Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এরদোগান-বাইডেন বৈঠক, সম্পর্কে জট খোলার সুস্পষ্ট লক্ষণ নেই

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৫ জুন, ২০২১, ৭:৪২ পিএম

ব্রাসেলসে সোমবার মুখোমুখি বসেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান। নেটো সামরিক জোটের শীর্ষ বৈঠকের ফাঁকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিপজ্জনক ক্রমাবনতি ঠেকাতে দুই নেতা মুখোমুখি হন।

প্রায় ঘণ্টাখানেক এই দুই প্রেসিডেন্ট একান্তে বসে কথা বলেছেন। পরে দু’জনেই পৃথক পৃথক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সম্পর্ক উন্নয়নে তাদের মধ্যে ‘ফলপ্রসূ, গঠনমূলক’ আলোচনা হয়েছে। এরদোগান এমন মন্তব্যও করেছেন যে, এমন কোন বিষয় তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে থাকতে পারে না, যার কোনও সমাধান নেই। কিন্তু সিরিয়ায় কুর্দি মিলিশিয়াদের প্রতি মার্কিন সমর্থন কিংবা তুরস্কে রাশিয়ায় তৈরি ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা মোতায়েন করার মত স্পর্শকাতর যেসব ইস্যুতে এক সময়কার ঘনিষ্ঠ দুই মিত্র দেশের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে, সেগুলোতে কোন আপোষ-রফা হয়েছে কি-না বা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে কি-না, তার কোন সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি ওই বৈঠকের পর।

বৈঠক নিয়ে জো বাইডেন কথা বলেছেন খুবই সামান্য। রাতে তার সংবাদ সম্মেলনে তিনি বুধবার রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে তার আসন্ন বৈঠক নিয়ে কথা বলতে তিনি যতটা সময় ব্যয় করেছেন, তার ছিটেফোঁটাও তিনি ব্যয় করেননি এরদোগানের সঙ্গে তার বৈঠক নিয়ে কথা বলতে। সেই তুলনায় প্রেসিডেন্ট এরদোগান বরং ছিলেন কিছুটা খোলামেলা। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি যেসব বিষয়ে আমাদের মতবিরোধ রয়েছে, তা নিয়েও কথা বলেছি।’ তিনি ইঙ্গিত দেন যে সিরিয়ায় কুর্দি মিলিশিয়া গোষ্ঠী ওয়াইপিজিকে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থন নিয়ে তুরস্কের আপত্তির কথা তিনি বলেছেন। ‘সন্ত্রাস দমনে দ্বৈত নীতি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এক সন্ত্রাসীকে দমনে আরেক সন্ত্রাসীকে সমর্থন করা যায় না।’ কিন্তু ওয়াইপিজির প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার নিয়ে বাইডেন কোন প্রতিশ্রুতি তাকে দিয়েছেন কি-না, তা অবশ্য বলেননি এরদোগান।

সৈন্য সংখ্যার বিচারে তুরস্ক নেটো জোটের দুই নম্বর সামরিক শক্তি। তুরস্কে নেটো এবং আমেরিকার একাধিক সামরিক ঘাঁটি রয়েছে, যেখানে পারমানবিক অস্ত্র পর্যন্ত মোতায়েন করা রয়েছে। কিন্তু সামরিক এই ঘনিষ্ঠতা সত্ত্বেও দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরে, এবং কেউই আশা করেননি যে একটি বৈঠকেই জমাট বাধা বরফ মুহূর্তে ম্যাজিকের মত গলে যাবে। বৈঠকের আগে লন্ডন-ভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টেনিও তাদের এক পর্যবেক্ষণ রিপোর্টে বলেছিল যে দুই নেতার কেউই এখন অন্যকে চটাতে চাইবেন না এটা ঠিক, কিন্তু বৈঠক থেকে এরদোগান গুরুত্বপূর্ণ কিছু সুবিধা অর্জন করবেন, সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ‘বড় কোন সমস্যার কোন ধরণের সুরাহা এই বৈঠক থেকে হবে না - যার অর্থ যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক সম্পর্কে উত্তেজনা চলতে থাকবে।’

কিছু পর্যবেক্ষক অনেকটা একই কথা বলেছেন - তাদের যুক্তি, দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চলমান সংকটের পেছনের কারণগুলো খুবই স্পর্শকাতর। এর পেছনে জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় নিরাপত্তা এবং এরদোগানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে। তুরস্কে ২০১৬ সালের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে এরদোগানের মধ্যে সন্দেহ ঢুকেছে যে আমেরিকা এবং কয়েকটি পশ্চিমা দেশ তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে তৎপর। তার এই সন্দেহ এবং ক্ষোভ সরাসরি প্রকাশ পায় যখন আমেরিকার শত নিষেধ-আপত্তি সত্ত্বেও ২০১৯ সালে এরদোগান রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেনেন।

আমেরিকার কথা, নেটো জোটের কোনও দেশে - বিশেষ করে যেখানে মার্কিন বিমানঘাঁটি এবং মার্কিন পারমানবিক অস্ত্র মোতায়েন রয়েছে - কোন রুশ কৌশলগত অস্ত্র মোতায়েন করা হলে জোটের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে। তুরস্ক অবশ্য সব সময় বলে আসছে যে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশ্রুতি মত প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা বিক্রি না করায় তাদেরকে বাধ্য হয়েই রাশিয়ার কাছে যেতে হয়েছে। কিন্তু আমেরিকা এবং নেটো জোটের অনেক সদস্যের কাছে তুরস্কের ওই সিদ্ধান্ত ছিল মিত্রদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। শাস্তি দিতে আমেরিকা তুরস্কের কাছে ১০০ অত্যাধুনিক এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রির চুক্তি বাতিল করে দেয়। সিরিয়ায় কুর্দি মিলিশিয়া গোষ্ঠী ওয়াইপিজি’র প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরও চটে যায়, কারণ তুরস্ক ওয়াইপিজি’কে তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী পিকেকে’র সহযোগী হিসাবে দেখে।

এরদোগান ও বাইডেন অনেকদিন ধরেই এক অন্যকে চেনেন। ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে ২০১১ সালে ব্যবসা বিষয়ক আন্তর্জাতিক বৈঠকে যোগ দিতে বাইডেন যখন তুরস্কে যান, এরদোগান তখন অসুস্থ ছিলেন। তাকে দেখতে আঙ্কারায় তুরস্কের প্রেসিডেন্টের বাড়িতে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন বাইডেন। খুব অল্প সময় থাকার কথা থাকলেও দু’ঘণ্টা ধরে তারা দু’জন কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই উষ্ণতা এখন ইতিহাস। ২০২০ সালে তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় সংবাদপত্রে এক সাক্ষাৎকারে বাইডেন তুর্কি প্রেসিডেন্টকে একজন ‘স্বৈরাচারী’ হিসেবে অবিহিত করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিৎ তুরস্কে তার বিরোধীদের সমর্থন করা।

স্বভাবতই এসব কথা পছন্দ হয়নি তুরস্কের নেতার। নির্বাচনে জেতার পর বাইডেনকে অভিনন্দন জানাতে রাশিয়ার পুতিন বা চীনের শি জিনপিংয়ের মত পাঁচদিন সময় নেন এরদোগান। তুরস্ক নেটো জোটের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হলেও ক্ষমতা নেয়ার পর এরদোগানের সাথে কথা বলতে তিন মাস সময় নেন বাইডেন। এপ্রিলে যখন প্রথম তিনি এরদোগানকে ফোন করেন, তখন সেই আলাপ মোটেও সুখকর ছিল না। বাইডেন সেদিনই এরদোগানকে জানান যে তিনি অটোম্যান শাসন আমলে ঘটা আর্মেনিয়ায় গণহত্যার অভিযোগকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন।

তবে সোমবারের বৈঠকের আগে দুই শিবির থেকেই সতর্ক কথাবার্তা শোনা গেছে। এরদোগান রোববার বলেন, তিনি পুরনো সমস্যা পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চান, তবে বাইডেনের মুখ থেকে ‘কোন পূর্বশর্ত’ শুনতে তিনি আগ্রহী নন। পর্যবেক্ষকরা মতে, কোভিড মহামারির জেরে তুরস্কের অর্থনীতি প্রচণ্ড চাপে পড়েছে এবং এরদোগান মনে করছেন যে এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমেরিকা এবং পশ্চিমাদের সাহায্য-সমর্থন জরুরি।

তবে তার আপোষের ইঙ্গিতে বাইডেন প্রত্যাশামত সাড়া না দিলেও এরদোগানের হাতে এখনও বেশ কিছু তুরুপের তাস রয়েছে। এর একটি আফগানিস্তান। সোমবারের বৈঠকে এরদোগান আমেরিকানদের বলেছেন ‘মিত্রদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক সহযোগিতা’ পেলে তুরস্ক আফগানিস্তানে সামরিক উপস্থিতি অব্যাহত রাখবে। এক্ষেত্রে, পাকিস্তানের সাথে সমন্বয় করবে তারা। জানা গেছে, নেটো সৈন্য প্রত্যাহারের পর বিশেষ করে কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিধানে বেশ ক’মাস আগে তুরস্কের সাহায্য চেয়েছিলেন আফগান বিষয়ক মার্কিন দূত যালমে খালিলযাদ। তালেবান অবশ্য বলেছে যে, অন্যান্য নেটো দেশের মত তুরস্কের সেনাবাহিনীকেও আফগানিস্তান ছাড়তে হবে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তালেবানের এই আপত্তি তুরস্ককে আমেরিকার সাথে আপোষ-মীমাংসায় বাড়তি সুবিধা দিতে পারে।

এছাড়া, লিবিয়ায় স্থিতিশীলতা ফেরাতে তুরস্ক সম্প্রতি তাদের সক্ষমতা দেখিয়েছে - যা আমেরিকার দৃষ্টি কেড়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, তুরস্কে মার্কিন বিমান বাহিনীর একাধিক ঘাঁটি রয়েছে - যার ভেতর এক ইনজিলিক বিমান ঘাঁটিতে ৫ হাজারের মত মার্কিন সেনা এবং ৫০টির মত পারমানবিক অস্ত্র মোতায়েন করা আছে। পঞ্চাশের দশক থেকে আমেরিকা এবং নেটো মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ায়, এমনকি আফগানিস্তানে তাদের সামরিক অভিযানগুলোয় তুরস্কের এই ঘাঁটিকে ব্যবহার করে আসছে।

এরদোগান একাধিকবার এমন হুমকি দিয়েছেন যে ইনজিলিক বিমানঘাঁটি থেকে মার্কিন বিমান বাহিনীর ইউনিটকে তিনি বের করে দেবেন। শেষবার তিনি এই হুমকি দিয়েছেন আর্মেনিয়ায় গণহত্যার অভিযোগকে যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়ার পর। সুতরাং বেশি চাপ দিলে এরদোগান এবং তুরস্ক বিগড়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও আমেরিকার কোনও কোনও মহলের মধ্যে রয়েছে।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজে) তুরস্ক প্রকল্পের প্রধান নিগার গোসেলকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ‘এরদোগানকে ক্রমাগত শায়েস্তা করে তুরস্ককে কি সাথে রাখতে পারবে আমেরিকা?’ বেশি চাপাচাপি করলে এরদোগান আরও বেশি করে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়তে পারেন, অর্থনীতিতে সাহায্যের জন্য চীনের কাছে ঘেঁষতে পারেন। এফ-৩৫ বিমান না পেলে এক সময় তিনি হয়তো রাশিয়ার সুখয় বিমান কিনবেন - এসব সম্ভাবনার কথা পশ্চিমা দেশের বিশ্লেষক মহলে হরদম আলোচনা হচ্ছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ