Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোগী নিয়ে স্বজনদের ছোটাছুটি

রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে সিট নেই

খলিলুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১০ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০১ এএম

‘কিডনি রোগী বাবাকে সারা রাত নিয়ে রাজধানীর এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরেছি। কোথায় ভর্তি করাতে পারিনি। সকালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি। সেখানে ভর্তি করাতে পারলেও সিট নেই। গুরুত্বর অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ফের চলে যাচ্ছি। গতকাল সকাল ৭টার দিকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিজের পিতাকে হাসপাতালে ভর্তির জন্য ছুটোছুটির চিত্র ইনকলিাবের কাছে এভাবেই তুলে ধরেন খালেদ আহেমেদ নামের এক ব্যক্তি।

খালেদ আহমেদ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা। গত বুধবার ১২টার দিকে তার বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। প্রথমে অ্যাম্বুলেন্সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। পরবর্তীতে সেখানে ভর্তি করা হয়নি। পরে জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালে নিয়ে যান তিনি। কিন্তু কোথায় ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। পরে সকাল ৭টার দিকে বাবাকে নিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন তিনি। সেখানে ভর্তি করাতে পারলেও কোনো সিট নেই। পরবর্তীতে ফের একটি সিএনজি অটোরিকশা করে তিনি অন্য কোনো হাসপাতালের সন্ধানে চলে যান।

খালেদ আহমেদ জানান, তার বৃদ্ধ বাবা দীর্ঘ দিন থেকে কিডনি রোগে ভোগছেন। কিন্তু কোনো হাসপাতাল ভর্তি নিচ্ছে না। বৃদ্ধ হওয়াতে অনেক হাসপাতাল করোনা রিপোর্ট দেখানোর জন্যও বলা হয়েছে বলে জানান তিনি।

শুধু খালেদ আহমেদ নয়, তার মতো শত শত ব্যক্তি প্রতিদিন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে রোগী ভর্তি করাতে পারছেন না। হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে অ্যাম্বুলেন্সেও মারা যাচ্ছেন অনেক রোগী। গত ২ এপ্রিল রাজধানীর মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এমন এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। শ্বাসকষ্টের রোগী মায়ের অক্সিজেন সাপোর্টের জন্য ছেলে একের পর এক ঘুরেছেন পাঁচ হাসপাতাল। কোথাও পাননি অক্সিজেন সাপোর্ট। শেষ পর্যন্ত মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মা। মায়ের লাশ জড়িয়ে আজাহারি করছিলেন ছেলে রায়হান।

নিহত মনোয়ারা বেগমকে (৫৫) রাজধানীর উত্তরখানের বাসিন্দা। রায়হান জানান, গুরুতর অবস্থায় মাকে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেন তিনি। কিন্তু, সেখানে ভর্তি করানোর পরও অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া যায়নি। পরে সেখান থেকে রেফার করা হলে মাকে নিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও আল রাজি ইসলামী হাসপাতাল হয়ে মুগদায় যান তিনি। কিন্তু কোথাও পর্যাপ্ত অক্সিজেন সাপোর্ট পাননি। শেষ পর্যন্ত এম্বুলেন্সেই মারা যান মনোয়ারা বেগম।

এদিকে, গতকাল দুপুরে সরেজমিন মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স আসছে। কিন্তু কোনো রোগীই ভর্তি করা হচ্ছে না। সিট নেই জানিয়ে রোগীদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। দুপুর দুইটার দিকে শওকত হোসেন নামের এক রোগীকে নিয়ে আসেন তার স্বজনরা। শওকত হোসেন কেরানীগঞ্জের দোহার বাসিন্দা। তিন দিন থেকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে তাকে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেফার করা হয়। পরবর্তীতে অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে মুগদায় নিয়ে আসা হয়। এ সময় তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু সেখানে ভর্তি করাতে না পেরে শ্যামলীতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। একটু পর দক্ষিণ বনশ্রী এলাকা থেকে রুবেল নামের আরেক রোগীকে নিয়ে আসা হয় মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়ার আগেই সিট নেই জানানো হয়। পরে ওই রোগীকে নিয়েও স্বজনরা চলে যান।

পরে মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা যায়, করোনায় আক্রান্ত রোগীরা প্রতিটি ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন। তবে কিছু কিছু ওয়ার্ডে বেড ফাঁকা পড়ে আছে। আবার কিছু ওয়ার্ডে বেডের সংখ্যা কম রয়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে রোগীর জন্য বাড়তি ব্যবস্থা করতে পারত বলে মনে করেন চিকিৎসাধীন অনেকেই।

কুমিল্লার বাসিন্দা ফরিদ উদ্দিন ইনকিলাবকে জানান, তার মাকে নিয়ে তিনি গত ১২ দিন থেকে মুগদা হাসপাতালে ভর্তি আছেন। প্রথমে ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন। পরে রোগীর অবস্থা অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে সেখানে চিকিৎসাধীন। গত ১২ দিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে আরো রোগী চিকিৎসার ব্যবস্থা করত। কিন্তু এ ব্যাপারে কেউ নজরদারি করছে না।

শুধু শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মুগদা হাসপাতাল নয়, একই অবস্থা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালেও।

চাঁদপুরের বাসিন্দা আলাল মিয়া জানান, গত শুক্রবার থেকে কাশি, বুকব্যথা ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন তিনি। স্থানীয় চিকিৎসকের কাছ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে দু’দিন ভালোই কেটেছে তার। গত সোমবার রাত থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। উপায়ন্তর না পেয়ে স্বজনরা তাকে মঙ্গলবার সকাল ৬টায় নিয়ে আসেন ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা ঠিকমতো পরীক্ষা-নীরিক্ষা না করেই করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে আসতে বলেন। স্বজনরা তখন কয়েকটি করোনা পরীক্ষা কেন্দ্রে ঘুরে পরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করতে পারেননি। এছাড়া তাৎক্ষণিক রিপোর্ট পাওয়ারও কোনো ব্যবস্থা নাই।
তারপর থেকে আলাল মিয়াকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘুরতে থাকেন স্বজনরা। সকাল ৬টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত মোট ১০ ঘণ্টায় সাত হাসপাতাল ঘুরেও আলাল মিয়াকে কোথাও ভর্তি করা যায়নি। সর্বশেষ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালও সিট সঙ্কটের জন্য তাকে ভর্তি নেয়নি। বিকাল তিনটার দিকে ঢামেক হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে বসে আলাল মিয়ার স্ত্রী মনোয়ারা বেগম বলেন, ভোরবেলা চাঁদপুর সদর হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালে আনার পরামর্শ দেয়া হয়। তাদের কথামতোই বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে আসি। করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট না থাকায় সেখানে ভর্তি নেয়নি। হাসপাতাল থেকে বলা হয় আমার স্বামীর করোনার উপসর্গ আছে। তাই করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। তারপর এক আত্মীয়ের পরামর্শে নিয়ে যাই মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি করাতে পারি নাই। তারপর একে একে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, বাংলাদেশ স্পেশালাইজড, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতাল ঘুরেছি। সর্বশেষ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। এখানে এসেও শুনি কোনো সিট খালি নাই। একজন এসে অক্সিজেন মেপে বলেছেন অবস্থা অতটা ভালো না। তাই জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

তিনি বলেন, সব হাসপাতালেই অনেক কাকুতি-মিনতি করেছি। এখন এই রোগীকে নিয়ে কোথায় যাবো কি করবো বুঝতেছি না। এখন একমাত্র ভরসা কোনো বেসরকারি হাসপাতালে যদি ভর্তি নেয়।

গতকাল সরজমিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, অ্যাম্বুলেন্সের দীর্ঘ সারি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একটু পর পর আসছে অ্যাম্বুলেন্স। বেশকিছু রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক রোগী করোনা পজিটিভ বা কোনো উপসর্গ নাই। এরপরেও তারা কোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। প্রতিটি হাসপাতাল থেকে বলা হচ্ছে করোনা পরীক্ষা করানো আছে কিনা। এছাড়া সব হাসপাতালেই সিট না থাকার কথা বলা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ ইনকিলাবকে বলেন, দিন দিন করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়াও মৃত্যুর মিছিলও বাড়ছে। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীতে সয়লাব। রোগী সংখ্যা বেশি হওয়ায় হাসপাতালগুলোতে জায়গায় নেই। তবে হাসপাতাল বা সিট বৃদ্ধি করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এটার জন্য করোনা রোগী যাতে না বাড়ে সেটার লাগাম টানতে হবে। এতে অবশ্যই জনগণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। মাস্ক, হাত দোয়া ও শারীরিক দূরুত্ব বজায় রেখে চলা ফেরা করতে হবে। ভিড়, সমাবেশ এড়িয়ে চলতে হবে। আর যারা এখন পর্যন্ত টিকা নেন নাই তারা অবশ্যই টিকা নিতে হবে বলে জানান তিনি।

প্রশাসনের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, জনগণের সাথে সম্বনয় করে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন প্রচার-প্রচারনা বৃদ্ধি করতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় পাড়া-মহল্লায় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি করেও সচেতনা বৃদ্ধি করে কাজ করা যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

 



 

Show all comments
  • Alejandra ৯ এপ্রিল, ২০২১, ১:২৩ এএম says : 0
    Awameleeg er unnoyon er chayte ar bese kicu asa kora jaina
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাসপাতাল

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ