বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
কোনো ব্যক্তিবিশেষের উদ্দেশে নয়, সাধারণভাবেই বলতে চাই যে, যারা এমন মনে করেন যে, হজের বিকল্প হিসেবে টাকা দান করে দেয়া যায়, কোরবানির বিকল্প হিসেবে গরিব মানুষকে অর্থ দান করে দেয়া যায়, তারা দ্বীনী বিষয়ে নিতান্তই মূর্খতা থেকে এমন ভাবনা ভেবে থাকেন এবং এজাতীয় কথা বলে থাকেন। তারা জানেন না- কোরবানি বা উযহিয়্যার হাকীকত ও প্রাণ কী? কোরবানির শিক্ষার যে প্রাণ, তা সাধারণ স্তরের জ্ঞান ও চিন্তার ঊর্ধ্বের একটি বিষয়। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার নির্দেশে ইবরাহীম আ. তাঁর সন্তানকে যবেহ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এমন কাজ কে কার হুকুমে করতে পারে! বাহ্যিক চিন্তাশক্তির ঊর্ধ্বের একটি বিষয়।
খালেক আল্লাহর হুকুমের সামনে আনুগত্য প্রকাশ করেছেন ইবরাহীম আ.। কোনো কিন্তু, কেন, কীভাবে- এজাতীয় প্রশ্নের মধ্যে তিনি পড়েননি, বরং আল্লাহ তাআলার হুকুমের সামনে একনিষ্ঠতার সঙ্গে আত্মসমর্পণ করেছেন। ছেলে ইসমাঈল আ.-ও ছিলেন নিবেদিত বান্দা ও ধৈর্যের পাহাড়। তিনিও কোরবানি হওয়ার জন্য নিজেকে পেশ করেছেন; আল্লাহ তাআলার পরীক্ষায় তাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন। পরে কোরবানির জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে পশু বরাদ্দ হয়েছে। এখন আমাদের জন্য সহজ হয়েছে কোরবানির আমল। নিজের বা নিজের সন্তানের জীবন বিলিয়ে দেয়ার পরিবর্তে পশু কোরবানি করতে পারছি।
কোরবানি করার পক্ষের সত্য ও সঠিক যুক্তি অনেক। দ্বীনী যুক্তি ও প্রেরণা রয়েছে। অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে, রয়েছে বিভিন্ন যৌক্তিক বিশ্লেষণ। কোরবানির পক্ষে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য যুক্তিগুলোর প্রসঙ্গ পরের ব্যাপার, প্রধান বিষয় হচ্ছে, আমার খালেক-স্রষ্টা আল্লাহ তাআলার নির্দেশ মান্য করা। কোরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন : .সুতরাং তুমি তোমার রবের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর এবং কোরবানি কর। (সূরা কাউসার : ২)। মুফাসসিরীনে কেরাম বলেছেন, এই আয়াতের মর্ম হচ্ছে, ‘ঈদের নামাজ পড়ুন এবং কোরবানি করুন।’ আমাদের নবী, ইনসানিয়াতের রাহবার হযরত রাসূলে কারীম (সা.) নিজে কোরবানি করেছেন, মানুষকে কোরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আমাদের জন্য কোরবানির বিধান, প্রেরণা ও প্রাণের এসব ইতিহাস ও প্রেক্ষাপটই যথেষ্ট। আরোপিত ক‚টতর্কের দিকে মনোযোগ দেয়ার কোনো আগ্রহ আমাদের নেই। আমাদের দ্বীন ও শরীয়তের অনুসারী বড় বড় ব্যক্তিত্বের মাঝে যুক্তি-তর্ক ও দার্শনিক যোগ্যতা ছিল অনেক বেশি, এখনকার যুক্তি ও তর্কবিদেরা তাদের ধারেকাছেও যেতে পারবে না, কিন্তু দ্বীনের বরেণ্য সেই মনীষীরা কোরবানির ‘বিকল্প’ প্রস্তাবনার যুক্তি-তর্কে যাননি এবং প্রয়োজনও মনে করেননি। কারণ, তারা জানতেন, শরীয়তের চাহিদা কী। তারা জানতেন আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের নির্দেশের মহত্ব কী। এজন্য আমার অনুরোধ, কোরবানিসহ বিভিন্ন ইবাদতের ‘বিকল্প’ প্রস্তাব যারা করতে চান, তারা এসব প্রস্তাব করা থেকে বিরত হোন। প্রতি বছর হজ-কোরবানি নিয়ে আপনাদের এসব উদ্ভট চিৎকারে মানুষ কান দেয় না, দেবেও না।
আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে চাই যে, কোরবানির ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার কথা, তাঁর প্রিয় রাসূল মুহাম্মাদ (সা.) এর কথা ও আমলকেই মুসলমানরা অনুসরণ করবেন, অন্য কোনো ক‚টযুক্তিতে তারা কান দেবেন না। কোরবানি-হজ ইত্যাদি ইবাদতের অর্থ গরিবের মাঝে দান করে দেয়ার ‘বিকল্প’ প্রস্তাব না দিয়ে তারা বরং ইসলামে দানের যে স্বতন্ত্র বিধান রয়েছে, সেটার ওপর আমল করুন। কোরবানি বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা না করে সেই নফল দান তাদের করতে দেখা যায় না কেন? বলা হচ্ছে, বাংলাদেশে বিত্তবানের হার দ্রæত বর্ধনশীল, এমনকি সা¤প্রতিক প্রচার পাওয়া আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী তা বিশ্বের অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের চেয়ে ঊর্ধ্বগামী।
আবার অপর দিকে বলা হচ্ছে, নতুন করে দেড় দুই কোটি লোক গরিব হয়ে যাচ্ছে। তো এই বিত্তবানদের কিছু অর্থ গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দিলেই তো দারিদ্র্য সঙ্কটের সমাধান হওয়ার কথা। মানুষের কোরবানি আটকে দেয়ার প্রস্তাব করার প্রয়োজন কী! দেশের অসংখ্য লাখো কোটিপতির কিছু টাকা দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দিলেই তো দারিদ্র্য সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। যেসব বিত্তবানের প্রচারযন্ত্রে বসে কোরবানি না করে কোরবানির টাকা গরিবদের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার ‘বুদ্ধিজীবীসুলভ’ পরামর্শ বিতরণ করা হয়Ñ এসব কোটিপতি মালিকদের টাকার ভাÐার থেকে কত টাকা গরিবদের নফল দান করা হয়- এসব প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের মনে মনে ঘুরছে।
কোরবানি কিংবা অন্য কোনো ইবাদতের অর্থ গরিবদের খাতে দেয়ার প্রস্তাবনার প্রয়োজন নেই, ইসলামের বিধানেই যাকাত-সদাকাসহ সাধারণ দানের বহু খাত বরাদ্দ আছে, নির্দেশনাও আছে। মহামারি অতিমারির সময়ে এসব দান আরো ব্যাপকভাবে করতে হবে। বিত্তবান নাগরিকদের উদ্যোগে এবং রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্য থেকে সেসব খাতে দান করতে হবে। ইসলামী অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করলে গরিবকে সহযোগিতা করার যেসব উৎস ও খাত রয়েছে তারা সে সম্পর্কে জানতে পারবে। পাঠকরা জেনে থাকবেন, ইসলামে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য আলাদা খাত বরাদ্দ আছে, এর জন্য কোরবানির খাতের টাকার দিকে চোখ দেয়ার দরকার নেই। ইসলামী অনুশাসন নিয়ে পড়াশোনা করলে এবং তা অনুশীলন করার আগ্রহ থাকলে ইসলামের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতামূলক অনেক নির্দেশনা পাওয়া যাবে। খালেকের হুকুমের সামনে কোনো যুক্তিতর্ক ছাড়া মাখলুকের আত্মসমপর্ণের সবক দেয় কোরবানি। কোরবানির এ প্রাণ ও তাৎপর্যের সামনে অন্য কোনো যুক্তিতর্কের কোনো অবস্থান থাকতে পারে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।