Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আলোচনায় গৌরীপুরের নীরব ব্যালট বিপ্লব: সাংসদকে হুমকি থানায় জিডি

গৃহবন্দি থেকেই বিজয়ী বিদ্রোহী মেয়র রফিক, নিরপেক্ষ ভোটে প্রশংসিত প্রশাসন-সাংবাদিক

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৬:৩০ পিএম

প্রশাসনের কঠোর নজরদারী আর সাংবাদিকদের প্রশংসনীয় ভূমিকায় ময়মনসিংহের গৌরীপুরে ৩০ জানুয়ারী সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচনে নীরব ব্যালট বিপ্লবে এক অনন্য নজির সৃষ্টি হয়েছে। এনিয়ে গৌরীপুর থেকে জেলার সর্বত্র আলোচনার টেবিলে স্থান করে নিয়েছে এ নির্বাচনের আদিঅন্ত। এতে প্রশংসা কুড়িয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও সাংবাদিকদের নিরপেক্ষ ভূমিকা। ফলে ভোটের মাঠের টানা দিনগুলো কারাগার আর গৃহবন্দি থেকেও ব্যাপক জনপ্রিয়তায় বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী বর্তমান মেয়র সৈয়দ রফিকুল ইসলাম।

স্থানীয়রা জানায়, এ নির্বাচনের ঠিক আগ মূহর্তে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মাসুদুর রহমান শুভ্র হত্যাকান্ডের ঘটনায় ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে আসামী হন গৌরীপুর পৌরসভার বর্তমান মেয়র ও পৌর আওয়ামীলীগের বহিস্কৃত সভাপতি সৈয়দ রফিকুল ইসলামসহ সহোদর ৩ ভাই। ওই হত্যাকান্ডের ঘটনায় পুড়িয়ে দেয়া হয় মেয়র রফিক ও তাঁর ভাইদের বাড়ীঘর এবং ভাংচুর করা হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পরে শুভ্র হত্যা মামলায় উচ্চ আদালতের জামিন নিয়েও নিন্ম আদালতে টানা ২১দিন কারাগারে থেকে ৩ জানুয়ারী জামিনে মুক্তি লাভি করেন রফিক। কিন্তু ভোটের মাঠে ক্ষমতাসীন নৌকা সমর্থকদের একছত্র আধিপত্যবাদী দাপটে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েও ভোটের টানা ২৭দিন তিনি ছিলেন গৃহবন্দি। এভাবেই ধৈর্য্যরে সাথে গৃহবন্দি থেকেই তিনি নিজ বাসভবনে বসেই করেছেন গণসংযোগ।

সৈয়দ রফিকের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট মো: বাচ্চু মিয়া জানান, নির্বাচনের শুরু থেকেই স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ক্ষমতার প্রভাবে আমরা ছিলাম কোনঠাসা। ভোটের মাঠে আমাদের একদিনও ওয়ার্ক করতে দেয়া হয়নি। মাইক কিনে এনে প্রচারণা করতে হয়েছে। তারপরও আটো-মাইক ভাংচুর করা হয়েছে। পোষ্টার লাগাতে দেয়া হয়নি। প্রার্থী বাড়ীর বাইরে বের হতে পারেনি। অনেক কষ্টে নির্বাচনের দিন ৯টি কেন্দ্রে এজেন্ট দেয়া হয়েছে। এরা মারপিট খেয়েও কেন্দ্রে টিকে থাকার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বেলা তিনটায় ৩টি কেন্দ্র থেকে আমাদের এজেন্ট বের করে দেয়া হয়। তবে জনগন নিরব ব্যালটে এসবের জবাব দিয়েছেন।

জানা যায়, ভোটের দিন সকাল থেকে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের ছিল উপচেপড়া ভীর। বিশেষ করে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। কিন্তু ব্যালট ছিনতাই, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, মারপিট, হামলা-ভাঙচুর ও জালভোটের মধ্যদিয়ে গত শনিবার তৃতীয় দফায় ময়মনসিংহের গৌরীপুর পৌরসভার নির্বাচন সম্পন্ন হয়। ওইদিন বেলা ১২টার দিকে গৌরীপুর সরকারি কলেজ কেন্দ্রে ব্যালট ছিনতাই করে নিয়ে যাবার সময় হাতেনাতে বর্তমান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভিপি শহীদ, জনি ও সাবেক চেয়ারম্যান দুলালসহ চারজনকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু নির্বাচন চলাকালীন সময়েই আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করলে পুলিশ তাদের মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। এর আগে দুপুর পৌনে একটার দিকে শেখ লেবু স্মৃতি পৌর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে নৌকা ও বিদ্রোহী সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনার ভিডিও করার সময় এনটিভি ও ৭১ টিভির ক্যামেরাপারসনকে বেধড়ক মারধর করে ক্যামেরা ভাংচুর করা হয়। পরে পাইলট উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে বিকেল তিনটার পর জাল ভোট ও ব্যালটে সীল মারার ঘটনা ঘটে। এ সময় কর্তব্যরত পুলিশ ও সাংবাদিকদের সামনেও নৌকার প্রার্থীর পক্ষে সীল মারতে দেখা যায়।
সূত্র জানায়, এসব ঘটনায় শেষ হারানোর আশঙ্কায় ভোট গণণার আগে ক্ষেপে উঠেন বিদ্রোহী প্রার্থী সৈয়দ রফিকের সমর্থকরা। এ সময় শত শত সমর্থকরা প্রকাশ্যে দেশিয় অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করেন নৌকা সমর্থকদের। এতে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। দলে দলে শত শত সমর্থক জড়ো হয় উপজেলা পরিষদের সামনে। এ সময় কন্টোল রুমের বাইরে চলছিল নিরপেক্ষ ফলাফলের দাবিতে শ্লোগ্নান। আর ভেতরে চলছিল ভোটের ফলাফল ঘোষনা। ফলে শেষগত ৬১২ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ের হাসি হাসেন আ’লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সৈয়দ রফিকুল ইসলাম।

গৌরীপুর প্রেসক্লাবের আহবায়ক খাইরুল বাসার জানান, নিরপেক্ষ নির্বাচনে সাধারন মানুষের মাঝে প্রশংসা কুড়িয়েছেন সাংবাদিক ও প্রশাসনের ভূমিকা। এটা বর্তমান সময়ের অনন্য নজির।

এদিকে নির্বাচনের দিন বিকেল ৪টা ১৭মিনিটে ভোটের মাঠে আচরনবিধি লঙ্গন করে প্রভাব বিস্তার করায় স্থানীয় সংসদ সদস্য বীরমুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদের মোবাইল ফোনে কল করেন মেয়র প্রার্থী সৈয়দ রফিকুল। ওই সময় সাংসদকে মেয়র বলেন, ‘আপনার কারণে আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। ফলাফলে কারচুপি হলে আমি আপনাকে ক্ষমা করব না। রক্তের বন্যা বইয়ে দিব।’

এ ঘটনায় ওইদিন রাতেই ময়মনসিংহের কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সাংসদ নাজিম। কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি তদন্ত মো. ফারুক হোসেন জানান, সংসদ সদস্যের জিডি তদন্তের জন্য আদালতের অনুমতি চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। অনুমতি পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

তবে এবিষয়ে পৌর মেয়র রফিকুল বলেন, ‘নির্বাচনি আচরণ বিধি অনুযায়ী, সংসদ সদস্য ভোটের সময় থাকতে পারেন না। উনাকে (এমপিকে) বারবার বলার পরেও উনি নির্বাচনের দিনও কেন্দ্রের ভেতর প্রবেশ করেছেন। এ জন্য নির্বাচন অফিসে নিয়ম অনুযায়ী অভিযোগও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাংসদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকায় ফোন করে উসকানিমূলক কর্মকান্ড না করার জন্য বলি। তবে কথাগুলো একটু উত্তেজনাময় ছিল।’

এবিষয়ে সংসদ সদস্য বীরমুক্তিযোদ্ধা নাজিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি সংসদ সদস্যের অস্থায়ী কার্যালয়ে ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয় কাগজ নিতে গিয়েছিলাম। সেখানে ১০ মিনিটও বসিনি। নির্বাচনে কোনো প্রভাব বিস্তার করিনি।’

গৌরীপুর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও নির্বাচনের সহকারী রিটানিং কর্মকর্তা সজল চন্দ্র জানান, এ পৌরসভায় মোট ভোটার ছিল ২১,২১২টি। এর মধ্যে নারী ভোটার ছিল ১০৮৪৬টি এবং পুরুষ ভোটার ছিল ১০,৩৬৬টি। তবে এ নির্বাচনে মোট বৈধ ভোট পড়েছে ১৬,৪০৬টি। এর মধ্যে বিজয়ী প্রার্থী নারিকেল গাছ প্রতিকে পেয়েছেন ৭৮৭৮ ভোট এবং ৭২৬৬ ভোট পেয়েছেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বি নৌকার প্রার্থী পেয়েছেন ৭২৬৬ ভোট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ময়মনসিংহ

২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ