Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কবি কাজী নজরুল ও তার লেখা এবং ছোট বেলার নানান ঘটনা

প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আ ল ম শা ম স

আজ ২৯ আগস্ট। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এই দিনে ১৯৭৬ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও দেশপ্রেমী মানুষ। আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, শিশু-কিশোরদের কবি, জাতীয় জাগরণের কবি। নজরুল তার গল্প, কবিতা ও গানে অসংখ্য জায়গায় তার প্রকৃতি প্রেমকে ফুটিয়ে তুলেছেন।
১৮৯৯ সালের ২৪ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি নজরুল। চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া থানায় অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিনউল্লাহর ছেলে কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের সন্তান তিনি। তার বাবা ছিলেন স্থানীয় এক মসজিদের ইমাম। তারা ছিলেন তিন ভাইবোন। তার ভাইবোনেরা হলোÑ সবার বড় কাজী সাহেবজান, কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন, বোন উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া।
তিনি স্থানীয় মক্তবে কোরআন, ইসলাম ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯০৮ সালে যখন তার বাবা মারা যান তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর।
মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (কবিতা, গান ও নাট্যদল) দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষা ভালো বুঝতেন। এ ছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন।
১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ট্রেনিং শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ সালের শেষভাগ থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ সালে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
১৯২২ সালে বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হওয়ামাত্রই ছোট-বড় সবার মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি করে। সেই কবিতাটি হলো :

বল বীরÑ
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি আমারি, নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!
বল বীরÑ
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি
চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি
ভূলোক দ্যুলোক গোলোক ভেদিয়া,
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব বিধাত্রীর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!
বল বীরÑ
আমি চির উন্নত শির।...

...আমি চির-বিদ্রোহী-বীর-
আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির!

শিশুদের বিষয়ে কবি লিখেন,

নতুন দিনের মানুষ তোরা
আয় শিশুরা আয়!
নতুন চোখে নতুন লোকের
নতুন ভরসায়।

যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধনহারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, কোরবানি, মোহররম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্।
প্রমীলা দেবীর সাথে তার বিয়ে হয়েছিল। এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নি নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনে নজরুলের ঘরজামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘরজামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। একপর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুস্পষ্টরূপে জানা যায়, ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃতে সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ সালে কবি ও কবিপতœীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৫৩ সালের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। মে’র ১০ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন। লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। অবশেষে ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কবি তার একটি কবিতায় বলেছিলেন : “মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই, যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই”
এই কবিতায় তার অস্তিম ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। তার এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়।
কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়। নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে ২০০৫ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কবির জন্মস্থান চুরুলিয়ায় নজরুল একাডেমি ও বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কবির স্মৃতিতে নজরুল একাডেমি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ও বাংলাদেশ নজরুল সেনা স্থাপিত হয়। কলকাতায় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও মূল শহরের সংযোগকারী প্রধান রাস্তাটি কবির নামে উৎসর্গ করে কাজী নজরুল ইসলাম সরণি করা হয়। এ ছাড়াও কলকাতা মেট্রোর গড়িয়া বাজার স্টেশনটিকে কবির সম্মানে কবি নজরুল নামে উৎসর্গিত করা হয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কবি কাজী নজরুল ও তার লেখা এবং ছোট বেলার নানান ঘটনা
আরও পড়ুন