বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
কোরবানির দিন দুপুরের পর থেকে একটা সাধারণ দৃশ্য সকলেরই চোখে পড়ে। কোরবানিদাতার বাড়ির দরজায় একদল মানুষের ভিড়। তাদের কেউ একা এবং কেউ পরিবারসহ। কেউ পেশাদার ভিক্ষুক এবং কেউ গরিব কর্মজীবী, যার নিজের কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য নেই। আজ তারা সবাই এক কাতারে। কোরবানির গোশত সংগ্রহের জন্য তারা দলে দলে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কোরবানিদাতা নিজে বা তার পক্ষ থেকে কোনো লোক তাদের হাতে হাতে এক-দুই টুকরা করে গোশত বিতরণ করছে। হাতে গোশত বিতরণ করছে আর মুখে কাউকে ধমকাচ্ছে, কাউকে বকছে, কাউকে তাড়া করছে এবং কারো উদ্দেশ্যে বিশেষ কোনো মন্তব্য করছে।
এ দৃশ্য কতটা সুখকর? কোরবানি একটি মহান ইবাদত। তার সাথে এ দৃশ্য খাপ খায় কি? কোরবানি করা ওয়াজিব, এর গোশত বিতরণ সুন্নত এবং এর গোশত খাওয়াও সুন্নত। ঈদুল আজহার নামকরণই করা হয়েছে এ মহান ইবাদতটির নামে। আল্লাহ তাআলা এ দিন নামাজ আদায়ের পাশাপাশি কোরবানি করারও হুকুম দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে : সুতরাং তুমি নিজ প্রতিপালকের (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য নামাজ পড় ও কোরবানি দাও। (সূরা কাউসার : ২)।
প্রথমে নামাজের হুকুম, তারপর কোরবানির। যেন বলা হচ্ছে- নামাযের মাধ্যমে প্রথমে আল্লাহর সামনে আত্মনিবেদিত হও, তারপর সে আত্মনিবেদনের নিদর্শনস্বরূপ কোরবানি কর। এজন্যই কোরবানি করতে হয় ঈদের নামাজ আদায়ের পর, তার আগে নয়। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে : কেউ নামাজ আদায়ের আগে যবাহ করলে সে যেন (নামাযের পর) পুনরায় যবাহ করে। (সহীহ বুখারী : ৫৫৪৯)।
যেহেতু এ যবাহ কেবলই আল্লাহর উদ্দেশ্যে, সে হিসেবে এর গোশত কারো জন্যই খাওয়া জায়েয হওয়ার কথা ছিল না, কিংবা আর সকলের জন্য খাওয়া জায়েয হলেও কোরবানিদাতার জন্য খাওয়ার অনুমতি থাকার কথা নয়। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বড়ই মেহেরবান। তিনি এটা সকলের জন্যই খাওয়া বৈধ করে দিয়েছেন। তিনি ইরশাদ করেন : তখন তার গোশত থেকে নিজেরাও খাও এবং ধৈর্যশীল অভাবগ্রস্তকেও খাওয়াও এবং তাকেও, যে নিজ অভাব প্রকাশ করে। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (সূরা হজ্ব : ১৩৬)।
নবী কারীম (সা.) এক হাদীসে ইরশাদ করেছেন : তোমরা খাও, জমা করে রাখ এবং দান-খয়রাত কর। (সহীহ বুখারী : ৫৫৬৯)।
এভাবে কোরবানির গোশত নিজে খাওয়ার এবং অন্যকে খাওয়ানোর জন্য উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। এ যেন আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে আতিথেয়তা। সমস্ত মুসলিম এ দিনগুলোতে আল্লাহর মেহমান। তাঁর জন্য নিবেদিত পশুর গোশত তিনি মুসলিমদের জন্য অবারিত করে দিয়েছেন, যাতে তারা তা খেয়ে খেয়ে তাঁর অনুগ্রহের শুকর আদায় করে। আল্লাহ তাআলার যিয়াফত ও আতিথেয়তা গ্রহণ করার মধ্যেই বন্দেগীর মাহাত্ম্য।
কাজেই কোরবানির গোশত খাওয়া উদরপূর্তিমাত্র নয়; বরং এর মধ্যে রয়েছে ইবাদতের মহিমা। আর এর গোশত বিতরণও নয় গরিবের প্রতি করুণা; বরং এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে যিয়াফতের প্রতিনিধিত্ব। কোরবানিদাতা যেন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের মেহমানদারি করছে। তো এটা ইবাদত ছাড়া আর কী? ইবাদত বলেই গোশত বিতরণে এ নিয়মকে মুস্তাহাব করে দেওয়া হয়েছে যে, সবটা গোশত তিন ভাগ করা হবে। তার এক ভাগ নিজেরা খাওয়া হবে, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের দেওয়া হবে আর এক ভাগ দেওয়া হবে গরিব-মিসকীনদের।
সুতরাং স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কোরবানির পশু জবাই, তার গোশত বিতরণ ও গোশত খাওয়া সবটাই ইবাদত। ইবাদত করার দ্বারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ হয় ও বিপুল ছাওয়াব পাওয়া যায়। কোরবানির আদ্যোপান্ত যখন ইবাদত, তখন এর দ্বারাও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও ছাওয়াব অর্জিত হবে বৈ কি। তা হবে কোরবানির পশু যবাহ করার দ্বারা, তার গোশত খাওয়ার দ্বারা এবং গোশত বিতরণ করার দ্বারা। তা কত এর ছাওয়াব?
যে দৃশ্যের কথা বলা হলো, কোরবানির মহান ইবাদতের সঙ্গে তা আদৌ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কেননা গোশত বিতরণের প্রচলিত পদ্ধতি বিনয়নিষ্ঠ নয়। এর মধ্যে আছে অহমিকার আভাস। লোকজন আমার বাড়ির দুয়ারে ছুটে এসেছে। আমার হাত থেকে গোশত নেওয়ার জন্য হাত পেতে রেখেছে। আমি বিরক্তির সাথে দুই-এক টুকরা গোশত সেসব হাতে বিলিয়ে যাচ্ছি কিংবা সাগ্রহে বিতরণ করে দুর্বলের প্রতি করুণা করার অহমবোধে আপ্লুত হচ্ছি। এ ভাবধারা আর যাই হোক, মহান ইবাদতের সাথে খাপ খায় না। ইবাদতকালে মনের ভাব কেমন হবে সে সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে : আর যারা যা দেওয়ার তা দেয় ভীত-কম্পিত হৃদয়ে এজন্য যে, তাদেরকে নিজ প্রতিপালকের কাছে ফিরে যেতে হবে। (সূরা মু’মিনূন : ৬০)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।