ইভিএম-এ ভোট কেন?
আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম-এ ১৫০ আসনে ভোট গ্রহণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাকতালীয় কিনা জানি না, ১৫০ সংখ্যাটা আমাদের এর আগে চিনিয়েছিলেন রকিবুল
দেশে সড়ক-মহাসড়ক প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার। সড়ক যোগাযোগের বিস্তৃত এই নেটওয়ার্কে প্রতিদিনই কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুষের জীবন তো যাচ্ছেই, বহু মানুষ আহত হয়ে চিরজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। এতে নিহত এবং আহত হওয়া কর্মক্ষম মানুষের পরিবারের জীবনযাত্রা কী দুর্দশা ও দুঃসহ পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়, তার কোনো হিসাব নেই। সরকারি-বেসরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না। কেবল আহত-নিহত হওয়ার পরিসংখ্যানই প্রকাশিত হয়। একটি পরিবারের অভিভাবক যে নিহত বা আহত হলো, কিংবা আপনজন হারিয়ে সেই পরিবারটি কিভাবে চলছে, তার পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয় না। এখন তো এমন দুর্ঘটনা ঘটছে যে, পুরো পরিবারই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের অস্তিত্ব বলে কিছু থাকছে না। সম্প্রতি এয়ারপোর্ট রোডে বাসের ধাক্কায় কর্মজীবী স্বামী-স্ত্রীর যে মৃত্যু ঘটল তাতে একটি পরিবার নিঃশেষ হয়ে গেল। আমরা শুধু খবরটি শুনে আফসোস করছি। তবে বাসায় রেখে যাওয়া তাদের পাঁচ বছরের সন্তানটির এখন কি হবে? কীভাবে সে বেড়ে উঠবে? এ কথাটি ভাবছি না। আমরা ভাবতে চাই না। ভেবে কোনো কূল-কিনারা পাই না। এক সময় এই ভাবনা থেকে সরে যাই। ভাবতে ভাল লাগে না। দুর্ঘটনায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া এমন ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। কেন ঘটছে, তার কারণ সবারই জানা। সড়কে চালকদের বেপরোয়া আচরণ, অদক্ষ চালক, অসচেতনতা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, সড়কের দুর্দশা, ধীরগতির অবৈধ যানবাহন ইত্যাদি নানা কারণ চিহ্নিত হয়ে আছে। এ কারণগুলোর সমাধান করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনা কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা যেত। এসব কারণের বাইরে দুর্ঘটনা ঘটলে তাকে হয়তো স্রেফ দুর্ঘটনা বলা যেত। কারণগুলোর প্রতিকার না করা পর্যন্ত কোনোভাবেই দুর্ঘটনাকে শুধু দুর্ঘটনা বলা যায় না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সড়ক দুর্ঘটনায় যেভাবে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তার ধরন দেখলে মনে হবে দৈবক্রমে খুব কমই দুর্ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুর্ঘটনার পেছনে মানুষের হাত রয়েছে। জেনেশুনে এবং ইচ্ছাকৃত ভুল রয়েছে। এই জেনেশুনে এবং ইচ্ছাকৃত ভুল করছে গাড়ি চালকরা। আরেকটু গোড়ার দিকে গেলে, এই ভুল করছে পরিবহন মালিক এবং আরও গভীরে গেলে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। গাড়ি চালকদের বেপরোয়া মনোভাব ও অদক্ষতা তাদের জানাশোনার মধ্যেই রয়েছে। তারা নিজেদের অদক্ষতা জেনে বুঝেই গাড়ির স্টিয়ারিং ধরছে। গাড়ি মালিকরাও তাদের জ্ঞাতসারেই অদক্ষ চালকদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। আর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আইনের যথাযথ প্রয়োগে উদাসীনতা ও শৈথিল্য রয়েছে। কাজেই, দুর্ঘটনা যে শুধুই দুর্ঘটনা, এতে মানুষের হাত নেই-এ অজুহাত দেয়ার সুযোগ নেই। বলা যায়, জানাশোনার মধ্যে থেকেই দুর্ঘটনা ঘটছে এবং ঘটানো হচ্ছে। যাত্রীদের যানবাহনে উঠিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী করা হচ্ছে।
দুই.
এখন পরিবার ও সমাজ এমন একটা সময় অতিক্রম করছে, যেখানে মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটছে। একের পর এক অনৈতিক ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি আপন মানুষ খুনি হয়ে উঠছে। যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে, তাদের একটা শ্রেণীও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় মনুষ্যসৃষ্ট এক ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পরিবার ও সমাজ অস্থির হয়ে উঠেছে। যেসব ঘটনা ঘটছে, এগুলো কোনভাবেই দুর্ঘটনা নয়। মাদকের যে ভয়াবহ আগ্রাসন চলছে, তা জেনেবুঝেই করা হচ্ছে। একজন মাদক সেবন করছে সজ্ঞানে। নিজেকে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর দিকে ধাবিত করছে। একে দুর্ঘটনা বলা যায় না। একইভাবে সড়ক পথে যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে, সেগুলোকেও এখন আর শুধু দুর্ঘটনা হিসেবে গণ্য করা যায় না। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় বলা হয়েছে, গত ১৪ বছরে সারা দেশে অর্ধ লক্ষাধিক দুর্ঘটনার মধ্যে ৯১ শতাংশই হয়েছে অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া চালনার জন্য। এসব দুর্ঘটনায় মারা যায় ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। সংস্থাটির হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনার শতকরা ৫০ ভাগই ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে। এর অর্থ মহাসড়কগুলো যেন একেকটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে হয়েছে। তাহলে এসব দুর্ঘটনাকে কি স্রেফ দুর্ঘটনা বলা যায়? নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের একাধিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর চারটি বড় কারণ হচ্ছে, চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, স্থায়ী নিয়োগের বদলে যাত্রার ওপর বেতন নির্ধারণ, শাস্তির অপ্রতুলতা এবং হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা। এসব কারণ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, দুর্ঘটনার পেছনে মানুষের হাত রয়েছে। এসব কারণ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয় যে, তা ঠেকানো যায় না। নিশ্চিতভাবেই এসব কারণ দূর করা যায়, ঠেকানো যায়, যদি সংশ্লিষ্টরা সচেতন হন, দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে দায় না সারেন এবং দুর্ঘটনার কারণগুলো দূর করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বড় ধরনের কোন ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটলেই আমরা কেবল তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ থেকে শুরু করে কারণ ও প্রতিকার নিয়ে মেতে উঠি। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন গেলেই তা ভুলে যায়। ২০১৮ সালে এয়ারপোর্ট রোডে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর কথা বিস্মৃত হতে চলেছে। সম্প্রতি বাস চাপায় স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সড়কে বেপরোয়া চালকদের কথা উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, এয়ারপোর্ট রোড মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। আসলে শুধু এয়ারপোর্ট রোডই নয়, সব ধরনের সড়ক-মহাসড়কই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। তা নাহলে, যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব মতে, গত বছর ৪ হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৬৮ জনের মৃত্যু হতো না। এ হিসাব কেবল পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত দুর্ঘটনা থেকে তুলে ধরা হয়েছে। এর বাইরে যে আরও অনেক দুর্ঘটনা রয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, বড় ধরনের ট্রাজিক ঘটনা না ঘটা পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মনিরের ট্র্যাজিক দুর্ঘটনার পর এয়ারপোর্ট রোডে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু নিয়ে শিক্ষর্থীদের তোলপাড় করা আন্দোলনে আইন সংশোধন করতে বাধ্য হয় সরকার। তবে এসব আইন বরাবরের মতোই খাতা-কলমে থেকে যায়। বাস্তবায়ন হয় খুব কম। বিষয়টি অনেকটা সুবিধা বুঝে আইন প্রয়োগের অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে রাজনীতিও আছে। দুঃখের বিষয়, যে দুর্ঘটনায় মানুষ বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে, আহত হচ্ছে, অসংখ্য পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে, এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী বেপরোয়া চালক এবং অন্যান্য কারণগুলোর সমাধান হচ্ছে না, এই রাজনীতির কারণে। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালককে শাস্তি দিতে গেলে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট পরিবহন শ্রমিকরা আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু করে। সড়ক থেকে অবৈধ দখল ও ধীরগতির যানবাহন উচ্ছেদ করতে গেলে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা তৎপর হয়ে উঠে। স্থানীয় প্রশাসনও নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও নিস্ক্রিয় হয়ে থাকে। দেখা যাচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণের কারণগুলো দূর করার ক্ষেত্রে রাজনীতি অন্যতম বাধা হয়ে রয়েছে। রাজনীতির কারণে সরকারও কঠোর হতে পারছে না। কারণ, এই অপরাজনীতির সাথে সরকারেরই লোকজন বেশি জড়িত। অর্থাৎ সর্ষের মধ্যেই ভূত বসবাস করছে। এ পরিস্থিতি বহাল থাকলে সড়ক দুর্ঘটনা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে না। প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটবে, মানুষ নিহত-আহত হবে, তাদের পরিবার নিঃস্ব হবে।
তিন.
সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পরিবারের উপার্জনক্ষম কোন সদস্য মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের শিকার হলে সে পরিবারটি কি শোচনীয় ও অশেষ দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে, তা তারা ছাড়া আর কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আমরা দূর থেকে দুঃখ ও শোক প্রকাশ করা ছাড়া কিছু করতে পারি না। পুরো পরিবারটিই যে ছারখার হয়ে গেল, তা গভীরভাবে চিন্তা করি না। বিগত ১৪ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় যে অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, এসব মানুষের পরিবারগুলো কি অবস্থায় আছে, তা কি আমরা কেউ জানি? দূর অতীতের পরিসংখ্যানে না গিয়ে গত বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে তাদের পরিবারগুলো কি অবস্থায় রয়েছে, তাও তো আমরা জানি না। পরিবারগুলোর খোঁজও কেউ নিচ্ছে না। অথচ রাষ্ট্রের মানবিক দায়িত্ব পরিবারগুলোর খোঁজ নেয়া এবং তারা যে নির্মম পরিণতি ভোগ করছে, তা উপলব্দি করে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। সরকারি হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতিদিন গড়ে ৮ জন মানুষ মারা যায়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ৩০ জন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ৪৮ জন। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, বছরে ৩ হাজার, বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ১২ হাজার এবং অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে ১৮ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। মৃত্যুর এই যে মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে, এর রাশ টেনে ধরার কোন কার্যকর উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। উদ্যোগ যদি থাকত, তবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩৭ শতাংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর হারটি কমিয়ে আনা যেত। অনেক পরিবার নিঃস্ব ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেত। বলা বাহুল্য, সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু একটি পরিবারের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরই মৃত্যু হয় না, পুরো পরিবারটিকেও বিপন্ন অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। এভাবে অভিভাবকহীন কত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তার খবর কখনোই পাওয়া যায় না। দুর্ঘটনার শিকার পরিবারগুলো সমাজে বা রাষ্ট্রের কি প্রভাব ফেলছে তার হিসাব করা প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে পত্র-পত্রিকার বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের শতকরা ৭৩ ভাগ উৎপাদনশীল খাতের সাথে জড়িত। সরকারি হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ থেকে ২ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের এক নেতা বলেছিলেন, ‘এর দায় সরকারেরও আছে। মানছি, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব আছে। তাহলে, সরকার কেন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে না? হাইওয়ে পুলিশের তো যন্ত্র আছে। তারা ব্যবস্থা নেয় না কেন? আসলে চালকরা মুনাফাবাজির শিকার।’ তার কথার সূত্র ধরে বলা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সরকারের নিশ্চয়ই দায় রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি চালকদের ডাটাবেজ তৈরি করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত, তাহলে অদক্ষ চালকের সংখ্যা কমে যেত। হাইওয়ে পুলিশ যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করত তবে, গাড়ি চালকরাও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে পারত না। অথচ মোটরযান আইনে জাতীয় মহাসড়ক এবং শহর ও লোকালয়ের জন্য আলাদা গতিসীমা রয়েছে। মহাসড়কে বাস, কোচ ও পিকআপের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ঘন্টায় ৫৫ কিলোমিটার, ভারী ট্রাক ও লরির গতিবেগ ৫০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও অন্যান্য ভারী যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত গাড়ির সার্বোচ্চ গতি ১১০ কিলোমিটার। অন্যদিকে শহর ও লোকালয়ে বাস, কোচ, পিকআপ, ভারী ট্রাক, লরির সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও ভারী যানবাহন ২০ কিলোমিটার এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ৫০ কিলোমিটার। মহাসড়ক ও শহরের যানবাহনের গতির দিকে তাকালে গতিসীমার এ আইন যে কেউ মানছে না বা কর্তব্যরত ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না, তা যে কেউ বুঝতে পারবেন। হাইওয়ে পুলিশের তথ্য মতে, ‘অতিরিক্ত গতি মাপার যন্ত্র হাইওয়ে পুলিশের সব স্থানেই আছে। গতি না মানার দায়ে প্রতিদিনই মামলা দেয়া হয়।’ তাহলে বেপরোয়া গতি কমছে না কেন? সমস্যা কোথায়? বাস-ট্রাকের অনেক চালক বলেছেন, তাদের প্রায় সব চালকই ট্রিপ অনুযায়ী মালিকের কাছ থেকে টাকা পান। তারা মাসিক বেতনভুক্ত নন। এজন্য ট্রিপ বাড়ানোর জন্য পথে গতি বৃদ্ধি করে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানো হয়। এতেই দুর্ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ ট্রিপ বাড়িয়ে বাড়তি রোজগারের জন্য তারা শুধু নিজের জীবনের ঝুঁকিই নিচ্ছে না, যাত্রীদের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। কোন সভ্য দেশে এ ধরনের আত্মঘাতী প্রতিযোগিতা চলে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। চালকদের এ কথা থেকে বলার সুযোগ নেই দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই, এর পেছনে মানুষের হাত নেই।
চার.
চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা, প্রশিক্ষণের অভাব, মাদকাসক্তি, মোবাইলে কথা বলা, জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, সড়কের ত্রুটি ও যথাযথ সংস্কারের অভাব, আইনের কার্যকর প্রয়োগ না হওয়া-এসব কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব কারণ দূর করতে পারলেই কেবল দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা যেতে পারে। কাজেই, শনাক্তকৃত কারণ দূর করতে এবং পরিবহন খাতে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিকল্প নেই। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে প্রায়ই যানবাহনের ত্রুটি-বিচ্যুতি তদারকির জন্য রাস্তায় নামতে দেখা যায়। তাতে দুর্ঘটনার চিত্রের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। বরং তার এই মাঠে নামাটা অনেকে লোক দেখানো মনে করে। এটা না করে, মূল জায়গায় হাত দেয়া দরকার। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল করা এবং চালকের বেপরোয়া হয়ে যাওয়া কিভাবে বন্ধ করা যায়, এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। গোড়ায় গলদ রেখে শুধুমাত্র বিশেষ অভিযানে কোনো লাভ হবে না। গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য একটি গাড়ির একাধিক মালিকের পরিবর্তে বড় কোম্পানির অধীনে পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে আসা প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক দেশেই মালিকদের সমন্বয়ে বড় কোম্পানি গঠন করে পরিবহন ব্যবস্থা পরিচালনা করা হয়। এতে চালক ও শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ে। পরিবহন খাতেও শৃঙ্খলা ফিরে আসে। সারা দেশের চালকদের সমন্বিত ডাটাবেজ তৈরি করে, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। এতে চালকদের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি সড়কের নিয়ম কানুন মেনে চলার জন্য চালক ও যাত্রীদের বাধ্য করতে হবে। বাংলাদেশে শতকরা ৭০ ভাগ যাত্রী সড়ক পরিবহনে যাতায়াত করে। সড়ক পরিবহনে এত যাত্রী খুব কম দেশেই দেখা যায়। দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সড়ক পরিবহনের উপর থেকে চাপ কমাতে হবে। এজন্য রেল পথকে আধুনিক ও গতিশীল করার উদ্যোগ নিতে হবে। রেল ব্যবস্থা উন্নত করতে পারলে সড়কের ওপর থেকে চাপ কমার পাশাপাশি দুর্ঘটনাও অনেকটা কমে আসবে। রেলকে যাত্রীদের কাছে নিরাপদ, আরামদায়ক ও জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। এতে যাত্রীরা যেমন রেল ভ্রমণে আগ্রহী হয়ে উঠবে, তেমনি এ খাতটি ব্যাপক লাভজনক হয়ে উঠবে। নৌপথেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত লঞ্চ ও জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আইনের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। রেল ও নৌ পরিবহণ উন্নত করলে সড়ক পথে যেমন চাপ কমবে, তেমনি দুর্ঘটনাও অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।