Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

নৈতিক স্কুল

বিপথগামী শিশু-কিশোরদের বদলে যাওয়ার ম্যাজিক

রফিকুল ইসলাম সেলিম : | প্রকাশের সময় : ৬ মার্চ, ২০২১, ১২:০০ এএম

একদল শিশু-কিশোর। ওরা থাকে বস্তিতে। সেখানে মারপিট, গালগাল করতো। কেউ গাম খেতো। নেশায় বুদ হয়ে থাকতো। চুরি করতো। তারাই এখন পড়ছে। বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক। পাশাপাশি ছবি আঁকছে। করছে গান, নৃত্য, শরীরচর্চা। কেউ গিটারে, কেউ বাঁশিতে সুর তুলছে। আগে ওরা মিথ্যা বলতো। এখন সত্য বলছে। জানছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। শিখছে নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ। বড়দের সম্মান, ছোটদের স্নেহ করছে তারা।
অন্ধকার থেকে তারা বর্ণিল আলোতে চোখ মেলছে, এ আলো জ্ঞানের। জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হওয়ার স্বপ্ন এখন তাদের চোখে-মুখে। বিপথগামী এসব শিশু-কিশোরদের পথ দেখাচ্ছে একটি স্কুল। স্কুলের নামটিও বেশ অভিনব-‘নৈতিক স্কুল’। এখানে অবৈতনিক, নন-ফরমাল শিক্ষার ব্যবস্থা। বস্তির সুবিধা বঞ্চিত ঝরে পড়া এসব শিশুদের আনন্দ আর স্বপ্নের ঠিকানা এখন এই স্কুল। নগরীর খুলশী থানার ঝাউতলা রেল লাইনের পাশে এই স্কুলের অবস্থান। এলাকার মানুষের কাছে এই স্কুল এখন বিগড়ে যাওয়া শিশু-কিশোরদের বদলে যাওয়ার ম্যাজিক।
ব্যতিক্রমি এই বিদ্যাপিঠের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে টানা ৪১ বছর শিক্ষকতা শেষে এখন তিনি অবসরে। আর এ সময় তার দিনের একটি অংশ কাটছে এসব শিশু-কিশোরদের সাথে। হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এসব শিশুদের তিনি একান্ত আপন। তিনি তাদের সত্য বলতে শেখান। শোনান মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ভাল মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখান। সর্বগ্রাসী নৈতিক অবক্ষয়ের এই সময়ে তার নৈতিক স্কুল সমাজের প্রতি একটি বার্তা বলেও জানান তিনি।
নৈতিক স্কুলে ১০ জন শিক্ষক আছেন। তারাও প্রফেসর সালেহ উদ্দিনের ছাত্র। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক এবং বর্তমান এসব ছাত্ররা স্বেচ্ছায় কোন বেতন ছাড়াই নৈতিক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সপ্তাহে ছয়দিন বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত চলে স্কুলের কার্যক্রম। বিগত ২০০৫ সালে এই স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। শুরুতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিলো ২০ জন। এখন এই সংখ্যা ৬০।
এই স্কুলে প্রথমে পড়তে এবং লিখতে শেখানো হয়। যারা পড়া লেখায় ভাল তারা এক দুবছর পড়ার পর পাশের ইউসেপ স্কুলে প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয়। ওই স্কুলে তাদের পড়া লেখার খরচ যোগান নৈতিক স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর সালেহ উদ্দিন। তিনি তার মুক্তিযোদ্ধা ভাতার পুরোটাই ব্যয় করেন এদের পেছনে। বিবি ফাতিমা (১৫) এখন ইউসেপ স্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ছে। নৈতিক স্কুলে পড়ার পর সে ওই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়। তার বোন বিবি জুলেখাও নৈতিক স্কুল থেকে পড়া শেষ করে এখন ইউসেপ স্কুলে। আট ভাই-বোন রেখে তাদের পিতা মারা যান চার বছর আগে। ভাল স্কুলে গিয়ে পড়ার মতো তাদের অবস্থা নেই। তাই নৈতিক স্কুলে আসে তারা। তাদের মতো অনেকেই এখন নৈতিক স্কুলের পড়া শেষ করে ইউসেপ স্কুলে পড়ছে।
শিক্ষকরা বলছেন, যাদের পড়া লেখার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ তাদের আমরা দু একবছর পর প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেই। এই স্কুলে যখন তারা আসে তারা তখন কিছুই জানতো না। ধীরে ধীরে তারা পড়া লেখা শিখে আরো পড়তে চায়। অনেকে আবার এখানে কয়েক বছর পড়ে বিভিন্ন কাজে চলে যাচ্ছে। তারা লিখতে পড়তে পারছে। নেশা থেকে সরে এসেছে। এই স্কুলে পড়ছে মো. নাহিম (১২)। তারা বাবা নির্মাণ শ্রমিক। তার বড়ভাই নাজমুলও এই স্কুলে তিন বছর পড়ালেখা করেছে। এখন সে একটি গ্যারেজে কাজ করে। রবিউল (১২), সুমাইয়া (১১), মো. নবী (৬) পড়ছে নৈতিক স্কুলে। তারাও কিছুদিন পর ইউসেপ স্কুলে ভর্তি হবে। পড়া লেখার পাশাপাশি নৈতিক স্কুলে তাদের গান, নাচ, ছবি আঁকাও শেখানো হয়। সব বিষয়ের জন্য আছেন শিক্ষক। অনেকে ভাল গায়, ছবি আঁকে।
শিক্ষকরা বলছেন, এই স্কুলে অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা। সুপথে আনার পাশাপাশি আমরা তাদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলার চেষ্টায় সফল হচ্ছি। তাদের অনেকে এখানে মেধার স্বাক্ষর রাখছে। আমরা তাদের ভেতরে সুপ্ত প্রতিভা জাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি। তারা দ্রুতই তাদের পুরোনো অভ্যাস ত্যাগ করছে। তাদের কথা-বার্তা আচার-আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আসছে। কোন শাসন নয়, পরম মমতায় তাদের আমরা গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। নৈতিক স্কুল মূলত সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুদের আলোর পথ দেখায়। এরপর তারাই সামনে এগিয়ে যায়।
কেন নৈতিক স্কুল এমন প্রশ্নের জবাবে প্রফেসর গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, আমরা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং সেই সাথে মানবিক সমাজের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে এসেও চারিদিকে দুর্নীতি আর সর্বগ্রাসী অবক্ষয়। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধের দিক থেকে আমরা পেছনে পড়ে আছি। অনৈতিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে আমার এই নৈতিক স্কুল। এটি একটি সামাজিক আন্দোলন। সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশু-কিশোররা বস্তিতে নেশায় জড়িয়ে মারদাঙ্গা করতো। এখানে এসে তারা সুপথে আসছে। অনেক উচ্চ শিক্ষিতরাও নানা অনৈতিক কাজ করছে। তারা এসব শিশুদের কাছ থেকে সুপথে আসার শিক্ষা নিতে পারেন। এসব শিশু-কিশোররা আমাদের সমাজের অংশ। তাদের অন্ধকারে রেখে আলোকিত সমাজ হবে না। এমন শিশুদের পাশে অন্যরাও এগিয়ে আসলে আমার এই ক্ষুদ্র প্রয়াস সার্থক হবে বলে মনে করি।



 

Show all comments
  • প্রবাসী-একজন ৬ মার্চ, ২০২১, ৭:০৩ এএম says : 0
    নৈতিকতার সর্বশ্রেষ্ঠ উৎস মহান আল্লাহর বাণী সম্বলিত পবিত্র কুরআন; এ পবিত্র গ্রন্থে সুস্থ নিষ্কলুষ জীবন যাপনের যে বিধি-বিধান রয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীদের তা শেখানো হচ্ছে কি?
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিশু-কিশোর

৬ মার্চ, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ