পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মানব জাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)-এর মিলনের স্মৃতিবিজড়িত আরাফাতের ময়দানে ৬০ হাজারের বেশি হাজীর লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি ও পৃথিবী থেকে করোনা মহামারি তুলে নেওয়ার আকুতিতে গতকাল এবারের সীমিত পরিসরের পবিত্র হজ পালিত হয়েছে। গতকাল আরাফাতে অবস্থান করে হাজীরা তাদের জীবনের সব গুনাহের ক্ষমার জন্য আল্লাহ তা‘আলার কাছে কায়মনোবাক্যে মোনাজাত করছেন। এদিক সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের সীমানায় অবস্থান করেন তারা।
গতকাল দুপুরে যোহর ও আসর নামাজ এক আজান ও দুই ইকামাতে কসর করে আদায় করেন সম্মানিত হাজীরা। হজ খুতবায় সউদী আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য পবিত্র মক্কার মসজিদুল হারামের ইমাম ও খতীব শায়খ বান্দার বিন আবদুল আজিজ বালিলা মহামারি সম্পর্কে মহানবী (সা.) এর শিক্ষা অনুসরণ করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, নবী করিম (সা.) লোকদের এমন একটি জায়গায় না যাওয়ার জন্য বলেছিলেন যেখানে মহামারি রয়েছে।
করোনা মহামারির মধ্যে দ্বিতীয় দফা হজে আগত মুসল্লিদের উদ্দেশে শায়খ বান্দার বালিলা বলেন, ‘মহানবী (সা.) বলেছেন, মহামারি যে অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে সেখানকার লোকদের বাইরে যাওয়া উচিত নয় এবং অন্যান্য অঞ্চলের লোকদের উপদ্রুত এলাকায় না যাওয়া উচিত’।
খুতবায় শায়খ বান্দার মুসলমানদেরকে সমতা প্রতিষ্ঠা, একে অপরের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ দূর করার আহ্বান জানান। তিনি আল্লাহর দোহাই দিয়ে সবাইকে একে অপরকে ক্ষমা করতে বলেছেন। গ্র্যান্ড মসজিদের ইমাম বলেন যে, হজ হ’ল ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ এবং যারা হজে আসতে সক্ষম তাদের এটি সম্পন্ন করার জন্য স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা আহ্বান জানিয়েছেন।
শায়খ ড. বান্দার বালিলা বলেন, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, তোমরা আমি ছাড়া কারো ইবাদত করবে না এবং কাউকে শরিক মানবে না। নবীজি (সা.) বর্ণনা করেছেন, তোমরা পৃথিবীতে বসবাসকারীদের ওপরে দয়া করো, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ওপর দয়া করবেন। মুসলমানদের উচিত পরস্পরের মাঝে সৌহার্দ্য ও সদ্ভাব বজায় রাখা
খতিব বলেন, উম্মাতের পরস্পরের মাঝে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি সম্পর্ক বজায় রাখা উচিত। আল্লাহর রহমত থেকে সেই ব্যক্তিই নিরাশ হয় যে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। দয়াময় আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আমার রহমত আমার আজাবের ওপর প্রাধান্য পায়। নবীজি (সা.) বলেছেন, জান্নাতে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ ছাড়া কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।
শায়খ বালিলা আরো বলেন, হে মানব সম্প্রদায়, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের ন্যায় ও ইনসাফের নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামে মানবজাতির জন্য এমন বিধিবিধান রাখা হয়েছে, যার মাধ্যমে সমশ্রেণির মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। ইনসাফ ও ন্যায় বিচার ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এটি ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য। আমাদের আচার-আচরণ ও ব্যবহারে এ বিষয়টি ফুটিয়ে তুলতে হবে।
আল্লাহতায়ালা যেভাবে তোমার ওপর অনুগ্রহ করেছেন তেমনি তুমিও অন্যের ওপর অনুগ্রহ করো। আল্লাহ তা‘আলার রহমত অনুগ্রহকারীদের নিকটবর্তী থাকে সবসময়। আল্লাহ তা‘আলা পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ হলো পিতা-মাতার পরে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ভালো আচরণ করো।
রাসুল (সা.) বলেছেন, নিজের অধীনস্থদের সঙ্গে ভালো আচরণ করো। নিজের অধীনস্থ চাকর-বাকরদের তাদের শক্তি-সামর্থের ওপর বোঝা চাপিয়ে দেবে না। অন্যকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পুর্ণ করারও নির্দেশনা দিয়েছেন আল্লাহ।
খুতবায় তিনি আরো বলেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, তোমার জন্য কুরআনকে নাজিল করা হয়েছে যেন তুমি হেদায়েত পাও। আর আল্লাহ যাকে চান তাকে হেদায়েত দেন। নিজের আত্মশুদ্ধি কর এবং তাকওয়া অবলম্বন করো। নিজের রবের ইবাদত এমনভাবে করো যেন তিনি তোমাকে দেখছেন।
কাবার ইমাম খুতবায় আরো বলেন, আল্লাহ তা‘আলা জমিনে ফাসাদ সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে, আল্লাহ তা‘আলার রজ্জুকে শক্তভাবে ধরো এবং মতপার্থক্যে যেও না। পরস্পরের মাঝে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা সম্পর্ক তৈরি কর। বিদ্বেষ ও শত্রুতা খতম কর। পৃথিবীতে ভারসাম্য তৈরি করা। আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য একে অপরকে ক্ষমা কর।
কাবার ইমাম বলেন, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমারা নামাজ আদায় কর। নিজের মনকে হেফাজত কর। আল্লাহর ওয়াস্তে তোমার প্রতিশ্রুতি পূরণ কর। আল্লাহ বললেন, শয়তান আপনাকে বিপথগামী করার চেষ্টা করবে। রসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর রহমত ও অনুগ্রহ ব্যতীত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
কাবার ইমাম খুতবায় আরো বলেন, ইহসান হল আপনি আল্লাহর ইবাদত করেন যেন আপনি তাকে দেখছেন। যদি এটি সম্ভব না হয় তবে ভাববেন যে তিনি আপনাকে দেখছেন। আল্লাহ বলেন, কোন বান্দা যদি নিজের উপর অন্যায় করে তবে তার জন্য তওবা করার দরজা উন্মুক্ত রয়েছে।
হজের খুতবায় আরো বলা হয়, অহঙ্কারীদের আল্লাহ পছন্দ করেন না। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার বান্দাদের সাথে সদয় আচরণ করেন। আল্লাহ বলেছেন: আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি। তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, মহানবী হলেন সর্বশেষ নবী। তোমরা তোমাদের নামাজ কায়েম কর, নামাজের ব্যপারে যতœবান হও। আল্লাহ পরাক্রমশালী, তাকে ভয় করুন এবং তাকওয়া অবলম্বন করুন। নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা সব মানুষের সঙ্গেই রয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা কারো আমলকে বিনষ্ট করেন না।
গতকাল জাবালে রহমতের পাদদেশে আরাফাত ময়দানে মাস্ক পরিহিত হাজী তাদের জীবনে কৃত পাপের ক্ষমার জন্য জমায়েত হন এবং তারা শান্তি ও করোনামুক্ত একটি পৃথিবীর জন্য প্রার্থনা করেন। সউদী আরবের মক্কা এবং মদীনায় ইসলামের পবিত্রতম স্থানগুলোয় বিদেশ থেকে আসা যিয়ারতকারীদের জন্য দ্বিতীয় বছরের মত নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে এবং করোনাভাইরাস ও এর নতুন নতুন রূপ থেকে রক্ষার জন্য সউদী আরবে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মাত্র ৬০ হাজার সউদী নাগরিক এবং বিভিন্ন দেশের বাসিন্দা, যারা সম্পূর্ণরূপে টিকা নিয়েছেন বা করোনা থেকে সেরে উঠেছেন এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগেন না, তাদের এ বছর হজের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
ফিলিস্তিনের হজযাত্রী উম আহমেদ বলেন, ‘এটি একটি অবর্ণনীয় অনুভূতি যে, আমি কয়েক হাজার লোকের মধ্যে হজে যোগদানের জন্য নির্বাচিত হয়েছি। সমগ্র বিশ্বের করোনাভাইরাসের মধ্য দিয়ে যেসব জটিল সময় অতিবাহিত হয়েছে, তার অবসান করার জন্য আমি আল্লাহ তা‘আলার কাছে প্রার্থনা করছি’। উম আহমদ সউদী রাজধানী রিয়াদে বাস করেন এবং তিনি বলেন যে, তিনি ভাইরাসে পরিবারের চার সদস্যকে হারিয়েছেন।
পূর্ববর্তী বছরগুলোতে ২০ লক্ষাধিক মুসলিম হজযাত্রী উষ্ণ শহর মক্কার অদূরে আরাফাতের তাঁবুতে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার মধ্যে একে অপরের কাছাকাছি বসে সাদা-সবুজ ছাতা মাথায় দিয়ে হজ পালন করতেন। এ বছর সাদা পোশাক পরিহিত হজযাত্রীদের আরাফাত পাহাড়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে এবং মাস্ক পরতে হয়েছে।
সিরিয়ার হজযাত্রী মাহের বরুদি বলছিলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলার কাছে আমাদের প্রথম প্রার্থনা হ’ল, তিনি যেন এই মহামারি, এই অভিশাপ পৃথিবী থেকে তুলে নেন যাতে পরের বছরগুলোতে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মুসলিমরা ব্যাপক হারে হজে যোগ দিতে সক্ষম হন এবং লাখ লাখ মুসল্লি এসব পবিত্র স্থানে আল্লাহর মহত্ব বর্ণনায় মুখরিত করে তুলতে পারেন।
গতকাল সূর্যাস্তের পর মাগরিব আদায় না করেই হাজীরা রওনা হন মুজদালিফার উদ্দেশে। এ বছর সরকারের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত গাড়ির ব্যবস্থা থাকায় হয়তো কাউকে পায়ে হেঁটে মুজদালিফায় যেতে হচ্ছে না। তবে যারা স্বেচ্ছায় হেঁটে যেতে চান তাদের কথা ভিন্ন। গতরাতে মুজদালিফায় পৌঁছে হজযাত্রীরা মাগরিব ও এশা আদায় এবং খোলা ময়দানে রাত্রী যাপন করেন।
আজ মঙ্গলবার সূর্যোদয়ের পর মিনায় গিয়ে সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাবার আগেই বড় জামরায় ৭টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন হাজীরা। সরকার জীবাণুমুক্ত কঙ্কর প্রত্যেক হজযাত্রীকে উপহার দেয়ায় তাদের মুজদালিফা থেকে সংগ্রহ করতে হবে না।
হজযাত্রীরা ছাড়া সউদী আরবে বাকি সবাই আজ ঈদুল আজহা উদযাপন করবেন। হজযাত্রীদের বড় জামরায় কঙ্কর নিক্ষেপ করা ছাড়াও কাবায় গিয়ে তাওয়াফে যিয়ারাহ তথা ফরজ তাওয়াফ আদায় করতে হবে। এদিন না করে ফরয তাওয়াফ ১১ বা ১২ যিলহজও করা যায়। এদিনের আরো একটি কাজ হল মাথা মু-ন বা চুল ছোট করা। এরপর হজযাত্রীরা ইহরাম ছেড়ে স্বাভাবিক পোশাক পরবেন।
১১ ও ১২ যিলহজ হজযাত্রীরা সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে যাবার পর তিনটি জামারাত তথা জামরাতুল উলা, জামরাতুল উসত্বা ও জামরাতুল আকাবা বা বড় জামরাতে প্রতিদিন ৭টি করে ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করবেন। এরপর যারা সংক্ষেপ করতে চান তারা ১২ যিলহজ কঙ্কর নিক্ষেপের পর সূর্যাস্তের পূর্বেই মিনা ত্যাগ করবেন। মিনায় সূর্যাস্ত হয়ে গেলে ১৩ যিলহজ ৩টি জামরাতে আরো ৭টি করে ২১টি কঙ্কর নিক্ষেপ করে হজ সম্পন্ন করবেন। পরিশেষে মক্কা ত্যাগের সময় বিদায়ী তাওয়াফ করবেন।
করোনাভাইরাস বিস্তারের শঙ্কা রোধে এবার যে ৬০ হাজার হজযাত্রীকে বেছে নেয়া হয়। অনলাইনে ৫ লাখের বেশি আবেদন থেকে লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত করা হয় তাদের। সবাইকে দেয়া হয় দুই ডোজের ভ্যাকসিন। গত বছর সউদীতে অবস্থানকারী বিভিন্ন দেশের ১০ হাজার মুসল্লি হজ আদায়ের সুযোগ পেয়েছিলেন। স্বাস্থ্যবিধি মেনে তথা সামাজিক দূরত্ব বজায়সহ স্বাস্থ্য সুরক্ষার নানা ব্যবস্থার পাশাপাশি তা মানা নিশ্চিত করতে হজযাত্রীদের পাশাপাশি অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম এবং সক্ষম মুসলমানদের জন্য জীবদ্দশায় কমপক্ষে একবার ফরজ। এটি বিশ্বে মুসলিমদের বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ। ২০১৯ সালে বিশ্বের প্রায় ২৫ লাখ মুসলিম এতে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে দু’বছর ধরে সীমিত পরিসরে হজ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
এই বছর হজ পালনের জন্য বিশেষভাবে নির্বাচিত হজযাত্রীরা চলমান করোনভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারিতে পবিত্র অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত। এ বছর হজের জন্য নির্বাচিতদের বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে হয়েছে, যার মধ্যে ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মোডার্না বা জনসন ও জনসন ভ্যাকসিনের মধ্যে যে একটি গ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল।
গত পাঁচ বছরে যারা হজ পালন করেননি এ বছর সেসব ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এছাড়া হজ করেননি ৫০ বছর বয়সী বা তার চেয়ে বেশি বয়সী ব্যক্তিদেরও অগ্রাধিকার দেয়া হয় এ বছর। এমনকি এবারই প্রথমবারের মতো পুরুষ অভিভাবক ছাড়া হজের নিবন্ধন করার সুযোগ পেয়েছেন সউদী নারীরা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।