তার ভিটাবাড়ী অর্ধের অংশ বিলীন হয়ে গেছে। বাকি অংশটিও নদীতে গিলে খাচ্ছে। তার বাড়ির পাশের বড়মোকাম বাজার ও মসজিদটি এখন নদীর মুখে রয়েছে। তিনি আরোও জানান হাড়িদিয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পটির পাশে নদীর পাড় ঘেঁষে বাল্কহেড থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে বালু আনলোড করে বালু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মহল। তাই নদীর পাড় ঘেঁষে সারিবদ্ধ করে রাখা হয় বালি ভর্তি একাধিক বাল্কহেড। এতে নদীর তীরে প্রবল স্রোতের সৃষ্টি হয় আর এই স্রোতের কারনে নদীর পাড় ভাঙন দেখা দিয়েছে। তিনি একাধিকবার বালুর বস্তা দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা করলেও বাল্কহেডের ধাক্কায় বস্তা সরে যাচ্ছে। এব্যপারে প্রতিবাদ করায় ড্রেজার ব্যাবসায়ী চক্রের দারা একাধিকবার হুমকির ও নির্যাতন শিকার হয়েছেন বলে নজরুল ইসলাম শিকদার জানান।
কলমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মোতালেব শেখ জানান, এলাকাটি ইছামতি (ডহরি-তালতলা) নদীর ভাঙনে পশ্চিম নওপাড়া গ্রামটি ক্ষতিগ্রস্ত। ভাঙন রোধে সরকারের কাছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বরাবর আবেদন করছি অথচ কোন কাজই করছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড। আপাতত এখানে অস্থায়ী বাঁধ দিতে না পারলে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে গ্রামটির।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয় বোর্ডের ঢাকা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী জানান, মুন্সীগঞ্জে বিভিন্ন যায়গায় নদীর পাড় কমবেশি ভাঙন রয়েছে,সব গুলো যায়গায় ভাঙন রোধ সম্ভব নয়,তবে ইতিমধ্যে বেশকিছু যায়গায় ভাঙ্গন রোধে ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে, যেখানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে যেমন স্কুল মসজিদ মাদ্রাসা মন্দির বাজার সেখানে জরুরী ভাঙ্গন রোধে ব্যাবস্থা নেয়া হচ্ছে। এদিকে লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল আওয়াল জানান, আমি অল্প কিছুদিন হয় লৌহজংয়ে এসেছি এ ভাঙনের বিষয়ে আমার যানা ছিলনা,বিষয়টি খোঁজ নিয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভাঙ্গন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ