পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসামে রাজ্য বিধান সভার ভোট চলাকালে তার এ সফরকে তার দেশের মানুষই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেনি। এছাড়াও বাংলাদেশে অনেক মানুষ তার সফরের বিরোধিতায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ, মিছিল করেছেন। এমনকি প্রতিবাদ সংশ্লিষ্ট ঘটনায় অনেক মানুষের প্রাণহানিও ঘটেছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে আনতে মরিয়া। শেষ অবধি তার এ সফর বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কী প্রভাব পড়তে পারে তা বিশ্লেষণ করেছেন বিবিসি বাংলার রাকিব হাসনাত। ইনকিলাব পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হ’ল:
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও দেশটির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে আসবেন এমন ঘোষণার পর থেকেই বিভিন্ন সংগঠন প্রতিবাদ শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে যেমন ছিল ইসলামপন্থী সংগঠন, তেমনি ছিল বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলোও। কিন্তু বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগও খুব একটা স্বস্তিতে ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেই যে স্বস্তিবোধ করছিল তা নয়। তারাও ছিল অস্বস্তিতে। ‘কারণ নরেন্দ্র মোদির চিন্তাধারার সাথে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা এক নয়। সে জায়গায় অস্বস্তিবোধ ছিলো। সে হিসেবে প্রতিবাদটাও ছিল স্বাভাবিক। বাম ডান সবাই প্রতিবাদ করেছে। ভারতও বুঝতে পেরেছে যে, বিজেপির রাজনীতির বিষয়ে বাংলাদেশের প্রচুর মানুষের দ্বিমত আছে। এবারের ঘটনায় আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে দু’ দেশের সরকারের পাশাপাশি জনগণের মধ্যেও সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন’। তবে এর জের ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগকে কতটা মূল্য দিতে হবে বা আদৌ কোনো মূল্য দিতে হবে কি?
ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, সেটি ভবিষ্যতের ওপরই নির্ভর করবে এবং কেন সব পক্ষ থেকেই এমন প্রতিক্রিয়া এল, সেটারও বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা দরকার। আর এসব পক্ষ বলতে মূলত বোঝানো হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাম ও ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত বা এর বাইরের কিছু দল ও সংগঠনকে, যারা মোদিবিরোধী অবস্থান নিয়েছিল।
সরকার সমর্থকদের অনেকে সে কারণেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছাত্র ইউনিয়নসহ বামপন্থী ধারার কয়েকটি সংগঠনকে ব্যঙ্গ করে কওমি ও কমিউনিস্ট শব্দ দুটিকে মিলিয়ে ‘কওমিনিস্ট’ আখ্যায়িত করে প্রচারণা চালিয়েছিল বলে মনে করছেন অনেকে। অর্থাৎ তারা বোঝাতে চেয়েছেন যে, আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে বাম ও ইসলামপন্থীরা এক হয়ে মোদিবিরোধী প্রচারণায় নেমেছিল।
তবে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি লূনা নূর বলছেন, তারা মি. মোদির বিরোধিতা করেছেন, কারণ তিনি এই উপমহাদেশে সা¤প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তার ঘটিয়েছেন যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে যায় না। ‘আমাদের বিরোধিতার জায়গাটা স্পষ্ট। নরেন্দ্র মোদি উগ্র সা¤প্রদায়িক ধর্মীয় গোষ্ঠীর নেতা। তিনি ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার জন্য নানা ধরনের ধর্মীয় শোষণ ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি নির্যাতন করছেন। এটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক ও বিরোধী। তার আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরের পূর্তির অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে যায় না। আওয়ামী লীগ তার ক্ষমতায় থাকার যে আঞ্চলিক ইকুয়েশন সেটিকে বিবেচনায় নিয়ে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে’।
তিনি বলেন, ইস্যু ও অবস্থান এক হলেও তাদের মোদিবিরোধী বিক্ষোভের সঙ্গে ডানপন্থী বা ইসলামপন্থীদের মোদিবিরোধী বিক্ষোভের কোনো যোগসূত্র নেই।
এর আগে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা তুরস্কের সুলেমান ডেমিরেলের মতো নেতারা। অথচ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিব জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের চ‚ড়ান্ত পর্বে অতিথি করা হল নরেন্দ্র মোদিকে যাকে ভারতে মুসলিমবিরোধী অবস্থানের জন্য বাংলাদেশে তীব্র সমালোচনা করেন অনেকে। সব কিছু মিলিয়ে শুধু মোদি বিরোধিতা নয় বরং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তীব্রতর হয়েছে ভারত বিরোধিতাও।
হেফাজতে ইসলামসহ অনেকগুলো ইসলামপন্থী সংগঠনও আগে থেকেই নরেন্দ্র মোদির সফরের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। মি. মোদির সফরের সময়ে যে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে সেখানেও এসেছে এসব ইসলামপন্থী সংগঠনের নাম। চট্টগ্রামের হাটহাজারি কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ব্যাপক বিক্ষোভের জের ধরে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে অন্তত বারোজন নিহতও হয়েছে। অথচ এই হেফাজতে ইসলাম অনেক দিন ধরেই সরকারের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেই চলছিল বলে মনে করা হয়।
এমনকি ২০১৮ সালে ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কওমি জননী আখ্যায়িত করা হয়েছিল কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীদের এক সমাবেশ থেকে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন হেফাজত ইসলামের তৎকালীন নেতা আহমদ শফি নিজেই।
তবে এবার প্রশ্ন উঠেছে যে, নরেন্দ্র মোদির সফরকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের সাথে তাদের বড় দূরত্ব তৈরি হলো কি-না। ইসলাম বিষয়ক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শরীফ মোহাম্মদ বলছেন, পুরো ঘটনায় সরকার বড় ঝুঁকি নিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
‘বিভিন্ন জায়গায় শুধুমাত্র মাদরাসার ছাত্র বা আলেমরা নয়, বরং সাধারণ মানুষও বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। সরকার একটা বড় ঝুঁকি নিল। মোদির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের তাজা রাগ অনেক বেশি। এখানে সরকার বিরোধী কিছু ছিল না।
‘আমার জানামতে প্রতিবাদকে সহিংস করার প্রস্তুতি কোন দলের ছিল না। কিন্তু একে দমিয়ে দেয়ার চেষ্টা এতো প্রকট হয়েছে, এত দুর্ঘটনা ঘটেছে, হতাহত হয়েছে। এটা সরকারের জন্য একটা কঠিন পরীক্ষা বা একটা কঠিন সময় যেতে পারে। তবে সরকার এটা নিয়ন্ত্রণও করে ফেলতে পারে বিভিন্ন ভাবে, বলেন শরীফ মোহাম্মদ।
ওদিকে বামপন্থী বা ডানপন্থী এসব সংগঠনের বাইরে সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে যারা পরিচিত বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলে যেসব বাম সংগঠন আছে তাদেরকেও মোদি ইস্যুতে সরকার বা আওয়ামী লীগের অবস্থানের পক্ষে কোন অবস্থান নিতে দেখা যায়নি। আবার সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির নেতারা মি. মোদির সাথে সাক্ষাত করলেও সফরের পক্ষে প্রকাশ্যে কোন অবস্থান তাদেরও নিতে দেখা যায়নি।
ওদিকে বিএনপির তরফ থেকে নরেন্দ্র মোদির সফরের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের প্রচারণার জন্য তিনি এসেছেন কি-না সে প্রশ্নও তোলেন তিনি। তবে বিরোধীরা যাই বলুক কিংবা বিভিন্ন ধারার দল বা সংগঠনের প্রতিক্রিয়া যাই হোক- বিশ্লেষকরা অনেকে মনে করেন মি. মোদিকে এমন অনুষ্ঠানে এনে ভারতের সরকারি মহলে নিজের আস্থা আরও বাড়িয়ে নিয়েছেন শেখ হাসিনা, এমনটিই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন।
‘এখানে মোদির বিরোধিতা করেছে ইসলামপন্থী আর বাম সংগঠনগুলো। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ মোদিকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে সব প্রতিবাদ মোকাবেলা করেই। যার মাধ্যমে হয়তো এমন বার্তা গেছে যে, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরালো এবং বর্তমানে বাংলাদেশে এ সম্পর্ক দেখার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই’, তিনি বলেন।
ওদিকে গত ২৬ মার্চ ঢাকায় এসে মুজিব জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠান ছাড়াও নরেন্দ্র মোদি সাতক্ষীরা ও গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে দুটি মন্দিরেও সফর করেছেন। অনেকেই মনে করেন মূলত পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনকে সামনে রেখেই এটি করেছেন নরেন্দ্র মোদি।
আবার বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে তিস্তা ইস্যু বারবার শেখ হাসিনা সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিলো তার জন্য দায়ী করা হয় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে। জোবাইদা নাসরিন বলছেন, নরেন্দ্র মোদিকে ঢাকার বাইরে মন্দিরে গিয়ে বিশেষ করে ওড়াকান্দিতে মতুয়াদের ঠাকুরবাড়িতে গিয়ে বক্তব্য দেয়ার যে সুযোগ দেয়া হয়েছে সেটি হয়তো তিস্তা ইস্যুতে শেখ হাসিনাকে বিব্রত করার জন্য মমতা ব্যানার্জিকে দেয়া একটি পাল্টা জবাব। আর এ জবাব দেয়ার জন্য শেখ হাসিনা হয়তো বেছে নিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের সময়টিকেই।
‘তিস্তাকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কিন্তু বারবার বিব্রত করেছেন। এখন নির্বাচনের সময় নরেন্দ্র মোদিকে দুটি মন্দির পরিদর্শনের সুযোগ দিয়ে এই বার্তাই দিয়েছেন যে গত দশ বছরে মমতা ব্যানার্জি যেভাবে বিব্রত করেছেন সেটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভুলেননি’।
জোবাইদা নাসরিন বলছেন, এটি অবশ্য ঠিক যে, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করলেও দেশের মধ্যে কিছুটা একাই হয়ে গেছে আওয়ামী লীগ, যার রাজনৈতিক পরিণতি কেমন হবে কিংবা কোন ধরনের মূল্য দিতে হয় নাকি বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে সুবিধাই করে দেয় কি না তা ভবিষ্যতে বোঝা যাবে।
তবে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, সরকার বা দলকে এখানে রাজনৈতিক মূল্য দেয়ার কিছু নেই। আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান বলছেন, নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে এসেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং আরো কয়েকটি দেশের সরকার প্রধান এসেছেন। যারা বিরোধিতা করেছে তাদেরকেই বরং জনগণ গ্রহণ করেনি বলে দাবি করেন তিনি।
‘আমি মনে করি না আওয়ামী লীগ একা হয়ে গেছে। আমাদের রাজনীতি জনগণের জন্য, যার সুফল দেশের জনগণ পাচ্ছে। এটা বিশ্বের সবাই জানে। আওয়ামী লীগের কাছে দেশ ও জনগণই আসল। কেউ যদি অন্য কিছু চিন্তা করে এসব বিষয়ে তাহলে সে ভুল করছে’, বলেন মুহাম্মদ ফারুক খান।
বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর রাজনীতিকরা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে, দেশের রাজনীতিতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ গত কয়েক বছর ধরেই ভারতের আনুক‚ল্য পাচ্ছে। কিন্তু ফারুক খান বলেন, পুরো ঘটনা উল্টোটাই প্রমাণ করেছে। তিনি বলেন, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন যেমন ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতি কেমন হবে সেটাও বাংলাদেশের বিষয়, এতে অন্য কোন দেশের ভ‚মিকা রাখার সুযোগ নেই। সূত্র : বিবিসি বাংলা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।