চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মানুষ স্বভাবতই কম-বেশি ক্রোধান্বিত হন। কারো সাথে কথা না বলা এই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। আবার কখনও দেখা যায় মহান আল্লাহ নিজেই মানুষের সাথে কথা বলতে বারণ করেছেন। মানুষের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য হযরত মারিয়ামকে আ. চুপ থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরশাদ হচ্ছে, সুতরাং আহার করো, পান করো ও চক্ষু জুড়াও। মানুষের মধ্যে কাউকে যদি তুমি দেখো, তাহলে বলো আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে মৌনতা অবলম্বনের মানত করেছি। সুতরাং আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করব না (সুরা মারিয়াম, আয়াত : ২৬)। অর্থাৎ শিশুর ঈসার আ. ব্যাপারে তোমার কিছু বলার প্রয়োজন নেই। তাঁর জন্মের ব্যাপারে যে কেউ আপত্তি তুলবে তার জবাব দেবার দায়িত্ব এখন আমার। এ ধরনের রোজার বিধান আগের ধর্মে ছিল।
ইসলামে এ ধরনের বিধান নেই। এমনকি ইসলাম ধর্মে তিন দিনের বেশি কারো সঙ্গে কথা বন্ধ রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ কথা বন্ধ রাখার মাধ্যমে মূলতঃ সম্পর্ক বিনষ্ট করা হয়। এ ব্যাপারে মহানবি সা. কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘তোমরা পরস্পর সম্পর্কচ্ছেদ করো না, একে অন্যের বিরুদ্ধে শত্রুভাবাপন্ন হয়ো না, পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর হিংসা করো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা, ভাই ভাই হয়ে যাও। কোনো মুসলিমের জন্য তার ভাইয়ের সঙ্গে তিন দিনের বেশি কথাবার্তা বলা বন্ধ রাখা বৈধ নয় (বুখারি, হাদিস : ৬০৫৬)।
এ বিষয়ে একটি ঘটনা বুখারি শরিফে বর্ণিত রয়েছে। হযরত আউফ ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, কিছু লোক এসে হযরত আয়শাকে রা. বললো, আপনি যে ওমুক জিনিস বিক্রি করেছেন কিংবা কাউকে দান করেছেন এ বিষয়ে আবদুল্লাহ ইবনে যুবাইর রা. (আয়শা রা. এর বোনপো) বলেছেন, যদি খালাম্মা আমার কথা না মানেন তাহলে, আমি তাঁর উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে দেবো। অর্থাৎ বায়তুলমাল হতে হযরত আয়শাকে রা. যে পরিমাণ ভাতা দেয়া হয় তা কমিয়ে শুধু খরচ চালনার পরিমাণ অর্থ দেবো।
হযরত আয়শা রা. জিজ্ঞেস করলেন, সে কি একথা বলেছে? লোকেরা বললো : হ্যাঁ, তিনি একথাই বলেছেন। অতঃপর আয়শা রা. বললেন, আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, ইবনে যুবাইরের সঙ্গে আর কখনো কথা বলবো না। এরপর তিনি তার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে নিলেন। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চললো। ইবনে যোবাইর তাঁর নিকট সুপারিশকারী পাঠালেন। কিন্তু আয়শা রা. কারো কোন সুপারিশ মানলেন না। শপথও ভাঙ্গলেন না। এ বিষয়টি ইবনে যুবাইরের জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়ে উঠলো। এ কারণে তিনি মিসওয়ার ইবনে মাকযামা এবং আবদুর রহমান ইবনে আসওয়াদকে কসম দিয়ে বললেন, যে কোনভাবেই হোক আমাকে খালাম্মার নিকট নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করুন। অতঃপর তাঁরা দুজন আয়শা রা. এর বাসার দরজায় কড়া নেড়ে আওয়াজ দিলেন। সালাম জানিয়ে বললেন, ‘আমরা ভেতরে আসতে পারি কি? হযরত আয়শা রা. বললেন, হাঁ, ‘আসুন’। তখন উভয়ে বললো, ‘আমরা সকলেই আসবো কি?’ তিনি বললেন, হাঁ, আপনারা সবাই আসুন।’ তিনি তখন জানতেন না, তাদের সঙ্গে ইবনে যুবাইরও আছেন। তারা ভেতরে প্রবেশ করলো। ইবনে যুবাইর রা. পর্দার আড়ালে আয়শার রা. কাছে চলে গেলেন।
সেখানে গিয়েই তাঁর পা ধরে মাফ করে দেবার জন্যে কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চাইতে লাগলেন। এদিকে মিসওয়ার এবং আবদুর রহমানও ইবনে যুবাইরের অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা শুরু করার জন্যে সুপারিশ করতে লাগলেন। এরা উভয়ে তাঁকে ঐ হাদীস স্মরণ করিয়ে দিলেন, যে হাদীসে রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তিনদিনের বেশি কোন মুসলমানের সঙ্গে রাগ করে কথা বলা বন্ধ রাখা বৈধ নয়। যখন সবাই সমবেতভাবে হযরত আয়শা রা. এর উপর চাপ সৃষ্টি করলেন এবং জোর দিয়ে বললেন যে, আপনি যা করছেন সেটা অন্যায় ও গুনাহ। তখন তিনি কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, আমি কসম খেয়ে ফেলেছি এবং কসম অত্যন্ত কঠিন বিষয়।
শেষ পর্যন্ত তিনি কসম ভঙ্গ করে ইবনে যুবাইরের সঙ্গে কথা বললেন এবং কসমের কাফফারা স্বরূপ ৪০ জন গোলাম মুক্ত করে দিলেন। পরবর্তী জীবনে হযরত আয়শা রা. তাঁর এ ভুলের কথা মনে উঠলেই কাঁদতে শুরু করতেন এবং এতো অধিক পরিমাণে কাঁদতেন যে চোখের পানিতে তার ওড়না ভিজে যেতো।
এখন প্রশ্ন হলো একাধারে তিনদিন কথা বন্ধ রাখার কাফফারা কী? হাদিস শরিফে এ ব্যাপারেও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলে পাক সা. কে বলতে শুনেছি কোন ঈমানদার ব্যক্তির সাথে তিন দিনের অধিককাল সম্পর্কচ্ছেদ করে থাকা কারো জন্য বৈধ নয়। যখন তিনদিন অতিবাহিত হয়ে যায় তখন তার উচিত তার সাথে সাক্ষাত করে তাকে সালাম দেয়া। যদি অপর ব্যক্তি তার সালামের জবাব দেয় তবে তার ভাইয়ের সওয়াবের ভাগী হবে। আর যদি ঐ ব্যক্তি তার সালামের উত্তর না দেয় তবে সালামদাতা সম্পর্কচ্ছেদের গুণাহের দায় হতে অব্যাহতি পাবে (ইমাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল বুখারী, অনু. মাও. আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী, আল-আদাবুল মুফরাদ, ইফাবা, ৪র্থ সংস্করণ, সেপ্টেম্বর ২০০৮, পৃ. ২০০)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।