Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রকৌশলী ঘুষ নিয়ে এমপিকে ম্যানেজের চেষ্টা

ধরলা-তিস্তা ভাঙন রোধ প্রকল্পে দুর্নীতি ভাঙনে বিলীন হচ্ছে মসজিদ-মাদরাসা-স্কুল ও ফসলি জমি

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১৪ আগস্ট, ২০২১, ১২:০১ এএম

ধরলা-তিস্তা নদী ভেঙে প্রতিদিনই শত শত মানুষ বাড়ি ঘর-স্কুল-কলেজ, মসজিদ ও মাদরাসা বিলীন হচ্ছে। প্রধান প্রকৌশলী (পুর), উত্তরাঞ্চল রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী কর্মকর্তারা ঢাকা বিনোদন ভ্রমণে ব্যস্ত। নদীর ভাঙনের ফলে হাজার হাজার মানুষের বাড়ি-ঘর তলিয়ে গেলেও কর্মকর্তাদের দেখা মিলছে না। আপোদকালীন সরকারি সহায়তাও জুটছে না। আবার যেখানে জিওব্যাগ ফেলে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, সেখানে বস্তা ফেলছে না পাউবো। জিওব্যাগ যেখানে ফেলা হচ্ছে। তার ৫০ গজ দূরে থেকে ড্রেজিং করে নিয়মবহিভর্‚তভাবে বালু তোলা হচ্ছে। রৌমারী-রাজিবপুরে জন্য ৪৭৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং চিলমারী ও উলিপুরে জন্য ৩০২ কোটি ১০ লাখ টাকা এবং কুড়িগ্রাম সদরে শহরক্ষা প্রকল্পের জন্য ৫৯৫ কোটি ৩০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে কুড়িগ্রাম জেলার ১৯ কোটি ৬২ কোটি টাকার কাজ চলমান রয়েছে। ঠিকাদার নিয়োগে পাওয়া গেছে বড় অনিয়মের অভিযোগ। মোটা অঙ্কের অর্থ লুটপাটের জন্য সরকারের নকশা অনুযায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে না এমন অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় এমপি মো. পনির উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ধরলা নদী ভাঙন রোধে প্রধানমন্ত্রী ৫৯৫ কোটি টাকার বরাদ্দ দিয়েছেন। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী দরপত্র আহ্বান করেন। ঘুষ নিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলীর পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ায় তিস্তা-ধরলা নদীর তীররক্ষা প্রকল্পের অগ্রগতি নেই। কোনো কাজ হচ্ছে না। এমনকি তাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকেও পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো তারা আমাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী, মন্ত্রণালয়ের সচিবকেও লিখিতভাবে জানিয়েছি।
প্রধান প্রকৌশলী (পুর), উত্তরাঞ্চল, রংপুর বিভাগের কর্মকর্তা জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ ফোনে ইনকিলাবকে বলেন. একনেকে প্রকল্প পাস করার কাজে আমি ঢাকায় অফিস করছি। মাঠে আমাদের সকল কর্মকর্তারা আছেন। এই বলে ফোন কেটে দেন।
কুড়িগ্রামের তিস্তা ও ধরলা পাড়ের মানুষের কান্না যেন কিছুতেই থামছে না। প্রতিনিয়ত ভাঙনের শিকার মানুষ ভিটেবাড়ি হারিয়ে নিমেষেই অসহায় হয়ে পড়ছে। কৃষিনির্ভর নদী তীরবর্তী মানুষের দুঃখ কেউ বুঝতে চায় না। গত কোরবানির ঈদের পর জেলার রাজারহাট উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। নিঃস্ব হয়েছে হাজারো মানুষ। অসহায় এসব মানুষের দুঃখ-কষ্টের ভাগীদার হতে চায় না কেউ। মাত্র কয়েক দিনে বগুড়াপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মন্ডলপাড়া স্কুলসহ কয়েকটি মসজিদ বিলীন হয়ে গেছে। আবার তিস্তার ভাঙন রোধে কেউ আবেদন নিয়ে গেলেই কুড়িগ্রাম জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিকুল ইসলাম ভুক্তভোগিদের বলেন, তিস্তা ভাঙন রোধে মেঘা প্রকল্প নিয়েছে সরকার। এখন যদি তিস্তায় নদীতে সব বিলীন হলেও আমাদের করার কিছু নেই। বড় প্রকল্পটি পাস হলে সব কিছু হবে। তিনি আরো বলেন, আপনারা জানেন, একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয় থেকে পাস করতে হলে সব জায়গায় টাকা দিয়ে করতে হয়। এসব টাকা কে দিবে। ধরলা নদীভাঙন রোধে সরকারের পক্ষ থেকে ৫৯৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হলেও সেটি বাস্তবায়নে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগী ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, ভাঙন রোধে সময় মতো কাজ শুরু না করা এবং প্রকল্প ঘিরে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কয়েকজন কর্মকর্তার অনিয়মের কারণেই ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না শিকস্তির শিকার মানুষের।
রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙা ইউনিয়নের নদী-সংলগ্ন কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ভাঙনে মানুষের অসহায়ত্ব এবং নদীর পাড় রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র দেখা যায়। কোরবানির ঈদের পরই ভাঙনে বিলীন হয়েছে বেশ কয়েকটি গ্রাম, নিঃস্ব হয়ে পড়েছে হাজারেরও বেশি বাসিন্দা। নদী ভাঙনের ফলে ভেঙে যাওয়া ঘর-বাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিতে দেখা গেছে কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দাদের। কুড়িগ্রাম সদরের সিএনবি ঘাট, সেনের খামার (নিধিরাম) ধরলার ভাঙনে ভেঙে যাচ্ছে মোগলবার এলাকার কুড়িগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধ। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, নদীভাঙনের ফলে তাদের বাড়ি-ঘর তলিয়ে গেলেও কর্মকর্তাদের দেখা মিলছে না। যেভাবে কিংবা যেখানে জিওব্যাগ ফেলে নদীর ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, সেখানে বস্তা ফেলছে না পাউবো। মোটা অঙ্কের অর্থ লুটপাটের জন্য সরকারের নকশা অনুযায়ী বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়নি।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর, রাজারহাট চিলমারী উপজেলার তিস্তা নদীর পাড়ের গ্রামগুলো চোখের পলখে ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এর মধ্যে উলিপুর উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের দড়িকিশোরপুর, কিশোরপুর, গোড়াইপিয়ার, হোকডাঙ্গা, রাজাহাটের পূর্বপাড়ের ভাঙনে গতিয়াসাম, মন্ডলপাড়া, নাখেন্দা, খিতাবখাঁ, বাবুর বাজারসহ কয়েকটি গ্রামের বিলীন হয়ে গেছে এখন এ গ্রামগুলোর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এসব গ্রামের কৃষক, জেলে, শ্রমজীবী কয়েকশ’ পরিবার একাধিকবার ভাঙনের শিকার হওয়ায় মানবেতর-জীবনযাপন করছেন। বিলীন হওয়া বগুড়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সভাপতি আজহার আলী মন্ডল ইনকিলাবকে বলেন, কোরবানির ঈদের নামাজ পড়তে পারিনি। তিস্তার ভাঙনে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় তার বসতভিটা এবং আরও তিন শতাধিক ঘর-বাড়ি। এখন যাদের ঘর-বাড়ি অবশিষ্ট আছে, তারা আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারেন না। শুধু স্কুলটি রক্ষা করতে পাউবো থেকে কিছু জিওব্যাগ ফেলা হলেও অন্য সময় তাদের খোঁজ থাকে না। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বারবার যোগাযোগ করা হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো সাড়া মেলে না। কুড়িগ্রাম সদরের সিএনবি ঘাট এলাকায় দেখা যায়, ধরলা নদীর মাঝখান চর জেগে উঠেছে অথচ নদীরপাড় থেকে ড্রেজিং করা হচ্ছে। পাশেই বালুভর্তি জিওব্যাগ রাখা হয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুসারে নদীর মাঝ থেকে বালু উত্তোলনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু জেলা পাউবো কর্মকর্তার তা মানছেন না। ওই এলাকার বাসিন্দা আবদুর রহমান বলেন, ভাঙনের প্রকোপে ছোটবেলা থেকে নদীর দুইপাড়ে পাঁচবার ঘর বানিয়েছি। যে ক‚লেই যাই, ভাঙন পিছু ছাড়ে না। এবারও ভাঙনে ঘরবাড়ি হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাড়ির পাশে কয়েকশ’ জিওব্যাগ জমা রাখা হলেও ভাঙন রোধে আমার ঘরের পাশে কোনো ব্যাগ ফেলা হচ্ছে না। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, যে জায়গাগুলোতে জিওব্যাগ ফেললে ভাঙন রোধ করা যাবে, সেখানে ফেলা হচ্ছে না। ফলে বিলীন হতে চলেছে সিএনবি ঘাট এলাকা। মোগলবাসা ইউনিয়নের সেনেরখামার এলাকায় ধরলা নদীর বাঁধ ভেঙে গ্রামের ভেতর ঢুকে গেছে। এতে বর্ষা মৌসুমে বন্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বেশ কয়েকটি গ্রামকে। বাঁধ নির্মাণে প্রকল্পের বরাদ্দ থাকলেও তার কাজ শুরু হচ্ছে না। সেনেরখামার এলাকার বাসিন্দা হাসনা বেগম বলেন, নদী যেহেতু ভেঙে গ্রামের মাঝ দিয়ে ঢুকেছে, তাই সোজাসুজি বাঁধ নির্মাণ করলে পুরো গ্রাম রক্ষা হবে। কিন্তু খরচ কমাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা চাইছেন তীর দিয়ে মাটি ফেলতে।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম জেলা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, আপনি জানেন এর আগে কুড়িগ্রাম জেলায় কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ ছিল না। আমি ২০১৯ সালের আসার পরে এ এলাকায় প্রকল্পগুলো তৈরি করে মন্ত্রণালয় পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় থেকে পাস করেছে। তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার কুড়িগ্রামের দুধকুমার নদী ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য ৬৯২ কোটি ৬৮ লাখ টাকা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) এ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর জন্য আমরা কয়েকজন ঢাকা ছিলাম। আপনারা এলাকার উন্নয়ন চাইলে এ খবরগুলো বন্ধ করেন। আমার জেলার প্রকল্পগুলোর কাজ ৭৫% হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দুর্নীতি

১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
৩১ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ