Inqilab Logo

সোমবার, ১৩ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

বিলীন বিস্তীর্ণ জনপদ

মেঘনার ভাঙন

আমানত উল্যাহ, রামগতি (লক্ষ্মীপুর) থেকে : | প্রকাশের সময় : ২০ জুলাই, ২০২১, ১২:০৭ এএম

লক্ষ্মীপুরের রামগতি-কমলনগরে মেঘনার স্রোতের ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। চোখের সামনেই নদীতে ভেঙে পড়ছে হাটবাজারের দোকানঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মক্তব, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ফসলের মাঠ, ঘরবাড়িসহ বিস্তীর্ণ জনপদ। চলতি বর্ষা মৌসুমের শুরুতেই নদীর ভাঙন মারাত্মক রূপ নিয়েছে। জেলার রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার ইউনিয়নের চরবালুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি চোখের সামনেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত স্কুলটি নদীতে বিলীন হওয়ায় প্রায় দুইশ ছাত্র ছাত্রীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কমলনগর উপজেলার চর কালকিনি ইউনিয়নের নাছিরগঞ্জ বাজারের প্রায় অর্ধেকের বেশি দোকানঘর ইতোমধ্যেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।
মারাত্মক হুমকির মুখে বাজারের অবশিষ্ট দোকানপাট, বাজার এলাকার চরকালকিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মক্তব, মোবাইল টাওয়ার, লোকালয়ের বসতবাড়িসহ বিস্তীর্ণ জনপদ। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাষ্টার সাইফুল্লাহ বলেন এই ভাবে চলতে থাকলে অচিরেই তার ইউনিয়নের অবশিষ্ট অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে।
স¤প্রতি একনেকের সভায় রামগতি-কমলনগর রক্ষায় একটি প্রকল্প অনুমোদন হলেও কাজ শুরুর আগে আরো কী পরিমাণ ভেঙে পড়ে এমন আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে নদীর তীরবর্তী মানুষের। দিশেহারা ব্যবসায়ী ও স্থানীয় এলাকাবাসী নিজস্ব উদ্যোগে বাঁধ দিয়ে চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। ভাঙন রোধে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন এলাকাবাসী।
নাছিরগঞ্জ বাজারের ঘর-মালিক ও স্থানীয় চরমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান আবুল কাশেম মেম্বার বলেন, পাঁচ কিলোমিটার দূরে থাকা মেঘনা এখন এ বাজারের দোকান-ঘর, স্বপ্নের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভেঙে নিয়ে গেছে। তালতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি কাওমি মাদরাসা ও জামে মসজিদসহ বাজারটি বিলীন হওয়ার পথে। ভাঙনের শিকার আবুল কাশেম মেম্বারসহ ক্ষতিগ্রস্তরা বলেন, এবারের মেঘনার ভাঙনের ভয়াবহতা বিগত সময়ের তুলনায় তিনগুণ বেশি। গত ১০ বছরে লক্ষাধিক মানুষ মেঘনায় ভিটেমাটি ছাড়া হয়েছে। সবশেষ গত দু’বছর মেঘনার ভাঙন ছাড়াও লোকালয় ও ফসলি জমিতে অস্বাভাবিক জোয়ারের পানি ঢুকে পড়ছে। চলতি বছরে নতুন সমস্যা যোগ হয়েছে জোয়ারের পানিতে অতিরিক্ত লবণাক্ততা। এমন পরিস্থিতিতে ভাঙনকবলিত মেঘনাপাড় এলাকায় স্থায়ী ও টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি তাদের।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর সদর এবং কমলনগর উপজেলার পশ্চিম সীমানার উত্তর-দক্ষিণ এবং রামগতি উপজেলার পশ্চিম ও দক্ষিণ বরাবর মেঘনানদী বহমান। কমলনগর উপজেলায় মেঘনার দৈর্ঘ্য ১৭ কিলোমিটার এবং রামগতিতে ২০ কিলোমিটার। দুই উপজেলার ৩৭ কিলোমিটার মেঘনানদী তীরবর্তী এলাকায় প্রতিনিয়ত চলছে ভাঙন খেলা। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদনে সাবেক রামগতি বর্তমানে (রামগতি-কমলনগর) উপজেলার আয়তন ছিল ৬৬৩ বর্গকিলোমিটার। ২০ বছর পর ২০১১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদনে সে আয়তন উল্লেখ করা হয় ৫৯৪ বর্গকিলোমিটার। যাতে দেখা যায় ২০ বছরে মেঘনায় বিলীন হয়ে যায় ৬৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা। ২০১১ সালের পর আর কোনো আদমশুমারি হয়নি। এর মধ্যে এ অঞ্চলে নদীভাঙনের গতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
উপজেলা মাদরাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও চরফলকন সিদ্দিকীয়া দাখিল মাদরাসার সুপার মাওলানা হাবিব উল্ল্যাহ বাহার জানান, তার লুধুয়াবাজারের মাদরাসাটি ভাঙনের শিকার হলে ফলকন বোর্ড অফিস এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। তিনি বলেন, সরকার ইতোমধ্যে নদীভাঙন প্রতিরোধে বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। টেকসই বাঁধ নির্মাণে একনেকে সরকার একটা বরাদ্দ অনুমোদন করেছে। এ ফাইলটি দ্রুত এগিয়ে নিয়ে এ এলাকার মানুষের ভিটেমাটি রক্ষা করা জরুরি।
আলেকজান্ডার ইউনিয়েনর চরবালুয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. সেলিম জানান, সম্প্রতি মেঘনার ভাঙন বিদ্যালয়ের খুব কাছাকাছি চলে এলে চেয়ার-টেবিলসহ মালপত্র সরিয়ে স্থানীয় বালুরচর উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়ে রাখা হয়। এরই মধ্যে মঙ্গলবার সদ্যনির্মিত ভবনটি সম্পূর্ণ মেঘনায় বিলীন হয়ে যায়। এতে বিদ্যালয়ের ১৯১ জন ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আহসান জানান, উপজেলা শিক্ষা কমিটির অনুষ্ঠিত সভায় স্থানীয় একটি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম আপাতত চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাপ্যতা বিবেচনায় সুবিধাজনক স্থানে বিদ্যালয়টি স্থানান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ বলেন, জেলার চারটি উপজেলা উপক‚লীয় হলেও রামগতি এবং কমলনগরে ভয়াবহ নদী ভাঙছে। দুটি উপজেলার মেঘনা নদীর ৩১ কিলোমিটার তীর রক্ষাবাঁধ নির্মাণের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় তিন হাজার ৮৯ কোটি ৯৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। প্রকল্পটির অর্থছাড় পেলে বাঁধের কাজ শুরু হবে বলেও জানান পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ কর্মকর্তা।
লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি-কমলনগর) আসনের সংসদ সদস্য মেজর (অব.) আবদুল মান্নান বলেন, দু’উপজেলার নদীভাঙন রোধ করতে একটি প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে। আশা করি প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর তীররক্ষা করা সম্ভব হবে। আমি সেনাবাহিনীর মাধ্যমে বাঁধ নির্মাণের কাজটি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর পত্র পাঠিয়েছি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ