পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ইতিহাস, ঐতিহ্য প্রাণ-প্রকৃতির অনুপম সমাহার সিআরবিতে রয়েছে হরেক প্রজাতির গাছ-গাছালি, বন্যপ্রাণি। চট্টগ্রাম নগরীর ফুসফুস হিসাবে পরিচিত ছায়া-সুশীতল সবুজ বন আর জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে সেখানে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের যে আয়োজন চলছে তাতে বিক্ষুব্ধ গোটা চট্টগ্রাম। সিআরবি সুরক্ষায় চলছে প্রতিবাদী নানা কর্মসূচি। প্রতিবাদকারীরা বলছেন, সিআরবির উপর ধনিক শ্রেণির লোভের চোখ পড়েছে। তাদের আগ্রাসী কালো থাবা থেকে সিআরবিকে রক্ষা করতেই হবে।
পূর্ব রেলের সদর দফতর সিআরবি এলাকায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) একটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ার পর থেকেই চলছে প্রতিবাদি সামাজিক আন্দোলন। এ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের মন্ত্রী, এমপি নেতারাও সিআরবি সুরক্ষায় ভূমিকা রাখার কথা বলছেন। সিআরবি সুরক্ষার আন্দোলন এখন চট্টগ্রামের গণমানুষের আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। সিআরবিসহ মাঠ ময়দান ছাড়িয়ে আন্দোলন বিস্তৃত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
অবিভক্ত ভারতের আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের সদর দপ্তর সিআরবি ভবনটি হয় ১৮৯৫ সালে। শতবর্ষী বৃক্ষ, পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা ঘেরা এ এলাকাটি জনসমাগমের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে নানা বয়সের মানুষের ঘুরে বেড়ানো এবং সেই সাথে খেলা-ধুলা আর সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মিলন মেলা সিআরবি। আশেপাশের পাহাড়ে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণির আবাস। সেখানে রয়েছে হাতির (কাঠের) বাংলোসহ রেলওয়ে কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকটি বাংলো। আছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার, রেলওয়ে পুলিশ সুপারের বাসভবনসহ বশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক স্থাপনা।
বাটালি হিলের অংশ এই পাহাড়, টিলা আর উপত্যকা সমৃদ্ধ সিআরবি এলাকায় বৈশাখের কৃষ্ণচূড়া, বর্ষার কদম আর হেমন্তে ছাতিম দেখা যায়। কংক্রিটের অরণ্যের মাঝে নানা ঋতুর ফুলে বর্ণ আর গন্ধে ডুবে থাকা একখণ্ড সবুজ বনানী সিআরবি বিচিত্র বৃক্ষ সম্ভারে শতবর্ষী রেইন ট্রি আর শিরীষের সাথে আছে জারুল, নিম, সেগুন, পিটালি, ডুমুর, কড়ই, পাকুর, আম-জামও।
সড়কের দুপাশে পাহাড়, টিলা আর উপত্যকা মিলিয়ে সবুজের এক বিচিত্র সম্ভার। এর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষী শিরীষ গাছ। যার তলায় প্রতি বছর হয় বর্ষবরণের বর্ণিল আয়োজন। সিআরবি এলাকায় ১৯৭ প্রজাতির উদ্ভিদের সন্ধান মিলেছে, যার মধ্যে ১৫৪টি ঔষধি। বিপন্ন প্রায় ৯টি প্রজাতির গাছও আছে সেখানে। ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান অপিনিয়নের (ইকো) উদ্যাগে পরিচালিত এক গবেষণায় পাওয়া গেছে এসব প্রজাতির তথ্য। সেখানে আছে ৩৮ প্রজাতির প্রাণি। ছায়া-সুশীতল সিআরবি যেন এই নগরীর প্রাণ প্রবাহ। আন্দোলনকারীরা বলছেন, সিআরবিতে বাণিজ্যিক স্থাপনা হলে এসব উদ্ভিদ, প্রাণি ছাড়াও জীববৈচিত্র্য বিরাণ হয়ে যাবে।
হাসপাতাল নির্মাণের ওই প্রকল্প বাস্তায়িত হলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সিআরবি তার ঐতিহ্য হারাবে বলেও মনে করছেন সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, সিআরবি এলাকায় আছে বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর। ওই এলাকায় ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহীরা অর্থসংগ্রহের জন্যে অভিযান চালিয়েছিল। এছাড়া সিআরবি ভবনটি দেশের ব্রিটিশ বা কলোনিয়াল স্থাপত্যের বিলীয়মান নিদর্শনের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপত্যকলা। ইতিহাসের ছাত্র-শিক্ষকের শিক্ষা ও গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ওই ভবনটি।
প্রাকৃতিক কারণে সংবেদনশীল ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের স্থানে বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। নগরীর লাখো মানুষের উন্মুক্ত প্রাকৃতিক পরিসর এবং চট্টগ্রামের ইতিহাসের অংশ সিআরবিতে শতবর্ষী গাছ ও প্রকৃতি ধ্বংস করে কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণের প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ। চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিক, বিভিন্ন পরিবেশবাদী-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক নেতারা সিআরবিতে হাসপাতাল স্থাপন না করার দাবি জানিয়েছেন।
সিআরবিতে রেলওয়ে হাসপাতাল, পাশের খালি জমি, রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনি রোড এবং এই রাস্তাটির দুপাশে থাকা প্রায় ৫০টি কর্মচারী কোয়ার্টার নিয়ে মোট ছয় একর জমিতে হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিগত ২০১৩ সালের ১৪ আগস্ট অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) সভায় প্রকল্পটি পিপিপিতে বাস্তবায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। গত বছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পিপিপি প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় সিসিইএ সভায়। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি চুড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর একই বছরের ১৮ মার্চ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সাথে সঙ্গে চুক্তি করে রেলওয়ে। সম্প্রতি নির্ধারিত জমির সামনে প্রকল্পের একটি সাইনবোর্ড লাগানো হয়। তখন থেকেই শুরু হয় সিআরবি সুরক্ষায় আন্দোলন।
এই প্রকল্পের পরিকল্পনা ও সহযোগী সংস্থা বাংলাদেশ সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্ব কর্তৃপক্ষ (পিপিপি)। কার্যনির্বাহী সংস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ে এবং বাস্তবায়ন ও পরিচালনা করবে ইউনাইটেড চট্টগ্রাম হাসপাতাল লিমিটেড। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ১২ বছর। প্রকল্পের আওতায় ১০০ আসনের একটি মেডিকেল কলেজ, ৫০ আসনের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং দুই ধাপে মোট ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে।
এতে প্রায় চারশ কোটি টাকা খরচ হবে। ৫০ বছর পর প্রকল্পের মালিকানা হবে রেলওয়ের। প্রকল্প পরিচালক ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (্িব্রজ) আহসান জাবির শুরু থেকেই বলে আসছেন এই প্রকল্পের জন্য গাছ কাটার প্রয়োজন পড়বে না। তবে রেলওয়ের এমন বক্তব্য প্রত্যাখান করছেন আন্দোলনকারীরা। তারা বলছেন সিআরবির মতো সংরক্ষিত এবং জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এলাকায় কোন স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ নেই। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্র্তৃপক্ষ-সিডিএ ঘোষণা দিয়েছে তারা সেখানে কোন হাসপাতাল নির্মাণের অনুমতি দেবে না। পাঁচটি পরিবেশবাদি সংগঠন রেল সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের আইনী নোটিস দিয়েছে।
হাসপাতাল চুক্তি বাতিল করুন : চট্টগ্রামের ১০১ বিশিষ্ট নাগরিক
সিআরবি এলাকায় হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণ প্রকল্প চুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামের ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিক। গতকাল শনিবার এক যুক্ত বিবৃতিতে তারা বলেন, সবুজ বন প্রকৃতি ঘেরা ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু সিআরবিতে এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণ একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। শতবর্ষী বৃক্ষরাজি পাহাড়, টিলা ও উপত্যকা ঘেরা এ এলাকাটি জনসমাগমের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এই ইট-পাথরের রুক্ষ-কঠিন শহরের উঁচু উঁচু দালান আর শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভিড়ে শতবর্ষী বৃক্ষে ঘেরা সিআরবিকে এক টুকরো অক্সিজেন প্ল্যান্ট বলা চলে। পাহাড়ের মাঝে প্রাকৃতিক শোভা মন্ডিত এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ করতে গেলে শতবর্ষী অনেক গাছ কাটা পড়ার পাশাপাশি এখানকার সবুজ নিসর্গ ধ্বংস হয়ে যাবে। হাসপাতাল নির্মাণের প্রস্তাবিত স্থানে রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আবদুর রবের কবর, যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এই মাটি শহীদের স্মৃতিধন্য। এই সিআরবিতে অনেকে শহীদ হয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। বলতে দ্বিধা নেই, সুশাসনকে কলঙ্কিত করার জন্য প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী আমলা এ সরকারি জায়গায় বেসরকারি হাসপাতাল প্রকল্পের দুঃসাহস দেখিয়েছে। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে আছেন চুয়েটের সাবেক ভিসি প্রফেসর ড. জাহাঙ্গীর আলম, বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন, পেশাজীবী নেতা প্রফেসর ডা. এ কিউ এম সিরাজুল ইসলাম, মুক্তিযোদ্ধা ও বিশিষ্ট আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুল, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক, চিটাগাং চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম, প্রফেসর ড. অনুপম সেন, কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান উপদেষ্টা খোরশেদ আলম সুজন, সাংস্কৃতিক সংগঠক মফিজুর রহমান, একুশে পদক প্রাপ্ত নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার প্রমুখ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।