Inqilab Logo

রোববার ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ কার্তিক ১৪৩১, ৩০ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসরাইলি সফটওয়্যারে সাংবাদিক রাজনীতিকদের ফোন হ্যাক

বিভিন্ন দেশে ফোনে আড়িপাতার ঘটনা ফাঁসে তোলপাড়

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০২১, ১২:০৭ এএম

ইসরাইলের তৈরি হ্যাকিং সফটওয়্যার ‘পেগাসাস’ ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্মার্টফোনে আড়িপাতার ঘটনা ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংবাদ সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুসন্ধানে এ ঘটনা বেরিয়ে আসে। সংগঠন দুটি নাম ফাঁস হওয়া ব্যক্তিদের (যাদের স্মার্টফোনে আড়িপাতা হয়েছিল) তালিকা ব্রিটেনের গার্ডিয়ান, যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্ট, ভারতের দ্য ওয়্যারসহ বিশ্বের ১০টি দেশের মোট ১৭টি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে শেয়ার করে। তারা সবাই মিলে এই অনুসন্ধানের নাম দিয়েছে ‘পেগাসাস প্রজেক্ট’ যাতে ৮০ জনেরও বেশি সাংবাদিক যুক্ত ছিলেন। তাদের দাবি, পেগাসাস নামের স্পাইওয়্যার অ্যাপ যা সাধারণত জঙ্গি কার্যকলাপের উপর নজরদারি চালাতে বা সামরিক গোয়েন্দাদের কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেই অ্যাপ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গোপন নজরদারি চলছিল।

ব্রিটিশ প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ান এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, পেগাসাস ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো ‘টার্গেট’ করে নিজ দেশের বিভিন্ন ব্যক্তিদের উপর নজরদারি চালাচ্ছিল যাদের তারা হুমকি বলে মনে করে। এসব সরকার কোন না কোন সময় নাগরিক অথবা বিরোধী রাজনৈতিক নেতা অথবা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতদের উপরে গোপন নজরদারির জন্য অভিযুক্ত হয়েছে।

এসব দেশের মধ্যে বেশকিছু দেশের সরকার আবার পেগাসাস অ্যাপ-এর নির্মাতা সংস্থা এনএসও-র কাছ থেকে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সির প্রযুক্তি কেনার গ্রাহক। ইসরাইলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ পেগাসাস নামে ওই স্পাইওয়্যারের নির্মাতা সংস্থা এবং এই অ্যাপটিকে মিলিটারি ইনটেলিজেন্সের লাইসেন্সও দিয়েছে ইসরাইল সরকার। এটা দিয়ে আইফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে ঢুকে ব্যবহারকারীর অজান্তে তার বার্তা, ছবি, ইমেইল পাচার; কল রেকর্ড, মাইক্রোফোন চালু রাখা সক্ষম। এনএসও গ্রুপ অবশ্য বলছে, অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের ওপর নজরদারি চালানো তাদের ওই স্পাইওয়্যার তৈরির লক্ষ্য। কিন্তু গোপনে ব্যবহার করতে বিভিন্ন দেশের সরকার এনএসও-র গ্রাহক হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

অ্যামনেস্টির সাইবার সিকিউরিটি ল্যাব পরিচালনাকারী ক্লডিও গার্নিয়েরি বলেছেন, ‘যদি কোনো ফোনে (স্মার্টফোন) পেগাসাস সফটওয়্যারটি ঢোকানো যায়, তবে এনএসও-র গ্রাহক পুরো ফোনটির দখলই পেয়ে যাবে। ফোনের মালিকের মেসেজ, কল, ছবি, ইমেইল সবই দেখতে পাবে, এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালের বার্তাগুলোও পড়তে পারবে। গোপনে ক্যামেরা কিংবা মাইক্রোফোন চালুও করতে পারবে। স্মার্টফোন ব্যবহার না করলেও এটি আশপাশ থেকে শব্দ গ্রহণ করতে থাকে’।

পেগাসাস প্রজেক্ট বলছে, ৫০ হাজারেরও বেশি ফোন নম্বরের তালিকা তাদের অনুসন্ধানে সামনে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০১৬ সাল থেকে এনএসও–এর গ্রাহকরা এসব নম্বরে আড়ি পেতেছে। সেখানে অন্তত ৩৭টি (সিনিয়র সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী, বিজনেস এক্সিকিউটিভস, সউদী আরবের খুন হওয়া সাংবাদিক জামাল খাসোগি-র সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত দুই নারী) এমন সেলফোন নম্বর রয়েছে যাদের উপর গোপন নজরদারি চালানোর একদম যথাযথ প্রমাণ রয়েছে।

টার্গেট করা ব্যক্তিদের তালিকা ধাপে ধাপে প্রকাশ করা হবে বলে জানিয়েছে পেগাসাস প্রজেক্ট-এর সাথে জড়িত সংবাদমাধ্যমগুলো। প্রথম ধাপে প্রকাশিত তালিকায় বিশ্বের ২১ দেশের (কমপক্ষে ১২ এনএসও গ্রাহক দিয়ে) ১৮০ জন সাংবাদিককে ‘টার্গেট’ করার কথা বলা হয়েছে যাদের মধ্যে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতো বিশ্বখ্যাত পত্রিকার সাংবাদিকরা রয়েছেন। এনএসও গ্রাহকদের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার, বাহরাইন, মরক্কো, সউদী আরব, ভারত, মেক্সিকো, হাঙ্গেরি, আজারবাইজান, টোগো, রুয়ান্ডা।

ওই ১৮০ জনের মধ্যে ৩৮ জনই ভারতীয় সাংবাদিক যাদের অনেকেই হিন্দুস্তান টাইমস, নিউজ ১৮, দ্য হিন্দু এবং দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতো প্রথিতযশা সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত। এর আগে রোববার সকালেই পেগাসাস আড়ি পাতছে এমন বিস্ফোরক দাবি করে এক টুইটে বিজেপি-র রাজ্যসভার সংসদ সদস্য সুব্রামানিয়ান স্বামী লিখেন, ‘আড়ি পাতা হচ্ছে দেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের ফোনে, মোদির মন্ত্রিসভার সদস্যদের ফোনে, আরএসএস নেতাদের ফোনেও’। ভারত সরকার অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসেও আলোচনায় এসেছিল পেগাসাস। তখন পেগাসাসের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বের অন্তত ১৪০০ ব্যক্তির ফোনে ইসরাইলি প্রযুক্তি দিয়ে আড়ি পাতার অভিযোগ উঠেছিল। বলা হয়েছিল- চারটি মহাদেশের কূটনীতিক, রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে যার মধ্যে ছিল ভারত-ও। ২০১৯ সালে হোয়াটসঅ্যাপও পেগাসাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিল।

অমিত শাহর ছেলেকে নিয়ে প্রতিবেদনের পর পেগাসাসের তালিকায় তিনি
আড়িপাতার সম্ভাব্য নিশানায় থাকা হাজারো ফোন নম্বরের ফাঁস হওয়া তালিকায় ভারতের ৪০ জনের বেশি সাংবাদিক আছেন। এ তালিকায় ‘দ্য ওয়্যার’-এর এমন একজন সাংবাদিক রয়েছেন, যিনি দেশটির কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ছেলের ব্যবসা নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন।
দ্য ওয়্যারের প্রতিবেদনে বলা হয়, এখন পর্যন্ত করা ফরেনসিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, তালিকায় থাকা সাংবাদিকদের মধ্যে কয়েকজনের ক্ষেত্রে তাঁদের ফোনে পেগাসাস স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে সফলভাবে নজরদারি চালানো হয়েছে। দ্য ওয়্যার জানায়, ফাঁস হওয়া ফোন নম্বরের তালিকায় তাঁদের দুজন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক রয়েছেন। এছাড়া আছেন একজন কূটনীতিক সম্পাদক ও দুজন নিয়মিত প্রদায়ক। তাঁদের মধ্যে আছেন রোহিনী সিং।

ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ছেলে জয় শাহ ও ব্যবসায়ী নিখিল মার্চেন্টের ব্যবসা নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন রোহিনী সিং। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নিখিল। এছাড়া কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযুষ গোয়েলের সন্দেহজনক লেনদেন নিয়েও অনুসন্ধান করেছিলেন রোহিনী সিং।

দ্য ওয়্যার বলছে, এ ঘটনার পরই রোহিনী সিংকে আড়িপাতার জন্য নিশানা করা হয়। এ নিয়ে রোহিনী সিং টুইট করেছেন। তিনি বলেছেন, জয় শাহ ও নিখিল মার্চেন্টকে নিয়ে প্রতিবেদন করার পর এবং পীযুষ গোয়েলের সন্দেহজনক লেনদেন নিয়ে অনুসন্ধানকালে পেগাসাস দিয়ে তাঁকে নিশানা করা হয়েছে।

রোহিনী সিং বলেছেন, তার কথায় আড়িপাতা থেকে নিবৃত্ত থাকতে তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বরং তার প্রতিবেদনগুলো সরকারকে পড়তে বলেন তিনি।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাবেক সাংবাদিক সুশান্ত সিংয়ের ফোন নম্বরও তালিকায় আছে। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি তার ফোন নম্বর তালিকায় যুক্ত হয়। এ সময় তিনি বিতর্কিত রাফাল যুদ্ধবিমান কেনাবেচা নিয়ে তদন্ত করেছিলেন।
ইসরায়েলি স্পাইওয়্যার ব্যবহার করে আড়িপাতার বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে অমিত শাহর ব্যাখ্যা দাবি করেছেন বিজেপির রাজ্যসভার সদস্য সুব্রামানিয়ান স্বামী। তিনি বলেছেন, এ ঘটনার সঙ্গে যদি কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো যোগসূত্র থাকে, তাহলে অমিত শাহকে অবশ্যই তার ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান।

 

 



 

Show all comments
  • Mohammad Hasan ২০ জুলাই, ২০২১, ১:০৮ এএম says : 0
    কিছু করার নাই মামা৷ ইজরায়েল পৃথিবীর গডফাদার। পৃথিবীতে একমাত্র তারাই এভাবে হস্তক্ষেপ, তথ্যচুরি, হামলা সহ সব করতে পারে।
    Total Reply(0) Reply
  • Amzad Hossain Asad ২০ জুলাই, ২০২১, ১:০৯ এএম says : 0
    এটা তো অনেক আগে থেকে সবাই জানে। বলতে একটু দেরী হয়ে যায় আরকি।
    Total Reply(0) Reply
  • সাগর রহমান ২০ জুলাই, ২০২১, ১:০৯ এএম says : 0
    শুনলাম বাংলাদেশের পর এবার মোদী সরকারও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ইসরাইল থেকে পেগাসাস স্পাইওয়ার কিনেছে সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও সাধারণ জনগণের উপর গোপন নজরদারি করার উদ্দেশ্যে। এই স্পাইওয়ার ব্যবহার করে জামাল খাসোগীকেও হত্যা করেছিল সৌদী আরব। এই স্পাইওয়্যার এর একটি লাইসেন্স এর মূল্য ৭-৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং একটা লাইসেন্স দিয়ে ৫০ টি ফোনের উপর নজরদারি করা যায়। জনগণের ট্যাক্সের টাকাগুলো এরা এভাবেই খরচ করে যাচ্ছে
    Total Reply(0) Reply
  • Mohd Salah Uddin ২০ জুলাই, ২০২১, ১:১০ এএম says : 0
    এর সাথে জড়িত সবাই সমগ্র পৃথিবীর জন্যে ক্যান্সার । তাদের মূল উতপাটন জরুরি।আর ইহুদি ও তাদের দোসরেরা ( মুনাফিক) সমগ্র মানবজাতির দুশমন এটা সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে ইসলাম আমাদের কে সতর্ক করেছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Nazrul Islam ২০ জুলাই, ২০২১, ১:১০ এএম says : 0
    জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র গুলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে একতা থাকার উচিত। অন্যথায় একদিন সকল রাষ্ট্রই এই অন্যায়কারীর অপকর্মের সাফার হতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Mizanur Rahman ২০ জুলাই, ২০২১, ১:১০ এএম says : 0
    আল জাজিরার রিপোর্ট অনুযায়ী এটা বাংলাদেশের সরকারও কিনেছে আপনি ভয়ে তা রিপোর্ট করতে পারতেছেন না।
    Total Reply(0) Reply
  • Dr-Mehedi Hasan ২০ জুলাই, ২০২১, ১:১১ এএম says : 0
    ইসরাইল পৃথিবীতে ক্যান্সারের মতো রূপ ধারণ করছে। সন্ত্রাসবাদি দেশ ইজরায়েলে,তারা এশিয়া মহাদেশ ইউরোপের মধ্যে দেশ তথা সন্ত্রাসবাদ উস্কে দেওয়ার নাম হচ্ছে মোসাদ ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা।এর প্রভাব বাংলাদেশে বিস্তার করেছে কিনা জনগণের প্রশ্ন। কারণ যে পরিমাণ কল রেকর্ড হচ্ছে জনগণের প্রাইভেসি নষ্ট হচ্ছে, তা জনগণ আজ করতে পেরেছে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ