Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আবাসিক হলে ঢুকতে তালা ভেঙেছে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী-এলাকাবাসী সংঘর্ষে আহত অর্ধশতাধিক

জাবি সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ১২:০০ এএম

মসজিদের মাইকে গুজব ছড়িয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করেছে এলাকাবাসী। এতে উভয়পক্ষের অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। যার কারণে ক্যাম্পাস ও তার আশেপাশের এলাকাজুড়ে বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। গতকাল শনিবার সকাল ১০টা থেকে সহাস্রাধিক শিক্ষার্থীর বিক্ষোভ ও তালা ভেঙে হলে ঢোকার ঘটনায় উত্তাল ছিল ক্যাম্পাসে পরিস্থিতি। জরুরি সিন্ডিকেট ডেকে মামলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্যাম্পাস খোলার বিষয়ে সরকারে উর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে মিটিংয়ে বসেছে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম।

জানা যায়, গত শুক্রবার বিকাল ৫টার দিকে জানাজানি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটকে রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী গেরুয়া এলাকার লোকজন। এরপর শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী জড়ো হতে থাকে। এরই মাঝে নিরাপত্তা কর্মকর্তা জেফরুল হাসান চৌধুরী সজল ও সহকারী প্রক্টরের নেতৃত্বে আটক শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই সময় এলাকাবাসী মসজিদের মাইকে বলে, ‘এলাকায় ডাকাত পড়েছে, মা বোনদের ইজ্জত লুন্ঠন করছে’ ইত্যাদি গুজব ছড়ায়। মাইকিংয়ে তারা আহ্বান করে, যার যা কিছু আছে তা নিয়ে বের হতে। এসব মাইকিংয়ের পর এলাকার বহু নারী-পুরুষ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে বের হয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলা করে। এই হামলার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করে শিক্ষার্থীরা। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত হয়। প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে চলা এই সংঘর্ষ রাত ১২টায় পুলিশের হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রণে আসে। সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। আহতদের মধ্যে ১৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদেরকে সাভারের এনাম মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদের অধিকাংশেরই মাথা, হাত, পা ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখম হয়েছে।

এদিকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এলাকাবাসী শিক্ষার্থীদের চারটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বেশকিছু দোকান ভাঙচুর করার অভিযোগ করেছে এলাকাবাসী।
অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, দীর্ঘ সময় ধরে সংঘর্ষ চললেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষার্থীরা বার বার পুলিশ ফোর্স বৃদ্ধির দাবি জানালেও ৪ ঘণ্টা সংঘর্ষ চললেও পর্যাপ্ত পুলিশ আসেনি। অবশেষে রাত ১২টার দিকে ঘটনাস্থলে পর্যাপ্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।

যে কারণে সংঘর্ষ :
গত ১১ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সংগঠন ‘নিরন্তর’ একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করে। এই টুর্নামেন্টে খেলাকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৪তম ব্যাচের এলেক্স নামের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে স্থানীয় কয়েক যুবকের হাতাহাতি হয়। মিমাংসার জন্য গত শুক্রবার বিকেলে বৈঠক শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা জানান, আলোচনার এক পর্যায়ে তাদের ওপর হামলা চালায় ও আটকে রাখলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। তবে এলাকাবাসীর দাবি, স্থানীয় নজরুল ইসলাম নামের এক যুবককে তুলে নিয়ে আসে শিক্ষার্থীরা। তুলে এনে চাঁদা দাবি করে। যার কারণে তারা ওই যুবককে নিয়ে আসতে গেলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পাতালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান পারভেজ দেওয়ানের দাবি, গেরুয়ায় জাবি শিক্ষার্থীরা স্থানীয় দোকানিদের কাছে চাঁদা চাইলে তারা শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হন।
ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ও তালা ভেঙে হলে প্রবেশ :
এলাকাবাসীর হামলার ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা গতকাল সকাল ১০টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশে জড়ো হতে থাকে। সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ভিসির বাসভবনের সামনে যায়। এ সময় তারা তিন দফা দাবির কথা জানান। দাবিগুলো হলো, আবাসিক হল খুলে দিতে হবে, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয়সহ সংঘর্ষে ক্ষয়ক্ষতির ব্যয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বহন করতে হবে এবং গেরুয়া এলাকায় স্থায়ীভাবে প্রাচীর নির্মাণ করতে হবে।

এসময় ভিসি ভবনের গেটের সামনে অবস্থান নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা। এছাড়া সহিংস পরিস্থিতি এড়াতে সেখানে অবস্থান নেয় পুলিশ সদস্যরা। পরে বিক্ষোভের মুখে শিক্ষার্থীদের সাথে প্রশাসনের পক্ষে কথা বলেন বিশ^বিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান।
দাবি মানার বিষয়ে ফিরোজ উল হাসান বলেন, গেরুয়া এলাকায় স্থায়ী প্রাচীর নির্মাণের বিষয়ে প্রশাসন ভাবছে। আর আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয় বহনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। তবে হল খোলার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার নেই। সরকার যদি চায় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হল খুলে দিতে পারবে।

বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের হল খোলা দাবি না মানায় সবগুলো হলের তালা ভেঙে হলে প্রবেশ করে। দুপুর ১২টার দিকে বিক্ষোভ মিছিল করে প্রথমে আল বেরুনী হলের তালা এবং ফজিলাতুন্নেসা হলের তালা ভাঙেন শিক্ষার্থীরা। এরপর ক্রমান্বয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের ৮টি এবং মেয়েদের ৮টি হলের তালা ভাঙ্গে তারা। মেয়েদের হলের তালা ভাঙার পর শিক্ষার্থীরা নতুন করে হামলাকারীদের গ্রেফতার, প্রক্টরের পদত্যাগ এবং হলে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দেয়ার দাবি জানান। এছাড়া মেয়েদের নিরাপত্তার স্বার্থে সকল মেয়েকে একটি হলে অবস্থান করতে বলা হয়।
এদিকে, হলের তালা ভাঙার পরপর মেয়েদের হলে আবার নতুন তালা লাগিয়ে দেয় হল সংশ্লিষ্টরা। তবে ছেলেদের কয়েকটি হলে শিক্ষার্থীরা অবস্থান করছেন। পুলিশের একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সন্ধায় হল থেকে শিক্ষার্থীদেরকে যেভাবে হোক বের করে দেয়া হবে।

হল খুলে দেয়া এবং শিক্ষার্থীদের হলের তালা ভাঙার বিষয়ে প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোতাহার হোসেন বলেন, হল খোলার বিষয়টি আমাদের হাতে নেই। এটি সরকারি সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।
প্রক্টর ফিরোজ উল হাসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরী সিন্ডিকেট অনুষ্ঠিত হয়েছে। সিন্ডিকেট থেকে হামলাকারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এছাড়া আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা খরচ বহন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

হল খোলার বিষয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় ঊর্ধ্বতন ব্যাক্তিদের সাথে সন্ধায় আলোচনা হবে। সেখান থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে সেটাই আমরা করবো।’

ফের মারধর উত্তেজনা সৃষ্টি :
বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলার খাবারের দোকানের মালিক জাকির হোসেনের ছেলে ও গেরুয়াবাসী হৃদয় ক্যাম্পাসে মোটরসাইকেল নিয়ে আসলে তাকে চৌরঙ্গি এলাকায় মারধর করে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ গেরুয়াবাসির হামলার সময় হৃদয় তাদের সঙ্গে ছিল। এই মারধরের খবর গেরুয়ায় জানাজানি হলে উত্তেজনা ছড়ায়। ফের এলাকাবাসী হামলার জন্য সংঘবদ্ধ হতে থাকে। পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতির ফলে নতুন করে আর সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়নি।

নিরাপত্তাহীনতায় শিক্ষার্থীরা :
করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় হল হলসমূহ বন্ধ আছে প্রায় এক বছরের মত। এই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী গেরুয়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে আছেন। এমন পরিস্থিতিতে সেসব বাসায় যাওয়া অনিরাপদ বোধ করছেন শিক্ষার্থীরা। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকাটা তাদের জন্য নিরাপদ। তাই তারা হলে উঠেছেন। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার ব্যয়ভার বিশ্ববিদ্যালয় বহন করবে। মিছিল, জমায়েত, আবাসিক হলের তালা ভাঙা সিন্ডিকেট সিদ্ধান্তের পরিপন্থী। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

ঢাকা উত্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) আব্দুল্লাহিল কাফি বলেন, গেরুয়া এলাকায় শতাধিক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। সংঘর্ষ এড়াতে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে। গতরাতের সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন মামলা হয়নি, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের প্রতিবাদ:
শিক্ষার্থীদের উপর হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে শাখা ছাত্রদল, ছাত্রইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট ও জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোট। বিবৃতিতে তারা অবিলম্বে হামলাকারী সন্ত্রাসীদেরকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানান। পাশাপাশি হল খুলে দেয়া ও শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয়ভার বহর করার দাবি জানান। অন্যদিকে শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে সংহতি জানান।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় মাফিয়া সন্ত্রাস : রাবি সংবাদদাতা জানান, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা অরক্ষিত। এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে স্থানীয় মাফিয়া সন্ত্রাস। আর শিক্ষক সমাজ পরিণত হয়েছে মাফিয়া ও রাজনৈতিক দলদাসে। এমন মন্তব্য করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

গতকাল শনিবার দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে বরিশাল ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের উপর হমালার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে আয়োজিত এক মানববন্ধনে এসব কথা বলেন তারা।
মানববন্ধনে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের আহ্বায়ক রিদম শাহরিয়ার সঞ্চালনায় শিক্ষার্থীরা বলেন, আজকে আমরা নিরাপত্তাহীনতায়। ববি ও জাবিতে শিক্ষার্থীদের ওপর যে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে তা দেখে রীতিমত আমরা আতঙ্কিত। যেখানে ছেলে শিক্ষার্থীদের ওপর এ অতর্কিত হামলা হচ্ছে সেখানে মেয়েরা কতটা নিরপদ?
শিক্ষার্থীরা আরো বলেন, যে দেশে ড. শামসুজ্জোহার মত শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য জীবন দিয়েছেন, সে দেশে আজকে একজন শিক্ষক কিভাবে বলতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার দায়িত্ব তার নয়? শিক্ষক সমাজের জন্য এটা কলঙ্কের। কোনভাবেই এর দায় শিক্ষক সমাজ এড়াতে পারে না। এ সময় মানববন্ধন থেকে ববি ও জাবি শিক্ষার্থীদের উপর হামলাকারীদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা এবং হল ও ক্যাম্পাস খোলার জোর দাবি জানান তারা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাবি

২১ ডিসেম্বর, ২০২২
১৪ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ