Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নারী ক্রীড়াবিদদের নৈপুণ্যে বেজে উঠছে জাতীয় সঙ্গীত

খেলাধুলায় এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা

প্রকাশের সময় : ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রক্ষণশীল সমাজের গন্ডি থেকে বেরিয়ে এসে নানা প্রতিক‚লতা পেরিয়ে ক্রীড়াঙ্গনে একটার পর একটা সাফল্যের ইতিহাস রচনা করে চলেছে বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদরা। মেয়েদের সাফল্যে আজ স্ব-গর্বে উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা, সমৃদ্ধ হচ্ছে ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাস। খেলাধুলায় মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ প্রকাশিত হলো পঞ্চম এবং 

শেষ কিস্তি

শামীম চৌধুরী : ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসে ছেলেদের ১০ স্বর্ণপদকের বিপরীতে মেয়েদের অর্জনের সমষ্টি ছিল ৮টি স্বর্ণ। ১০০ মিটার হার্ডলসে নারী অ্যাথলিট সুমীতা রানীর ফটো ফিনিশিং ট্র্যাজেডি এবং সাইক্লিংয়ে ৫০ কিলোমিটার রোড রেস ইভেন্টে চিংবাই মারমার স্বর্ণ কেড়ে নেয়া না হলে সেই আসরেই স্বর্ণজয়ে ছেলেদের অর্জনকে ছুঁয়ে ফেলতে পারত মেয়েরা। প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে গৌহাটি-শিলংয়ে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসের পরবর্তী আসরেই ছেলেদের সাফল্যকে ছাড়িয়ে গেছে মেয়েরা। আসর থেকে মোট অর্জিত ৪টি স্বর্ণপদকের তিনটিই এসেছে ২ নারী ক্রীড়াবিদের হাত ধরে! এসএ গেমসের সাঁতার ডিসিপ্লিন থেকে কখনোই স্বর্ণজয়ের অতীত ছিল না বাংলাদেশের মেয়েদের। অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে ৩২টি বছর। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত এসএ গেমস থেকে স্বর্ণজয়ে নতুন অধ্যায় রচনা করেছেন মাহফুজা খাতুন শিলা। ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত সাফ গেমস থেকে মোশারফ হোসেনের ৫ স্বর্ণজয়ের অবিশ্বাস্য কীর্তির পর দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে সাঁতার ডিসিপ্লিনে একাধিক স্বর্ণজয়ের রেকর্ড ছিল না কারো। এখন এসএ গেমসে নারী সাঁতারে স্বর্ণজয়ে পথিকৃৎ মাহফুজা খাতুন শিলার হাত ধরে একাধিক ইভেন্টে স্বর্ণজয়ে সেই আক্ষেপটাও ঘোঁচালো বাংলাদেশ। উত্তরোত্তর উন্নতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এই নারী সাঁতারু। ব্রেস্ট স্ট্রোকের ২ ইভেন্ট ১০০ মিটার এবং ৫০ মিটারে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইটা তার শুরু সেই ২০০৬ কলোম্বো সাফ গেমস থেকে। ২ ইভেন্টেই ব্রোঞ্জে তুষ্ট থাকতে হয়েছে সেই আসরে। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে স্বর্ণের সম্ভাবনা জাগিয়ে রৌপ্যতে থেমেছেন ইভেন্ট দু’টিতে। ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে যশোরের অভয়নগরের এই মেয়েটির সাফল্যে বেজে উঠল ২ বার বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। ৩৪.৮৮ সেকেন্ডে ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোক ইভেন্টে গেমস রেকর্ডে নিজেকে তুললেন আরো উচ্চতায়।
অথচ কি জানেন- সাঁতার নয়, এই মেয়েটি স্বপ্ন দেখতেন অ্যাথলেটিক্স নিয়ে। শৈশবে দৌড় প্রতিযোগীতায় অংশ নিয়ে সেরা হওয়াই ছিল তার নেশা। সেই শিলা-ই কিনা হয়ে গেলেন সাঁতারে স্বর্ণকন্যা! অ্যাথলেটিক্স থেকে সাঁতারু হওয়ার গল্পটা শুনিয়েছেন মাহফুজা খাতুন শিলাÑ‘ছোটবেলায় ১০০ ও ২০০ মিটার স্প্রিন্ট এবং লং জাম্পে ভাল করতাম। ১৯৯৮ সালে আমার এলাকায় শিশু একাডেমি খেলাধুলার আয়োজন করে। সেখানে আমার অ্যাথলেটিক্সে অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু খেলতে এসে দেখি অ্যাথলেটিক্সের ইভেন্টগুলো শেষ হয়ে গেছে। তখন স্কুলের স্যার বললেন অ্যাথলেটিক্স তো শেষ, তুই কি সাঁতরাতে পারবি? আমি রাজি হয়ে গেলাম। জীবনে কখনো সাঁতারে কোনো প্রতিযোগিতা করিনি, তারপরও পুকুরে ঝাঁপ দিয়েই হলাম প্রথম। সেই থেকে সাঁতারে নেশা চেপে গেল। তবে অ্যাথলেটিক্সের মায়া ছাড়তে লেগেছে অনেকদিন। ২০০২ সালে বিকেএসপিতে সাঁতারে ভর্তি হয়েও অ্যাথলেটিক্সের ওপর টান ছাড়তে পারিনি। মনে আছে ২০০৪ ও ২০০৫ সালে বিকেএসপির আন্তঃঅ্যাথলেটিক্সে ৪ঢ১০০ মিটার এবং ৪ঢ৪০০ মিটার রিলে ইভেন্টে প্রথম হয়েছি।’
এসএ গেমসে সাঁতারে মাহফুজা খাতুন শিলার কৃতিত্বের পাশে রাখতে হচ্ছে নারী ভারোত্তোলনে মাবিয়া আক্তার সীমান্তকে। এসএ গেমসের ভারোত্তোলনে নারী ভারোত্তোলকদের অংশগ্রহণের অভিষেকেই স্বর্ণপদক জয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে গর্বিত করেছেন সীমান্ত। ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণীতে ১৭৩ কেজি ওজন তুলে জিতেছেন স্বর্ণপদক। হামিদুলের হাত ধরে ২০১০ সালে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের ভারোত্তোলনে প্রথম স্বর্ণ জিততে যেখানে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ২৪টি বছর, সেখানে ভারোত্তোলনে নারীদের অংশগ্রহণের অভিষেকেই মাবিয়া আক্তার সীমান্তের পারফরমেন্সে স্বর্ণপদকে ইতিহাস রচনা করেছে বাংলাদেশ! ২০১৬ সালে গৌহাটি-শিলংয়ে অনুষ্ঠিত এসএ গেমসে বাংলাদেশের প্রথম স্বর্ণজয়টিও এই ইভেন্ট থেকেই। স্বর্ণজয় যতটা না আলোচনায় এনেছে সীমান্তকে, তার চেয়েও বেশি আলোচনায় এনেছে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের সময়ে পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে অঝোরে তার কান্না! পেছনে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা, বাজছে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ যতক্ষণ বেজেছে জাতীয় সঙ্গীত, ততক্ষণ কেঁদেছেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশে এর চেয়ে ভালো দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে? এই কান্নার কারণটা জানিয়েছে সীমান্তÑ‘গেমসে প্রথম তিনদিন স্বর্ণপদকহীন কেটে গেছে। বাংলাদেশ ক্রীড়াবিদদের কেউ জিততে পারেনি স্বর্ণপদক। আমার সাফল্যে সেই কষ্ট লাঘব হয়েছে। তাই আবেগ ধরে রাখতে পারিনি। তাছাড়া হাতে প্রচÐ ব্যথা নিয়ে লিফটিং করাটাই দুরূহ ছিল আমার পক্ষে। মনে হচ্ছিল, একশ’ ভাগ দিতে পারছি না। তারপরও প্রতিজ্ঞা ছিল, যে করেই হোক, আমাকে সবার চেয়ে বেশি ওজন তুলতেই হবে। যখন স্বপ্নটা সত্যি হলো, জাতীয় সঙ্গীত বেজে উঠল, তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি।’
বাংলাদেশে মহিলা ভারোত্তোলন প্রবর্তনের ইতিহাসটা খুব বেশি দিনের নয়। শুরুটা ২০০২ সালে। ইন্টারন্যাশনাল ওয়েটলিফটিং ফেডারেশনের চাপে বাধ্য হতে হয়েছে বাংলাদেশ ভারোত্তোলন ফেডারেশন মেয়েদেরকে এই খেলায় আনতে। শুরুটা খুবই সীমিত পরিসরে, বিভিন্ন খেলার মেয়েদের ধরে এনে মাত্র ৬ জনকে জড়ো করতে পেরেছে তখন ফেডারেশন। প্রতিযোগীর সংখ্যা কম বলে বিভিন্ন ওজন শ্রেণীতে মহিলা ভারোত্তোলকদের পরীক্ষা নিতে পারেনি ফেডারেশন। সেই মহিলা ভারোত্তোলনে এখন বেড়েছে প্রতিদ্ব›িদ্বতা। সর্বশেষ জাতীয় মহিলা ভারোত্তোলনে প্রতিযোগীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ৬০ জন। নারী ভারোত্তোলকদের মধ্যে ৩৬ জনের চাকরির সংস্থান হয়েছে। এমনটাই জানিয়েছেন ভারোত্তোলন ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক উইং কমান্ডার (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদÑ‘১৯৯৮ সালে ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এশিয়ান গেমস চলাকালে ইন্টারন্যাশনাল ওয়েটলিফটিং ফেডারেশন এশিয়ার যেসব দেশে নারী ভারোত্তোলন প্রবর্তিত হয়নি, তাদেরকে চাপ দিয়েছে। অ্যাফিলিয়েশন ধরে রাখতে বাধ্য হয়ে ১৯৯৯ সালে মহিলা ভারোত্তোলনে আগ্রহীদের ডেকে এনে ক’দিনের জন্য ট্রেনিং দেয়া হলো। তখন মেয়েদের বাবা-মাকে এই খেলার ভবিষ্যৎ নিয়ে বোঝাতে হয়েছে। ২০০২ সালে মহিলা ভারোত্তোলনের প্রতিযোগিতা আয়োজনে তেমন সাড়া পাইনি। মাত্র ৬ জন প্রতিযোগীকে পেয়েছি। ফলে একাধিক ওজন শ্রেণীতে আসরটি আয়োজন করতে পারিনি। সবাইকে এক ক্যাটাগরিতে রেখে প্রতিযোগিতা কোনোমতে সম্পন্ন করেছি। এখন সেখানে সবক’টি ওজন শ্রেণীতে হচ্ছে প্রতিদ্ব›িদ্বতা। আমার জানামতে, এখন আনসার ও ভিডিপি, বিজেএমসি, বাংলাদেশ জেল, ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স এবং সেনাবাহিনীতে ৩৬ জন মেয়ে ভারোত্তোলক চাকরি করছে।’
ইয়ুথ কমনওয়েলথ গেমস, আফ্রো-এশিয়ান ওয়েটলিফটিং, দক্ষিণ এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপ এবং এসএ গেমস মিলে এই পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারোত্তোলকদের অর্জন মোট ৫টি স্বর্ণপদক। তার ৪টিই এসেছে মেয়েদের হাত ধরে! যার মধ্যে সর্বাধিক ২টি স্বর্ণপদক জয়ের গর্ব মাবিয়া আক্তার সীমান্তের। ২০১৫ সালে ভারতের পুনেতে অনুষ্ঠিত ইয়ুথ কমনওয়েলথ গেমসে স্বর্ণপদক জয়ের পর ২০১৬ সালে গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত এসএ গেমস থেকেও অনূর্ধ্ব-৬৩ কেজি ওজন শ্রেণীতে এই নারী ভারোত্তোলক জিতেছেন স্বর্ণপদক। দুই নারী ভারোত্তোলকের হাত ধরে অন্য ২টি স্বর্ণপদক জিতেছে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ভারোত্তোলন চ্যাম্পিয়নশিপে। ২০১১ সালে নেপালে অনুষ্ঠিত ওই আসরে অনূর্ধ্ব-৬৩ কেজি ওজন শ্রেণীতে শাহরিয়া সুলতানা এবং অনূর্ধ্ব-৪৮ কেজি ওজন শ্রেণীতে মোল্লা সাবিরা সুলতানা জিতেছে স্বর্ণপদক। মেয়েদের সাফল্যের শুরুটা ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ইয়ুথ কমনওয়েলথ গেমস থেকে। অনূর্ধ্ব-৫৩ কেজি ওজন শ্রেণীতে ফাহিমা আক্তার ময়নার ব্রোঞ্জ পদক জয়ের মধ্য দিয়ে। অথচ কি জানেনÑসেই আসরে নাকি মুচলেকা দিয়ে ময়নার নাম এন্ট্রি করতে হয়েছিল ফেডারেশনকে। এমন তথ্য দিয়েছেন ফেডারেশনের লম্বা সময়ের সাধারণ সম্পাদক উইং কমান্ডার (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদÑ‘বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) চায়নি ময়না ইয়ুথ অলিম্পিকে অংশ নিক। ময়না খালি হাতে ফিরবে না, ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বিওএকে লিখিতভাবে এই মুচলেকা দিতে হয়েছিল।’ মুচলেকা দিয়ে আন্তর্জাতিক ভারোত্তোলনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া নারী ভারোত্তোলকরাই এখন বাংলাদেশের গর্ব, তাদের সাফল্যে বেজে উঠছে জাতীয় সঙ্গীত।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নারী ক্রীড়াবিদদের নৈপুণ্যে বেজে উঠছে জাতীয় সঙ্গীত
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ