Inqilab Logo

রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

তিস্তার পানি কমতে শুরু করলেও দুর্ভোগ কমেনি পানিবন্দি মানুষের : বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভাঙ্গন শুরু

মাহফুজুল হক আনার/হালিম আনছারী | প্রকাশের সময় : ১১ জুলাই, ২০২১, ৩:৫৬ পিএম

করাল গ্রাসী তিস্তা নদীর পানি কিছুটা কমলেও দুর্ভোগ কমেনি পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষের। বরং পানি কমতে শুরু করার সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে নতুন করে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। এই ভাঙ্গন ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করছে। ইতিমধ্যে পানিবন্দি লোকজন চরম খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানি সংকটে পড়েছেন। খাদ্যের অভাবে পানি বন্দি পরিবারগুলি চরম দূর্দশায় পড়েছে। একদিকে লকডাউন অপরদিকে বন্যা দুই মিলিয়ে কাজ হারানো পরিবারগুলির মধ্যে অবিলম্বে ত্রানের ব্যবস্থা নেয়া না হলে খাদ্যাভাবে চরম ক্ষতির মুখে পড়বে নারী ও শিশুরা।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি থেকে বাঁচতে ভারতীয় গোজল ডোবা ব্যারেজের সকল গেট এক সঙ্গে খুলে দেয়ায় তিস্তা নদীর পানি বেড়ে যায়। গত বুধবার থেকে আকস্মিকভাবে বাড়তে শুরু করে এবং শুক্রবার দুপুরে বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এতে করে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুরসহ গাইবান্ধা জেলার নদী তীরবর্তী এলাকা এবং বিভিন্ন চরাঞ্চলসহ নি¤œাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়ে পড়ে। পানিবন্দি হয়ে পড়ে হাজার হাজার পরিবার। হঠাৎ করে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদী তীরবর্তী মানুষজন গবাদিপশু ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বাঁধ ও আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেন।পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভাঙ্গন শুরু হয়। ব্যারেজ রক্ষায় ব্যারেজের ৪৪টি গেট খুলে দেন কর্তৃপক্ষ।
আকস্মিকভাবে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার গড্ডিমারী, সিঙ্গামারি, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, ডাউয়াবাড়ী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, শৈইলমারী, নোহালী, চর বৈরাতি, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের চৌরাহা, দক্ষিণবালাপাড়া, কুটিরপাড়,চরগোবরধন, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর ও গোকুণ্ডা ইউনিয়ন, নীলফামারী জেলার ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ২৫টি চরের প্রায় ৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়ে।
ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল-মামুন জানান, উজানের ঢলের কারনে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করায় ডাউয়াবাড়ি এলাকার ডানতীর প্রধান বাধ হুমকীর মুখে পড়ে। বাঁধ রক্ষায় সেখানে বালির বস্তা, কাঠের ও বাঁশের পাইলিং করা হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ আকারে ভাঙ্গন শুরু করেছে। গতকাল থেকে পানি কিছুটা কমতে শুরু করায় ভাঙ্গন আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন স্থানে শত শত একর ফসলি জমি, গাছপালা ঘরবাড়ি হুমকির মুখে পড়েছে।
ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান ময়নুল হক জানান, গত কয়েকদিন থেকে টানা আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে তিস্তা নদীর পানি রাতারাতি বেড়ে যায়। এতে করে অনেক এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে। এক রাতেই পূর্ব খড়িবাড়ি, পশ্চিম খড়িবাড়ি, ঝিঞ্জির পাড়া বেশকিছু গ্রামের প্রতিটি বাড়ি হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে যায়। তার এলাকার চরখড়িবাড়ি মৌজাটি চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। সেখানকার স্বেচ্ছাশ্রম বাধটি চরম হুমকীর মুখে পড়েছে। সেখানে বালুর বস্তা দিয়ে বাঁধটি রক্ষার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এই বাঁধটি ভেঙ্গে গেলে চরখড়িবাড়ি মৌজার ২ হাজার পরিবারের বাড়িতে পানি ঢুকে পড়বে। এছাড়া, ডিমলা উপজেলার পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, গয়াবাড়ি, টেপাখড়িবাড়ি, খালিশা চাঁপানী ও ঝুনাগাছ, কিছামত ছাতনাই, ঝাড় শিঙ্গেশ্বর, চর খড়িবাড়ি, পূর্ব খড়িবাড়ি, পশ্চিম খড়িবাড়ি, তিস্তা বাজার, তেলির বাজার, ছোটখাতা বাইশ পুকুর, ছাতুনামা, ভেন্ডাবাড়ি এলাকার পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় সেখানকার মানুষজন গরু ছাগল নিয়ে নিরাপদে সরে গেছে। এখনও তারা গরু-ছাগল নিয়ে ্বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়ে আছে। কারণ যেকোন সময় পানি আবারো বাড়তে পারে।
এদিকে, তিস্তা নদীর পানি আকস্মিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া এবং পীরগাছা উপজেলার প্রায় ১৩টি ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক হাজার পরিবার। পানি বাড়ার সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়।
আকস্মিকভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষ করে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের চরাঞ্চলসহ নিম্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় ৮ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েন। উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়নের পূর্ব বিনবিনা চর হতে লক্ষীটারী ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলী সংযোগ বেড়ি বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় বাগেরহাট বাজার এলাকাসহ আশ্রয়নে পানি ঢুকে পড়ে। নদীর তীব্র স্রোতে বিনবিনার চরে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতেত নির্মিত বাঁধটি ভেঙ্গে পূর্ব বিনবিনার চরের মসজিদটি বিলীন হয়ে যায়। লক্ষীটারীর কেল্লারপাড় চরে স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত উপবাঁধটিও ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ইতিমধ্যে কোলকোন্দ ইউনিয়নের পূর্ব বিনবিনা ও পশ্চিম ইচলীর ১৭টি পরিবারের ঘর-বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে বেশ কিছু রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, মসজিদ ও ফসলি জমি। পানিবন্দি পরিবারগুলো রাস্তাসহ উচু স্থানে পলিথিনের ছাউনি তৈরি করে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি ও ঘরের আসবাবপত্র নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে এসব পরিবার মানবেতর জীবন-যাপন করছে। উপজেলার লক্ষীটারী ইউনিয়নের পশ্চিম ইচলি, শংকরদহ, বাগেরহাট আশ্রয়ন, পূর্ব ইচলির প্রায় সাড়ে ৩ হাজার, কোলকোন্দ ইউনিয়নের বিনবিনা, মটুকপুর, চিলাখাল, খলাইরচরসহ নিম্ন এলাকার ৩ হাজার, নোহালীর মিনার বাজার, কচুয়াচর, বৈরাতী বাঁধের ধার, চর নোহালী, বাগডহরা চরের ২শ, মর্নেয়া ইউনিয়নের মর্নেয়াচর, তালপট্টি, আলাল চর, নরসিং চর, গজঘন্টা ইউনিয়নের কালির চর, ছালাপাক, গাউছিয়া বাজার, জয়দেব, মইশাসুর, রামদেব চরসহ আলমবিদিত ও গঙ্গাচড়া ইউনিয়নের তিস্তা বেষ্টিত নিম্ন এলাকার ১শ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শনিবার রাত থেকে তিস্তা নদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করলেও বন্যাকবলিত এসব এলাকার পানি এখনও কমেনি। পানিবন্দি লোকজন জানান, এসব এলাকায় গত সপ্তাহে বানের পানি ঢুকে পড়লেও সোমবার থেকে পানি নামতে থাকে এবং মঙ্গলবারে অনেকটা নেমে যায়। কিন্তু বুধবার রাত থেকে হঠাৎ আবারও তিস্তার পানি অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় আবারও এসব এলাকায় বানের পানি বেড়ে যায়। এতে করে নতুন করে আরো বেশ কিছু এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। পানি বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। লক্ষীটারী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদী জানান, তার ইউনিয়নের ৩ হাজারের বেশী পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। এর আগে দু-দফায় মাত্র সাড়ে ৬শ পরিবারকে ত্রাণ দেয়া হয়েছে। এখনও অনেক পরিবার ত্রাণ সহায়তা পায়নি। তার ওপর নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি এসব পরিবারের জন্য দ্রুত ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন। কোলকোন্দ ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব আলী রাজু জানান, তিস্তার পানি বৃদ্ধি ফলে ভাঙন ও বন্যার দেখা দেওয়ায় বিনবিনা চরে ৭টি পরিবারের বাড়ি-ঘর বিলীন হয়েছে এবং প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়েছে। এই ইউনিয়নে এর আগে ৫শ ৭৫টি পরিবারকে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হয়েছে।
তিস্তার ভয়াবহ ভাঙ্গনে পীরগাছা উপজেলার কোলাহল মুখর দক্ষিণ চর গাবুরা গ্রামটি আজ বিলীন হতে চলেছে। ইতিমধ্যে এই গ্রামের সবকিছুই গ্রাস করে নিয়েছে করাল গ্রাসী তিস্তা। আর মাত্র ৪টি পরিবারের বসত-ভিটা গেলেই মানচিত্র থেকে মিশে যাবে পীরগাছা উপজেলার দক্ষিণ চর গাবুরা গ্রামটি। চরম হুমকির মুখে পড়ে আছে এই গ্রামের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘চর দক্ষিণ গাবুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। স্কুলটি শেষ রক্ষায় চলছে ব্যাপক তোড়জোর। দিনে-রাতে ফেলা হচ্ছে জিও ব্যাগ। তবুও কোন কাজ হচ্ছে না। এলাকাবাসীর দাবি গত বছরেও বিদ্যালয়টি ভাঙন ঝুঁকিতে পড়েছিল। তখনই ভাঙন রোধে ব্যবস্থা কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হলে আজ এই অবস্থা হত না।
সরেজমিনে পরিদর্শনকালে দেখা যায়, নদী থেকে মাত্র ১৫ মিটার দূরে এ স্কুলটি শেষ রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উপজেলা প্রশাসন, স্কুল কর্তৃপক্ষ, এলাকাবাসী এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড। দিনে-রাতে ফেলা হচ্ছে জিও ব্যাগ। ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে ওই গ্রামের ৫০টি বসতবাড়ি। ভাঙ্গনের ফলে এসব বাড়ির লোকজন এখন আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভাঙ্গন


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ