কোরবানির আসল মানে
মুস্তাফা জামান আব্বাসীগরুর যে অংশটি গরিবের প্রাপ্য তার ডিস্ট্রিবিউশন সম্পর্কে। এ নিয়ে কেউ ভাবিনি। এ
অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ুম
সংস্কৃতি বা তমদ্দুন একটি জাতির আত্মপরিচয়ের দর্পণ। বাংলাদেশের প্রায় নব্বই ভাগ মানুষ মুসলিম। এই বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি যেসব উপাদান দ্বারা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে তার মধ্যে কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা অন্যতম। মুসলিম দুনিয়ায় ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতগণ তার জন্মদিনকেও যে ঈদ হিসেবে পালন করে আসছে তাকে বলা হয় ঈদে মিলাদুন্নবী।
কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা পালিত হয় প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বপুরুষ হযরত ইবরাহীম আলাইহি ওয়া সাল্লামের পূর্বপুরুষ হযরত ইবরাহীম আলাইহি সালাম ও হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামের কোরবানির ঘটনার স্মারক হিসেবে। বাংলাদেশে ইসলাম যেদিন এসেছে সেদিন থেকেই ইসলামী অনুশাসন ও উৎসবাদী এদেশের ইসলাম গ্রহণকারী সৌভাগ্যবান মানুষগুলো পালন করে আসছে। বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ তার মূল অনুশাসন বজায় রেখে আপন মহিমায় ভাস্বর, সেই সঙ্গে এর মধ্যে এক অনন্য রুচিনীতি বা সাংস্কৃতিক কাঠামো সংস্থাপিত হয়েছে, যা কোরবানির মূল অনুশাসনের সাথে সংঘর্ষ তো ঘটায়নি বরং তাকে সমুন্নত করেছে নতুন মাত্রায় আনন্দ সৌকর্য শোভিত করে। কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহতে নিবেদিত প্রাণ হওয়া। আমার সালাত ও আমার কোরবানি এবং আমার জীবন ও আমার মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য এই দৃঢ়প্রত্যয়ে বলীয়ান বাংলাদেশের মানুষ ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদকে পালন করে আসছে।
বাংলাদেশে কোরবানির ঈদ আসার মাসখানেক আগে থেকেই প্রস্তুতি চলে কোরবানি দেয়ার জন্য পশু খরিদ করার। কোরবানির পশুর হাট শহরে নগরে বিশেষ সাজে-সজ্জিত হয়ে বসে। কোথাও কোথাও তো বড় বড় তোরণ নির্মাণ করে ও ঝালরযুক্ত শামিয়ানা টাঙিয়ে এবং আলোকসজ্জায় সজ্জিত করে ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ ছাড়াও দেয়ালে দেয়ালে বিরাট বিরাট পোস্টারও টাঙানো হয়, ব্যানার, ফেস্টুন স্থাপন করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে কোরবানির পশুর গলায় কাপড়ের ঝালর কিংবা ফুলের মালা পরানো হয়। ঈদের দিন যত ঘনিয়ে আসতে থাকে তত পশু কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে ঈদের আনন্দ যেন পশু খরিদের সাথে সাথে একাত্ম হয়ে যয়। সবার অজান্তে জাগ্রত হয়ে ওঠে মন গভীরে কোরবানির চেতনা। তবে একশ্রেণীর বড়লোকী দেখানোর মানসিকতাসম্পন্ন মানুষ চড়া দামে পশু কিনে নাম জাহিরের যে চেষ্টা করে তা কোরবানির মূল উদ্দেশ্যের সাথে সাযুজ্যপূর্ণময় বরং কোরবানির উদ্দেশ্যটিকে বেশ কিছুটা ক্ষুণœই করে। ঈদুল ফিতরের পূর্বে নতুন পোশাকাদির প্রতি যেমন আকর্ষণ থাকে ঈদুল আজহাতে তেমনটা আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায় না, বরং সামর্থ্যবানরা কোরবানির পশু খরিদের উদ্যোগে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যারা পশু খরিদ করতে অপারগ তথা দরিদ্র শ্রেণীর মানুষও গোশতের ভাগ পাবেন এই আশা পোষণ করে ঈদের আনন্দকে লালন করেন। বাংলাদেশে গরু কিংবা ছাগল কোরবানি দেয়া হয়। তবে গরু কোরবানিই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেয়া হয়। এতে সুবিধাটা হচ্ছে সাতজন ভাগে এটা দেয়া যায়। গরু কোরবানির ঝোঁক বেশি থাকার আরেকটি কারণ হচ্ছেÑ এই গরু কোরবানির কারণে এখানকার মুসলমানদের ভীষণভাবে নাজেহাল হতে হয়েছে এবং শহীদও হতে হয়েছে। সিলেটের রাজা গৌর গোবিন্দ গরু কোরবানির অপরাধে সুফি বুরহানুদ্দীনের শিশু পুত্রকে হত্যা করে এবং তাকে ভীষণভাবে প্রহার করে আধা পঙ্গু করে দেয়। এ খবর পেয়ে সিপাহসালার নাসিরুদ্দীনের নেতৃত্বে গৌরগোবিন্দের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধ পরিচালিত হয়। এ সময় হযরত শাহজালাল ইয়েমনী রহমাতুল্লাহি আলাইহিও নাসিরুদ্দীনের বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে ৩৬০ জন সুফি নিয়ে এখানে আগমন করেন। গৌরগোবিন্দ পরাজিত হয়ে কারো মতে আসামের জঙ্গলে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করে। আবার কারো মতে, সসৈন্যে নিহত হয়। সিলেটে ইসলামের বিজয় পতাকা যেদিন উড্ডীন হলো, সেদিন এখানে ইতিহাসের এক নবতর অধ্যায় সূচিত করল। সিলেট পরিণত হয়ে গেল ইসলামের রূহানী বিলায়েতের রাজধানী।
অন্যদিকে যদি আমরা বৃটিশ আমলের দিকে তাকাই তাহলে দেখব সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর যেসব কারণে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে গরু কোরবানি নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। সেকালে হিন্দু জমিদারদের জমিদারি এলাকায় গরু কোরবানি দেয়া নিষিদ্ধ ছিল। কেউ যদি গোপনে গরু কোরবানি দিত তাহলে তা জানতে পারলে তাকে অর্থ জরিমানাসহ দৈহিক নির্যাতন ভোগ করতে হতো। যে কারণে আমাদের সংস্কৃতিতে কোরবানির পশুর ক্ষেত্রে গরু কোরবানি প্রাধান্য পেয়েছে। কোরবানির পশুর গোশত তিন ভাগ করে একভাগ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দেয়া এবং পশুর চামড়া দান করে দেয়া আমাদের সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। কোরবানির ঈদের প্রায় এক মাস পরে আশুরা আসে। হযরত হুসাইন রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহু কারবালা প্রান্তরে ৬৮০ খৃস্টাব্দের ১০ মহররম সপরিবারে জান কোরবান করে ইসলামের ইতিহাসকে ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল করেন। কোরবানির ঈদও ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল। যে কারণে অনেক পরিবারে কোরবানির গোশত আশুরা পর্যন্ত সংরক্ষণ করা হয় ইমাম হুসাইন রাদি আল্লাহু তা’আলা আনহুর ইসালে সওয়াবের জন্য।
ঈদুল আজহা বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষের প্রাণ-স্পন্দনকে প্রবল শক্তির জোয়ারে দৃঢ়প্রত্যয়ী করে তোলে এবং অনুপ্রাণিত করে সাংস্কৃতিক নিজস্বতা ও ঐতিহ্যগত আদর্শ সংরক্ষণে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। ঈদুল আজহা শুধু বাংলাদেশের জাতীয় সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নয়, বিশ্ব মুসলিম সংস্কৃতিরও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বিশ্বের সমগ্র মুসলিম উম্মাহই এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। আজ সারা দুনিয়ায় ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে, তার প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় কবির ভাষায় বলি : ডুবে ইসলাম আসে আঁধার/ইবরাহীমের মতো আবার/কুরবানি দাও প্রিয় বিভব/জবীহুল্লাহ ছেলেরা হোক।
লেখক : মুফাসসিরে কোরআন, গবেষক, সাবেক পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।