পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাত ধরেই বাঙালি জাতির মাতৃভাষার অর্জন ও স্বাধীন-স্বার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যূদ্বয় ঘটেছে। জীবন্ত এই ইতিহাসের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাস, ইতিহাসের নানা অধ্যায়।
সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ শতবর্ষে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। ১৯২১ সালের ১ জুলাই পূর্ব বাঙলার মুসলমানের শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন এবং এই অঞ্চলের মানুষকে স্বাবলম্বিতা অর্জনের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তৈরি করা হয়েছিল নানা প্রতিবন্ধকতা। সেই সময় কলকাতার তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত ও হিন্দু নেতারা ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা রোধে দিয়েছিল স্মারকলিপি। তাতেও তারা ক্ষান্ত থাকেননি, প্রতিবাদ সভা থেকে শুরু করে র্যালি পর্যন্ত আয়োজন করেছিলেন। কিন্তু ঢাকার তৎকালীন নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হক, সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীসহ অন্যরা তাদের দাবি আদায় করে নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয়টি এই অঞ্চলের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের চেতনার বিকাশ ঘটে। যার প্রতিফলন ঘটে ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বাংলা ভাষার দাবিতে ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভূত্থান, ৭১’র স্বাধীনতা যুদ্ধ, ৯০’র গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনসহ বাঙালির অধিকার আদায়ে সবকটি আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থ, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঐতিহ্যবাহী এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আজ পা দিচ্ছে শতবর্ষে। দিবসটি উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শুভানুধ্যায়ীসহ সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. মো. আখতারুজ্জামান। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ বর্ণাঢ্য আয়োজনের মাধ্যমে পালনের পরিকল্পনা থাকলেও চলমান করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে তা বাতিল করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে বর্ণাঢ্য ও জাঁকজমকপূর্ণ মূল অনুষ্ঠান আগামী ১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন প্রফেসর আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মো. আবদুল হামিদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে শতবর্ষের মূল অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন। মূল অনুষ্ঠানের অগ্রবর্তী অনুষ্ঠান হিসেবে আজ সীমিত পরিসরে প্রতীকী কর্মসূচির মাধ্যমে বিশেষ এ দিবসটি উদ্যাপিত হচ্ছে।
জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের গৌরবগাঁথা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষ পাড়ি দিয়েছে জানিয়ে ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে টেকসই উন্নয়নে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী বিশ্ববিদ্যালয় বিনির্মাণ এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আমরা এগিয়ে চলছি। শিক্ষার গুণগত মান ও পরিবেশ উন্নয়ন এবং গবেষণার পরিধি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিশ^বিদ্যালয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ ‘মাস্টার প্ল্যান’ প্রণয়ন করা হয়েছে। মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার ক্ষেত্র জোরদার করার জন্য ‘ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া’ এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন দেশপ্রেমিক প্রজন্ম গড়ে তোলাই আমাদের লক্ষ্য।
প্রতিষ্ঠার ইতিহাস: বঙ্গভঙ্গ রদের ঘটনায় পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগণ ব্যাপকভাবে ক্ষুব্ধ ও আশাহত হন। ঢাকার তৎকালীন নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে একদল মুসলিম জনপ্রতিনিধি, যার মধ্যে ‘বাংলার বাঘ’ খ্যাত এ কে ফজলুল হক ও সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী অন্যতম, বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান সর্বপ্রথম ১৯১২ সালের ৩১ জানুয়ারি। ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায় পূর্ব বাঙলার মুসলিম নেতৃবৃন্দ। তাই বঙ্গভঙ্গ রদের অল্প কিছুদিন পরেই এই অঞ্চলের মুসলমান নেতৃবৃন্দের দাবির প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন ১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। এই ঘোষণা পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, দর্শন, মননশীলতায় নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে বাঙালি শিক্ষিত সমাজ। ১৯১২ সালের ২৭ মে গঠিত হয় ১৩ সদস্যবিশিষ্ট নাথান কমিশন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব অর্পিত হয় নাথান কমিশনের ওপর। ১৯১৩ সালে নাথান কমিশনের ইতিবাচক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সে বছরের ডিসেম্বর মাসেই রিপোর্টটি অনুমোদিত হয়। এর ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুগম হয়। ১৯১৭ সালে স্যাডলার কমিশন ইতিবাচক রিপোর্ট দিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত ধাপ তৈরি হয়ে যায়। অবশেষে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভায় ‘দ্য ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট ১৯২০’ পাস হয়। ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল এই বিলে সম্মতি প্রদান করেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সব সন্দেহের অবসান ঘটে। এই আইনকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আইনটির বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবে ১৯২১ সালের ১ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’।
১৯২১ সালে ৩টি অনুষদের অধীনে (বিজ্ঞান, কলা ও আইন) ১২টি বিভাগ ও ৮৪৭ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে স্যার সলিমুল্লাহর দান করা ৬০০ একর জমিতেই ১৯২১ সালে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে প্রতিবাদী চেতনার বিকাশ ঘটতে দেখা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কেন্দ্র করে এই অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটতে থাকে। ১৯২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে গঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ। ছাত্র সংসদ ভূমিকা রাখে ছাত্রদের বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামকে সংগঠিত করতে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত সংঘটিত ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু ভাষা আন্দোলন নয়, বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিটি আন্দোলনেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে এসেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাই। ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সাধারণত দেশ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করে, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ তৈরি করেছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৯০’র গণতান্ত্রিক আন্দোলনও এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতারই অংশ।###
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।