Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তুলতুলির ঈদ

প্রকাশের সময় : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

রহিমা আক্তার মৌ
রমজানের প্রায় দুই মাস আগে তুলতুলি শহরে আসে। এটাই ওর প্রথম আসা। ওই দুই মাসে আশেপাশের অনেকের সাথে তুলতুলির ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। রমজানকে আর ঈদকে সামনে রেখে গ্রামের খেটে খাওয়া অনেকে শহরের দিকে পা বাড়ায়। তুলতুলিদের গ্রামের অনেকেই এভাবে আসে।
এই এলাকায় ওই অঞ্চলের অনেক মানুষ আছে, যারা বিভিন্ন বাড়ির দারোয়ান। কারো বাঁধা বুয়া কারো কারো দুটা বুয়া। তার সাথে রয়েছে বিভিন্ন গাড়ির ড্রাইভারও। ঈদকে সামনের করে তুলতুলির পরিবার আসেনি। ৪/৫ মাস আগে ওর বাবা অজুফাদের বাড়ির দারোয়ানের কাজ পায়। সেভাবেই তুলিরা শহরে আসে। দেখতে ছোটখাটো হলেও কথায় তার খই ফুটে। তবে সে সবার সাথে খই ফোটা কথা বলে না।
শহরের মানুষের শপিং করার কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। তুলতুলির ধারণা, শহরের মানুষের অনেক টাকা। অবশ্য কথাটা একেবারে মিথ্যেও নয়। শহরের টাকা আছে বলে এখানে এসে বিভিন্ন কাজ করতে পারে গ্রামের মানুষগুলো। অজপাড়াগাঁয়ে তো কেউ ঘরে বাঁধা বা ছুটা কাজের লোক রাখে না। বাড়ি পাহারা দেবার জন্য দারোয়ান আর গাড়ি চালানোর জন্যও ড্রাইভার রাখে না।
দিনের বেশির ভাগ সময় তুলতুলি গ্যারেজ আর বাসার সামনের রাস্তায় থাকে। কখন কোন বাসা থেকে কে বের হয়। হাতে করে কি নিয়ে যায়। কি নিয়ে ফিরে তার সব দেখে তুলতুলি। ওর ধারণা সবাই মার্কেটে যায় আর শপিং করে ফিরে। ওর নানী হালিমা খাতুন মাঝে মাঝে নীলাদের জামাকাপড় ভাঁজ করে। পাশে দাঁড়িয়ে তা দেখে তুলতুলি। কখনো কখনো বলেই বসে, নানী এদের এত্ত কাপড়।
হালিমা খাতুন তুলতুলির মুখ চেপে ধরে। বলতে বলতে সে আবার কি বলে বসে। পরে নীলা ম্যাডাম ভাববে ওকে হয়তো হালিমা শিখিয়ে দিয়েছে।
তুলতুলিদের বাড়ির মালিকিনী অজুফার আম্মু দশ রমজানের দিকে মার্কেট থেকে ফিরে তুলতুলিদের সবাইকে ডাকে। এক এক করে ঈদের জামাগুলো সবাইকে দেয়। অজুফার আম্মু তুলতুলির জন্য তিন সেট জামা নিয়ে আসে। জামা হাতে নিয়ে সে তো মহাখুশি। জামাগুলো পাওয়ার পর থেকে ও মনে মনে ঈদকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনতে থাকে। কখন কোন জামা পরবে। কখন কার বাসায় যাবে। কী খাবে এই সব কিছু।
আঠারো রজমানের দিন নীলা শপিং-এ যায়। তুলতুলি ও তার ভাইদের জন্যে জামাকাপড় নিয়ে আসে। তবে ওর মা, নানা-নানীর জন্য কিছু না কিনে নগদ টাকা তুলে দেয়। তুলতুলিকে ডেকে নতুন জামা দেখায়। জামাটা বিভিন্ন রংয়ের সংমিশ্রণে। তুলতুলিকে একেবারে বাগানে ফুটে থাকা ফুলের মতো দেখাবে। এই জামাটা পেয়ে তুলতুলি বলে, আফা আমার না ফাচটা জামা হয়েছে। আচ্ছা ঈদ আইতে আর কতদিন।
আরো ১১ দিন। কেন ঈদ দিয়ে কী হবে।
না দেখলাম, আরো জামা আইব কিনা। তয় এত জামা দেইখা আব্বা কইছে, আর জামা দিব না।
আফা কাইল সকালে আমি আফনারে ওই জামাগুলোও দেখাব।
ঠিক আছে নিয়ে আসিস। তবে তোর মাকে বলে আনবি কিন্তু।  হ, তা তো আম্মারে কইমু।
পর দিন সকালে তুলতুলি সব জামা নিয়ে আসে নীলার কাছে। নিজের হাতে সব খুলে দেখায়।
দেহেন আফা সব জামার মধ্যে আফনের দেয়া জামাটা বেশি সুন্দর।
দূর, কে বলছে, দেখ, সবই সুন্দর।
ইস, আফা আফনে যে কি কন, সবগুলোর চেয়ে আফনেরডাই সুন্দর।
নীলাও দেখে বুঝে যে দামে নীলা এই জামাটা কিনেছে সে দামে ইচ্ছে করলে ৩টা জামা কিনতে পারত। তবে সেগুলো বেশি টেকসই হতো না। তবুও সবগুলো জামার প্রশংসা করে।
আফা আই ঈদের দিন সকালে আফনার দেয়া জামাডাই পরুম।
আচ্ছা, তাই নাকি। তারপর কোনটা পরবি।
তুলতুলি এক এক করে জামা দেখায় আর বলে ওটা দুপুরে এডা বিকালে। আর এডা রাতে। ওম্মা, আফা তাইলে এডা কহন পরুম।
কেন? কাল সকালে পরবি।
কি কন আফনে, কাইল ঈদ থাকব।
থাকবো থাকবো, শহরে ঈদ তিন দিন থাকে, বুঝলি। কনকি আফা। তাইলে আই কোনডা কোন দিন পরুম। সেটা তোর ইচ্ছা। তুই কি জানিস, নতুন জামা পরে সালাম দিলে বখশিশ পাওয়া যায়।
বখশিশ মানে।
আরে বখশিশ মানে টাকা।
আমি যে জামাটা দিয়েছি, তুই এটা পরে আমাকে সালাম করলেই টাকা দিব।
ও বুইজ্জি। দেশে আংগোরে ঈদের দিন টাহা দিত।
ঠিক আছে, তুই ঈদের দিন এটা পরে আসিস। এখানে নাস্তা করবি। আমি তোকে বখশিশ দিব।
তুলতুলি চলে যায়। একটা একটা করে রোজা শেষ হচ্ছে। ওর পুরো পরিবার ঢাকায় ঈদ করবে। সবাই  ছুটি পেলেও তুলতুলির নানা কামাল ছুটি পাবে না। হালিমাসহ সবার ইচ্ছে গ্রামে গিয়ে ঈদ করবে। মেয়েজামাই শহরে থাকে, ঈদ করতে গ্রামে যাবেÑ এটা অন্য রকম আনন্দ। ২৮ রোজায় কামাল বাড়ির মালিককে বলে ৩/৪ দিনের জন্য ছুটি নেয়। ওরা ২৯ রোজায় গ্রামে যাবে। এই কথা শোনার পর তুলতুলি দৌড়ে নীলার বাসায় আসে। আফা আফা, নানা-নানী সবাই বাড়ি যাইব। আই কিন্তু যামু না।
আরে বোকা, সবাই যাবে তুই যাবি না কেন?
আই আম্মারে কইয়া দিছি, আই যামু না। আই কিন্তু রাইতে হলাই যামু।
তুলতুলি এগুলো বলতে হয় না। শহর খুব খারাপ একবার হারিয়ে গেলে আর কিন্তু আসতে পারবি না। হেইডা আই জানি না। আই কিন্তু এহানেই ঈদ করুম।
ঠিক আছে। তোর নানীকে আসতে বল। আমি জিজ্ঞাসা করি।
তুলতুলি দৌড়ে বাসা থেকে নেমে যায়। একটু পর হালিমা আসে।
আফা, আন্নে নাকি আমাকে ডাকছেন।
হ্যাঁ, হালিমা তোমরা নাকি ঈদে বাড়ি যাবে।
হ, আফা, আফনের ভাই ছুটি চাইছে। ৪ দিনের ছুটি পাইছে। তাই সবাই যামু। ঈদের দুই দিন পর চলে আসুম।
তুলতুলি নাকি যাবে না।
হ, হে তো হুইনাই কইতাছে যাইব না। হে নাকি আফনের কাছে থাকব।
আমাকে এসেও বলেছে। আমি তো বুঝিয়ে দিয়েছি। ঠিক আছে যাবার আগে ওকে নিয়ে এসো আবার বলে দিব।
২৯ রজমান দুপুরের ট্রেনে যাবে ওরা। সকালে হালিমা তুলতুলিকে নিয়ে আসে।
কিরে তুলতুলি যাচ্ছিস। যা, বাড়ি ঘুরে আয়।
আই যামু না।
কেন? আই নতুন জামা গায়ে দিয়ে আফনারে সালাম করমু। ও এই কথা, ঠিক আছে, তুই ঘুরে এসে সালাম করিস।
তহন তো জামা পুরান হইব।
হইলে কী হবে। আমি বলছি তুই পরেই সালাম করিস।
না না তা হইব না।
কি হইব না।
আফনে না কইলেন নতুন জামা পরে সালাম করলে খবিস দিবেন।
মানে।
ওই যে ওই দিন কইলেন।
হা-হা-হা। খবিস না বখশিশ। ঠিক আছে। তুই ফিরে এলেই দিব।
চুপ করে আছে তুলতুলি। নীলা ভিতরের রুমে যায়। নতুন কচকচে কিছু নোট এনে দেয় তুলতুলির হাতে। মিষ্টি করে হাসি দেয় তুলতুলি। ঈদের ৩ দিন পরে তুলতুলির আবার শহরে আসা। আসার সময়ে নীলার দেওয়া জামাটা পরে আসে।




 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: তুলতুলির ঈদ

১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
আরও পড়ুন