Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ঝঞ্ঝা মৌসুমের ৬৫ দিন সাগরে মৎস্য আহরন নিষেধাজ্ঞায় মাছের উৎপাদন বাড়ছে

নিষেধাজ্ঞার সময়ে ৩ লাখ জেলে পরিবারের জন্য খাদ্য সহায়তা

বরিশাল ব্যুরো | প্রকাশের সময় : ২২ মে, ২০২১, ২:৪৪ পিএম | আপডেট : ২:৫৩ পিএম, ২২ মে, ২০২১


নাছিম উল আলম/ সমুদ্র এলাকায় ৬৫ দিন সব ধরনের মৎস্য আহরনে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ায় দেশের সামুদ্রিক জলাশয়ে গত কয়েক বছরে মাছের উৎপাদন প্রায় এক লাখ টন বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের মৎস্য সম্পদে সামুদ্রিক মাছের অবদান প্রায় ৮Ñ১০%। বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য সহ চিংড়ির প্রজনন প্রক্রিয়া নিরাপদ ও নিশ্চিত করন এবং আহরন প্রবৃদ্ধি টেকসই করার লক্ষ্যে, সরকার বঙ্গাপসাগরে দেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই সব ধরনের বানিজ্যিক মাছধরা নৌযানে মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ করেছে। যদিও বিষয়টি জেলে ও মৎস্যজীবীদের মধ্যে কিছুটা বিরূপ মনোভাব তৈরী করেছে, তবুও দেশের মৎস্য সম্পদ সমৃদ্ধ করা সহ জেলে ও মৎস্য জীবীদের ভবিষ্যত জীবন-জীবীকা নিরাপদ করার লক্ষেই এ পদক্ষেপ বলে মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে।

আহরন নিষিদ্ধকালীন এ সময়ে উপক’লের ২ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯৫ জেলে পরিবারকে মাথাপিছু ৫৬ কেজি করে মোট ১৬ হাজার ৭২১ টন চাল বিতরন করা হবে। যারমধ্যে বরিশাল বিভাগের ১ লাখ ৪৬ হাজর ৫৪৩ জন জেলেও সমপরিমান খাদ্য সহায়তা পচ্ছে।
বিভিন্ন বৈশিষ্ট ও বৈচিত্রপূর্ণ মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ বঙ্গোপসাগর বিশে^র একমাত্র উপসাগর যেখানে সবচেয়ে বেশী নদী বিধৌত পানি প্রবেস করে। দক্ষিণ-পশ্চিমের সাতক্ষিরা থেকে পূর্ব-দক্ষিণের টেকনাফ পর্যন্ত ৭১০ কিলোমিটার উপক’লীয় তটরেখা এবং সমুদ্রের ২শ নটিক্যল মাইল পর্যন্ত ‘একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা’র পরিমান ১ লাখ ১৮ হজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার। ছোট-বড় নানা আকার-প্রকারের ৪৭৫ প্রজতির মৎস্য সম্পদ ছাড়াও ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া, ৫ প্রজাতির কচ্ছপ ও ১৩ প্রজাতির প্রবাল সহ বিভিন্ন জলজ সম্পদে সমৃদ্ধ আমাদের সমুদ্র এলাকা।
কিন্তু সম্প্রতিককালে বিশ^ব্যাপী সামুদ্রিক ও উপক’লীয় মৎস্য সম্পদ অতি আহরন জনিত ক্রমহ্রাসমানতা, ভ’মি ও সমুদ্র হতে সৃষ্ট দুষণ এবং জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন সহ নানামুখি সংকটের সম্মুখিন। ফলে মৎস্যকুলের প্রাচুর্য, বিস্তৃতি ও প্রজাতির ওপর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমাদের সমুদ্রিক ও উপক’লীয় মৎস্য স¤পদও এর বাইরে নয়।
বিশে^র সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ অসীম হলেও অফুরন্ত নয়। তাই সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদ ব্যবস্থাপনায় সম্ভাব্য সকল ঝুকি ও অনিশ্চয়তাকে বিবেচনায় নিয়ে বিগত বছরগুলোতে আহরন পরিমান বৃদ্ধি পেলেও প্রজাতির গুনগতমান অবনমন লক্ষ্য করেছেন বিজ্ঞানীগন। এরফলে মৎস্য সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল বিভিন্নস্তরের অংশীজনের মাছের সিমিত সম্পদ নিয়ে অসম প্রতিযোগীতা এবং আয় বৈষম্যও লক্ষ্যণীয়।
মৎস্য বিজ্ঞানীগন বিশাল এলাকার জলরাশির মৎস্য সম্পদ সংরক্ষন, ব্যবস্থাপনা এবং সুষ্ঠু ও বিজ্ঞানসম্মত সহনশীল আহরন নিশ্চিত করে বছরের পর বছর সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন অব্যাহত এবং বংশ বৃদ্ধি ও মজুদ অক্ষুন্ন রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীগন আমাদের একান্ত বাস্তবতা ও পরিবেশকে বিবেচনায় নিয়ে সামুদ্রিক মৎস্য ব্যবস্থাপনা নীতি ও কৌশল প্রণয়ন অত্যাবশ্যক বলেও মনে করছেন।
সমুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ১৯৮৩-এর ১৯ নম্বর বিধি অনুযায়ী সামুদ্রিক ও উপক’লীয় মৎস্য আহরন প্রবৃদ্ধি টেকসই করার লক্ষে প্রজ্ঞাপন জারীর মাধ্যমে প্রতিবছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত এ আহরন নিষিদ্ধ করা হচ্ছে । ২০১৫ সাল থেকে ’১৮ সাল পর্যন্ত কার্যক্রমটি শুধুমাত্র বাণিজ্যিক ট্রলারের ক্ষেত্রে কার্যকর হলেও ২০১৯ সাল থেকে তা সব মৎস্য নৌযানের ক্ষেত্রেই কার্যকর হয়েছে। এছাড়াও প্রতিবছর আশি^নের বড় পূর্ণিমার আগে-পরের ২২ দিন উপক’লের ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটারে মূল প্রজনন ক্ষেত্রে সব ধরনের মৎস্য আহরন সহ দেশের অভ্যন্তরীন ও উপক’লীয় নদ-নদীতে ইলিশ আহরন নিষিদ্ধের ফলে গত দুই দশকে জাতীয় এ মাছের উৎপাদন প্রায় তিনগুন বৃদ্ধি পেয়েছে।
কিন্তু সাগর ও উপক’লে ঝড়Ñঝঞ্ঝার মৌসুমে ৬৫ দিন মাছাধরা নিষিদ্ধ ঘোষনার বিষয়টি নিয়ে উপক’লের বিশাল জেলে ও মৎস্যজীবীদের মাঝে যথেষ্ঠ বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এমনকি গনমাধ্যম কর্মীদের মধ্যেও বিষয়টি নিয়ে ভ’ল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে। জেলে ও মৎস্যজীবীদের অভিযোগ, বাংলদেশের সমুদ্র এলাকায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকলেও এসময়ে ভারতে নিষিদ্ধ না থকায় সেদেশের জেলরা অবাধে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেস করে মাছ লুটে নিচ্ছে।
তবে মৎস্য বিজ্ঞানীগন এক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশের সাথে সমতা রেখে সাগরে মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ ঘোষনার সময় পুণঃ বিবেচনার কথা বলেছেন। ভারতে সর্বপ্রথমে ১৯৮৮ সালে ১৫ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্রে মৎস্য আহরন নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০০ সাল থেকে দেশটির পূর্ব উপক’ল, অর্র্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে বঙ্গোপসগরের জলসীমায় ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে। আমাদের অপর প্রতিবেশী মিয়ানমারেও জুন থেকে আগষ্ট পর্যন্ত সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে।
মৎস্য বিজ্ঞানীদের মতে, বন্ধ মৌসুম কার্যকর হবার আগে অর্থাৎ ২০১২-১৩ থেকে ’১৪-১৫ সময়ের তুলনায় ২০১৫-১৬ থেকে ’১৭-১৮ পর্যন্ত বানিজ্যিক ট্রলার থেকে আহরিত মাছের ক্যাচলগ পর্যালোচনায় মৎস্য আহরনের পরিমান বৃদ্ধি পাবার সুস্পষ্ট প্রবনতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এ ব্যাপারে দেশের বিশিষ্ট মৎস্য বিজ্ঞানী ও মৎস্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক(সামুদ্রিক) ড. মোঃ আবুল হাসনাত জানান, নির্দিষ্ট সময়ে মাছধরা বন্ধ রাখা সামুদ্রিক মৎস্য সম্পদের কার্যকরি ব্যবস্থাপনার একটি সহজ ও অত্যন্ত ফলদায়ক পদ্ধতি। যা বিশে^র বিভিন্ন দেশে বাস্তবায়ন হচ্ছে। জাতীসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা-ফাও’এ বর্তমানে কর্মরত ড. হাসনাত সমুদ্রে আহরন নিষেধাজ্ঞার সময়কাল প্রতিবেশী দেশের সাথে সমন্বয় করে নির্ধারনের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
এদিকে মৎস্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানেও সমুদ্রে মৎস্য আহরনে নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের পরের বছরগুলোতে মাছের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দেশে উৎপাদিত ৪৩ লাখ ৮৪ হাজার টন মাছের মধ্যে সামুদ্রিক জলাশয়ে উৎপাদন ছিল প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার টন। এসময়ে প্রায় ৭৩ হাজার টন মাছ রপ্তানি করে দেশ আয় করেছে প্রায় ৪ হজার ২৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সহায়তা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ