পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
এবারও বঞ্ছিত হলো গরিব-দুঃখী, ফকির-মিছকিন, কওমী মাদরাসার লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের শিক্ষার্থীরা
কোরবানির পশুর চামড়ার টাকার প্রকৃত হকদার গরিব-দুঃখী মানুষ, ফকির-মিছকিন, সুবিধা বঞ্ছিত পরিবারের সদস্য কওমী মাদরাসা পড়–য়া শিক্ষার্থী, লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের শিক্ষার্থীরা। এতিম এবং লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের বছরের থাকা খাওয়ার বড় একটা অর্থ আসে কোরবানির পশুর চামড়া থেকে। আল্লাহর নামে যারা কোরবানি দেন, তারা চামড়া স্থানীয় মাদসারা ও ফকির-মিছকিনকে দান করেন। এই রেওয়াজ চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে মিছকিনের হক চামড়ার টাকার উপর সংশ্লিষ্ট কিছু ব্যবসায়ীর লোলুপ দৃষ্টি পড়ে। ফলে তারা সিন্ডিকেট করে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়ে নিজেরা শত শত কোটি টাকা আয় করছেন। এবারও সেটাই সিন্ডিকেটের পেটে যাচ্ছে চামড়ার টাকা।
চামড়া ব্যবসায়ী, আড়তদার, ট্যানারি মালিকরা সিন্ডিকেট করে কয়েক বছর ধরে কোরবানির সময় পরিকল্পিতভাবে চামড়ার দাম কমিয়ে দিয়ে পরে ওই টাকা নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে খাচ্ছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাও এই সুযোগ করে দিয়ে নিজেরা লাভবান হচ্ছেন। প্রতিবছর কোরবানির সময় ট্যানারি মালিকরা ব্যাংক টাকা দেয়নি অজুহাত দেখিয়ে চামড়ার দাম কমিয়ে দেন। এবার চামড়ার দাম যাতে পাওয়া যায়, সে লক্ষ্যে দাম বেঁধে দেয়ার পাশাপাশি কাঁচা চামড়া বিদেশে রফতানি করার জন্য ৫টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দেয়া হয়। আবার চামড়া কিনতে ব্যবসায়ীদের ৫৮৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় চার রাষ্ট্রায়ত্তসহ ৯ বাণিজ্যিক ব্যাংক। তারপরও কোরবানির চামড়ার দাম পায়নি মানুষ। পানির দামে চামড়া বিক্রি করতে হয়েছে। ফলে চামড়ার টাকা যাদের পাওয়ার কথা সেই গরিব, দুঃখী, এমিত শিক্ষার্থীরা পায়নি; টাকা পাচ্ছেন চামড়া ব্যবসায়ী, আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটের পকেটে। গরিবের টাকা ধনীদের পেটে যাওয়ার পরও সবাই নীরব হয়ে রয়েছেন।
সরকার চামড়ার দাম বেঁধে দেয়ার পরও এবার চাহিদা ও দাম না থাকায় কোরবানির চামড়া বিক্রি করেছেন ২শ’ থেকে ৫শ’ টাকায়। ফলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কোরবানির পশু চামড়ায় (২৫ বর্গফুট) লোকসান গুনছেন সর্বোচ্চ দুইশ’ থেকে আড়াইশ’ টাকা। এক হিসেবে দেখা গেছে, একই আকারের চামড়া আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানি করে ট্যানারি মালিকরা মুনাফা করছেন প্রায় ১৬শ’ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বর্গফুটে সব খরচ বাদ দিয়ে আয় করছেন ৬৪ টাকা। আর যে আড়তদার ট্যানারি মালিকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন চামড়া তার পকেটে যাচ্ছে আরো দেড়শ’ থেকে ২শ’ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বর্গফুটে আড়তদারের লাভ হচ্ছে ৮ টাকা।
পাইকারদের চামড়া ক্রয় ও প্রক্রিয়াকরণ, ট্যানারির মালিকদের ক্রয় ও মূল্য সংযোজন, জাহাজীকরণসহ অন্যান্য ব্যয় হিসাব-নিকাশ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ), বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট (বিএফটিআই) থেকে এ আয়-ব্যয়ের হিসাব নেওয়া হয়েছে।
রাজধানীর কয়েকটি মাদরাসার শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিবারের মতো এবারও তারা কম দামে চামড়া সংগ্রহ করেছেন। আবার অনেকেই এমনিতেই চামড়া দিয়েছেন। কিন্তু বিক্রি করতে গিয়ে হতাশ হয়েছেন। চামড়ার দাম পাননি। এমনিতেই করোনা মহামারিকে মাদরাসা বন্ধ; পরবর্তীতে মাদরাসা খোলা হলে লিল্লাহ বোর্ডিং এর শিক্ষার্থীদের আর্থিক কষ্টে পড়তে হবে।
জানা গেছে, ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া কিনতে ব্যবসায়ীদের ৫৮৩ কোটি টাকার তহবিলের জোগান হিসেবে ঋণ দেয় ৪ রাষ্ট্রায়ত্তসহ ৯ বাণিজ্যিক ব্যাংক। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রেখেছে রূপালী ব্যাংক ২২৭ কোটি টাকা। এ ছাড়াও জনতা ব্যাংক ১৪০ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংক ১২০ কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংক ২৫ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে চামড়া কিনতে বেশি রেখেছে ইসলামী ব্যাংক ৬৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। কিন্তু সরকার বেঁধে দেয়া দামে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা চামড়া কেনেনি। ফলে প্রতিবছরের মতো এবারও কোরবানির পশুর চামড়া পানির দামে বিক্রি করা হয়। একমাত্র সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুর রহমান নিজস্ব উদ্যোগে চামড়া ক্রয় করায় সেখানের মানুষ কিছুটা হলেও দাম পায়।
এর আগে ১৯ জুলাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কোরবানির চামড়ার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে তিনটি কমিটি গঠন করে। কোরবানির চামড়া যথাযথভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য ক্রেতা ও বিক্রেতা পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টিসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এই কমিটি করা হয়। কমিটিগুলো পর্যায়ক্রমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগীয় কমিশনারের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। সিটি করপোরেশন এলাকায় সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সভাপতি ও সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের সচিব কমিটির সদস্য সচিব করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন বিভাগীয় কমিশনারের প্রতিনিধি, ডিআইজি সংশ্লিষ্ট রেঞ্জের প্রতিনিধি, বিভাগীয় পরিচালকের (স্বাস্থ্য) প্রতিনিধি, বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার প্রতিনিধি, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক, বিসিক আঞ্চলিক কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালকের পক্ষে সংশ্লিষ্ট রেঞ্জের প্রতিনিধি, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের প্রতিনিধি ও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতির প্রতিনিধি।
জানা যায়, মোট দেশজ উৎপাদনের ১ দশমিক ১ শতাংশ অবদান রাখছে চামড়া শিল্প। বিশ্বের মোট চাহিদার দশমিক ৫ শতাংশ পূরণ করা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০২৫ সাল নাগাদ চামড়া শিল্পের একটি রোড ম্যাপ প্রণয়ন করেছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়Ñ এ খাত থেকে বছরে ৩৪৮ কোটি মার্কিন ডলার রফতানি আয় করা হবে। এ জন্য অতিরিক্ত বিনিয়োগের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে ৮ হাজার ৩শ’ কোটি মার্কিন ডলার। বর্তমান ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে রফতানি আয় হয়েছে ৯৪ কোটি মার্কিন ডলার।
জানা গেছে, প্রায় ২৭শ কোটি বর্গফুট চামড়া বিদেশে রফতানি হচ্ছে। এ খাতে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ১৭শ’ কোটি টাকা মুনাফা আসছে চামড়া শিল্পে। কিন্তু এর ৬০ শতাংশ চামড়া সরবরাহ করছেন কোরবানির ঈদের মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। যাদের অধিকাংশই লোকসান দিচ্ছেন। আর বাংলাদেশে এমন ঘটনা বছরের পর বছর ঘটে আসছে। এটি মনিটরিং বা পর্যবেক্ষণে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো নীরব ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্যমতে, সবচেয়ে বড় কোরবানির পশুর চামড়া (২৫ বর্গফুট আকারের) এ বছর কেনা হয়েছে মাত্র ৫শ’ টাকায়। এরসঙ্গে আড়তেই ৭২ শতাংশ অর্থাৎ ৩৬০ টাকা মূল্য সংযোজন হচ্ছে। সেটি হলো একটি চামড়ায় লবণ মেশানোয় ব্যয় ৩শ’ টাকা। এরমধ্যে ২৫০ টাকার লবণ এবং ৫০ টাকা মজুরি। এছাড়া আড়ত চার্জ ৩৫ টাকা, দাসনদার ১০ টাকা, চামড়া পরিবহন থেকে নামানো এবং উঠানো (লোড-আনলোড) মজুরি ১৫ টাকা। এসব ব্যয় যোগ হয়ে চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় ৮৬০ টাকা। এর সঙ্গে প্রতি পিস চামড়ায় ২০০ টাকা যোগ করে আড়তদারের বিক্রয় মূল্য দাঁড়ায় ১০৬০ টাকা। এক্ষেত্রে আড়তদারের প্রতি ফুট চামড়ায় মুনাফা হচ্ছে ৮ টাকা।
বিএফটিআই চামড়া শিল্পে ওপর একটি গবেষণা করেছে। সেখানে দেখানো হয়, একটি ট্যানারিতে চামড়ায় কেমিক্যাল, শ্রমিক, ট্যানারি ভাড়াসহ অন্যান্য খাতে ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় যোগ হচ্ছে। এ ৪৮ শতাংশ মূল্য সংযোগের পরে আড়তদার থেকে ১০৬০ টাকার কেনা চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৬৯ টাকা। পরবর্তী ধাপে জাহাজীকরণসহ অন্যান্য খাতে আরও ১৫ শতাংশ অর্থাৎ ২৩৫ টাকা ব্যয় রয়েছে। এটি যুক্ত হওয়ার পর ২৫ ফুট আকারের চামড়ার মূল্য দাঁড়ায় ১ হাজার ৮০৪ টাকা। বিটিএর তথ্যমতে, বিশ্ববাজারে প্রতি বর্গফুট চামড়ার রফতানির মূল্য হচ্ছে ১ দশমিক ৬০ সেন্ট (১৩৫ টাকা)। সে হিসাবে ২৫ বর্গফুট আকারের চামড়ার রফতানি মূল্য দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪শ’ টাকা। এ রফতানি মূল্য থেকে সবধরনের প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যয়সহ ট্যানারি চামড়ার ক্রয় মূল্য বাদ দিলে একটি চামড়ায় মুনাফা আসছে ১ হাজার ৫৯৬ টাকা। অর্থাৎ একজন ট্যানারি মালিকের প্রতি বর্গফুট চামড়ায় মুনাফা দাঁড়াচ্ছে প্রায় ৬৪ টাকা।
সাংবাদিকরা জানতে চাইলে বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান বলেন, প্রতিটি চামড়ায় আড়তদারি প্রক্রিয়াগত ব্যয় আছে ৩৬০ টাকা। পাশাপাশি একটি চামড়া থেকে ১শ’ থেকে দেড়শ’ টাকা মুনাফা করতে না পারলে আড়তদাররা এত টাকা বিনিয়োগ করে টিকে থাকতে পারবে না। ফলে ওই হিসাবেই আমরা ট্যানারির মালিকদের কাছে চামড়া বিক্রি করব। ৫শ’ টাকায় একটি চামড়া কিনলেও সেটি প্রক্রিয়াজত করে মুনাফাসহ এক হাজার ৫০ টাকা থেকে ১১শ’ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।