Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

আলোচনায় হত্যা-ধর্ষণ

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:১০ এএম

নতুন বছরকে স্বাগতম আর পুরাতনকে বিদায়ের শেষ প্রান্তে মানুষ নানা হিসাব নিকাশের দিতে তাকিয়ে আছে। নানা ঘটনা দুর্ঘটনার মধ্যেই এই বছরটি শেষ হচ্ছে। আর এসব ঘটনার মধ্যে আলোচিত ছিল মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকান্ডসহ বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড। এছাড়াও দেশে বেশ কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। শুধু তাই নয়, বিকৃত মস্তিষ্কের মর্গের লাশকাটা ঘরে মৃত তরুণীদের লাশও ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আর এসব ঘটনাগুলো বছরজুড়ে শুধু আলোচিতই নয়, প্রতিবাধের ঝড় উঠেছি। বছরের শুরুতেই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনা। যা সারাদেশেই আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিচারের দাবিতে রাস্তায় নামে। হত্যা মামলাগুলোর মধ্যে বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলা, ফেনীর নুসরাত হত্যা মামলা ও থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেমের সাজা, ঢাবি শিক্ষার্থী ধর্ষণ মামলায় ধর্ষক মজনুর সাজা, এছাড়া ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের আইন এ বছরই পাশ হয়েছে। এর বাইরে সারা বছরই কিছু দিন পর পর হত্যা, ধর্ষণ, দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ পেতে থাকে।
আলোচিত সিনহা রাশেদ হত্যা : চলতি বছরের গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার- টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহাকে বহনকারী গাড়ি দাঁড় করানো হয়। তিনি গাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তাকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। পরে আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব। জীবন নিরাপত্তার রক্ষক হয়ে উল্টো জীবন ভক্ষকের ভূমিকা পালন করায় অসংখ্য প্রশ্নের মুখে পড়ে গোটা পুলিশ বাহিনী। দ্রুত তদন্ত শেষে গত ১৩ ডিসেম্বর টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপসহ ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করে র‌্যাব। র‌্যাবের তদন্তে বেরিয়ে আসে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ ও তার সহযোগীদের ইয়াবা ব্যবসার তথ্য জেনে যাওয়ায় মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদকে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। চার্জশীটভুক্ত ১৫ জন আসামির মধ্যে ১৩ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। বর্তমানে আসামিরা কারাগারে রয়েছেন। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় গত ৫ আগস্ট নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার কক্সবাজারের আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলায় টেকনাফের ওসি প্রদীপসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়। হত্যাকান্ডের সময় সিনহার সঙ্গে কক্সবাজারে ডকুমেন্টারি তৈরির কাজ করছিলেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির তিন শিক্ষার্থী শিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত এবং তাহসিন রিফাত নূর। পরে পুলিশ তাদেরকেও গ্রেফতার করে। পুলিশ বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করে। চাঞ্চল্যকর এই মামলায় গত ২১ ডিসেম্বর চার্জশিট গ্রহণ করেন আদালত। একই সঙ্গে এই মামলার পলাতক আসামি সাগরের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এছাড়া, এই হত্যার ঘটনায় পৃথক ২টি মামলা থেকে সিনহার সহযোগী সিফাতকে অব্যাহতি দেয়া হয়। জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহর আদালত এ আদেশ দেন। একই আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র‌্যাবের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম।
রাজধানীতে সিনিয়র এএসপি আনিসুল হত্যা : গত ৯ নভেম্বর মানসিক সমস্যার চিকিৎসায় সিনিয়র এএসপি আনিসুলকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে চিকিৎসকদের পরামর্শে আদাবরের মাইন্ড এইড নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। তার কয়েক ঘণ্টা পরই তিনি প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের মারধরের শিকার হন। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এ হত্যাকান্ডের তথ্যপ্রমাণ মিলেছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট হাতে পেলেই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হতে পারে। এ ঘটনায় চার্জশিটে মাইন্ড এইড হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। মাইন্ড এইড হাসপাতালের সিসি ক্যামেরা ফুটেজে আনিসুলকে মারধরের ঘটনা ধরা পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ফুটেজ ভাইরাল হয়। ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে আনিসুলকে পিটিয়ে হত্যার প্রমাণ পায় পুলিশ। চাঞ্চ্যকর এ ঘটনায় আনিসুলের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাইজুদ্দিন আহম্মেদ বাদী হয়ে গত ১০ নভেম্বর মাইন্ড এইডের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ১৫ জনকে আসামি করে আদাবর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার আসামিদের মধ্যে ১২জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এর মধ্যে হাসপাতালটির পরিচালক ডা. নিয়াজ মোর্শেদ রাজধানীর একটি হাসপাতালে পুলিশ প্রহরায় চিকিৎসাধীন আছেন। বাকি ১১ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাদের মধ্যে ৬ জন দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। আনিসুল হত্যাকান্ডে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে জাতীয় মানসিক ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার আবদুল্লাহ আল মামুনকেও গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তাকেও এ মামলায় অভিযুক্ত দেখানো হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদাবর থানার পরিদর্শক অপারেশন ফারুক হোসেন মোল্লা ঘটনার পর জানিয়েছেন, আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে সব তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পরই নতুন বছরের প্রথম মাসের প্রথম সপ্তাহেই চার্জশিট দেয়া হতে পারে।
পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতারকৃত আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পেরেছে যে, পুলিশ কর্মকর্তা আনিসুলকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে মাইন্ড এইডের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অ্যাগ্রেসিভ ম্যানেজমেন্ট রুমে জোর করে তাকে ঢুকানো হয়। এরপর রুমে নিয়ে তাকে উপুড় করে শুইয়ে দুই হাত পিঠ মোড়া করে বাঁধা হয়। এ সময় তার ঘাড়, মাথা, পিঠ ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় উপর্যুপরি আঘাত করা হয়। আনিসুলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। আর আবদুল্লাহ আল মামুন, সাজ্জাদ আমিন ও সাখাওয়াত পলাতক। ডা. নিয়াজ মুর্শেদ পুলিশ প্রহরায় চিকিৎসাধীন।
সিলেটে পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান হত্যা : সিলেট মহানগরীর আখালিয়া এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে গত ১১ অক্টোবর ভোরে বন্দর বাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে ছিনতাইকারী অভিযোগে নির্যাতনে গুরুতর আহত হন। পরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তিনি মারা যান। এরপর গত ১২ অক্টোবর নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। তার আগেই রায়হান হত্যাকান্ডে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ ৫ জনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং ৩ জনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর গত ১৮ নভেম্বর রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক সৌমেন মিত্র এবং এসআই আব্দুল বাতেন ভুঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুলিশের সদর দপ্তরের তদন্ত দলের প্রতিবেদনের পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আর ঘটনায় এসআই আকবর হোসেনকে গত ৯ নভেম্বর দুপুরে কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
লালমনিরহাটে মুসল্লিকে পুড়িয়ে হত্যা : গত ২৯ অক্টোবর গুজব ছড়িয়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে আবু ইউনুস মো. শহিদুন্নবী জুয়েল (৪৫) নামের এক মুসল্লিকে হত্যা করা হয়। শুধু তাই নয়, নিহতের লাশ লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের ওপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় পৃথক ৩টি মামলায় এজাহার নামীয় ১১৪ আসামি এবং অজ্ঞাত শত শত আসামির মধ্যে এখন পর্যন্ত ৩৬ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার মধ্যে প্রথম মারধরকারী জুয়েল আলী ওরফে জুবেদ আলী এবং মুয়াজ্জিন আফিজ উদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, লালমনির হাটের আগুনে মানুষ পড়িয়ে হত্যার ঘটনার দিন মসজিদে আছরের নামাজের পর জুয়েল নামের এক ব্যক্তি ধর্মের অবমাননার অভিযোগে গুজব ছড়ানো হয়। এরপর শত শত মানুষ জড়ো হয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। আর তাকে পিটিয়ে হত্যার পর তার রক্তাক্ত লাশ আগুনে পোড়ানো হয়। শুধু তাই নয়, আগুনে পুড়ানোর ভিডিও সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে প্রতিবাদের ঝড় উঠে দেশ বিদেশে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ধর্ষণের ঘটনা : ২০২০ সালের গত ৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী এক আত্মীয়ের বাসায় দাওয়াতে যাচ্ছিলেন ক্ষণিকা বাসে। সন্ধ্যা ৭টায় শেওড়া বাস স্ট্যান্ডে না নেমে কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে নেমে যান। ভুল বুঝতে পেরে তিনি ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে ছিলেন। আর হঠাৎ করে তার পেছন থেকে এক ব্যক্তি তাকে পাশের কাটা ঝোপের ভেতরে ফেলে দেন। তখন ওই ছাত্রী চিৎকার করতে থাকলে তার গলা চেপে ধরে তার মুখে, বুকে ও পেটে কিল ঘুষি মারেন। এরপর ওই ছাত্রী নিস্তেজ হয়ে যান। একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তাকে ধর্ষণ করা হয়। ধর্ষণের পর তার ব্যাগ থেকে একটি প্যান্ট বের করে তাকে পরিয়ে দেন। ছাত্রীর জ্ঞান ফেরার পরে দেখেন তার পরনে যে প্যান্ট ছিল সেটা আর নেই। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় মজনু নামে একজনকে র‌্যাব গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা হয়। ওই মামলার অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় গত ১৯ নভেম্বর তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেন আদালত।
নোয়াখালীতে স্বামীকে বেঁধে গৃহবধূকে ধর্ষণ : নোয়াখালীতে স্বামীকে বেঁধে গৃহবধূকে ধর্ষণের ঘটনাটি চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এক গৃহবধূর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলে মেয়েকে নিয়ে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুরে বাবার বাড়িতে থাকতে ওই নারী। এরপর দীর্ঘ ১০ বছর পর গত ২ সেপ্টেম্বর স্বামী তার কাছে আসেন। এতে স্থানীয় দেলোয়ার বাহিনীর ক্যাডাররা ঘরের দরজা ভেঙে ওই নারীর ঘরে ঢোকে। পরে নারীর স্বামীকে পাশের রুমে বেঁধে রেখে ওই নারীকে উলঙ্গ করে নির্যাতন ও তার ভিডিও ধারণ করে। পরে ওই নারী এলাকা ছাড়া হলেও তাকে মোবাইল ফোনে নানা ধরনের হুমকি ও কু প্রস্তাব দিতো স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। তাদের প্রস্তাবে রাজী না হলে গত ৪ অক্টোবর সেই ভিডিও ফেসবুকে প্রকাশ করে দুর্বৃত্তরা। বিষয়টি প্রশাসনের নজরে এলে পুলিশ ও র‌্যাব তাদের গ্রেফতার করে। এ ঘটনায় ৯ জনকে আসামি করে মামলায় দায়ের করা হয়। এদের মধ্যে ৬ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।
সিলেটের এমসি কলেজ হোস্টেলে নববধূকে ধর্ষণ : সিলেটের এমসি কলেজ হোস্টেলে নববধূকে ধর্ষণের ঘটনাটি খোদ সরকারী দলের নেতাকর্মীরাই প্রতিবাদে মাঠে নামে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের টিলাগড় এলাকায় মুরারি চাঁদ কলেজ (এমসি) স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যান এক নববধূ। সেখানে ক্যাম্পাস থেকে তুলে ছাত্রাবাসে নিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। পরে তার স্বামী শাহপরাণ থানায় ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুর রহমানকে প্রধান আসামি করে মামলা করেন। মামলায় দ্রুত সময়ের মধ্যেই ৮ জনকে গ্রেফতার ও তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। আর ৮ আসামির ডিএনএ নমুনার সঙ্গে মামলার আলামত হিসেবে সংগ্রহ করা ডিএনএ নমুনার মিল পাওয়া যায়। পরে তাদের বিরুদ্ধে গত ৩ ডিসেম্বর সিলেটের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। ওই চার্জশিটে প্রধান আসামি সাইফুর রহমান, অর্জুন লস্কর, রবিউল ইসলাম, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, রাজন মিয়া, আইনুদ্দিন, মাহফুজুর রহমান ও তারিকুল ইসলাম তারেকের নাম উল্লেখ রয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতনের রোমহর্ষক ঘটনার মধ্যে এবার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আর তা হচ্ছে, মর্গের মৃত নারীদের লাশ ধর্ষণের ঘটনা। গত ১৯ নভেম্বর নগরীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গ থেকে মুন্না (২০) নামের এক ডোম সহকারীকে গ্রেফতার করে সিআইডি। মুন্না কয়েক বছর ধরে মৃত তরুণীদের লাশ ধর্ষণ করেছে। সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে সে স্বীকার করেছে মুন্না। ঘটনার পর সিআইডি জানিয়েছে, ফরেনসিক বিভাগের মর্গে ৭ জন নারীর শরীরে একই ধরনের শুক্রাণুর প্রমাণ মেলে। পরে মুন্নাকে গ্রেফতারের পরই ভয়ঙ্কর সব তথ্য পাওয়া যায়। মৃত নারীদের মধ্যে ১৫ থেকে ২০ বছরের লাশ টার্গেট করে ডোম মুন্না।
সূত্র জানায়, মৃত নারীদের হাসপাতালের লাশ কাটা ঘরে রাখা হতো। এরপর রাতে পাহাড়ার নামে নিয়মিত ধর্ষণ করতেন ডোম। ফলে মৃত নারীর ফরেনসিক রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায় একই। শুধু তাই নয়, ভিসেরা রিপোর্টে মৃত নারীর শরীর থেকে ডোমের শুক্রাণুর প্রমাণও পেয়েছে সিআইডি।
জানা গেছে, ২০১৫ সালে এক নারীর আত্মহত্যা জনিত মৃত্যুর ঘটনায় হাইকোর্ট এক ঐতিহাসিক নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাতে বলা হয়, অপমৃত্যুর মৃত্যুর ঘটনায় নারীদের যৌনাঙ্গ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে যে মৃত্যুর আগে ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেছিল কিনা। এরপর থেকেই আদালতের নির্দেশ মেনে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা করে। ওই নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে মোহাম্মদপুর ও কাফরুল থানার অপমৃত্যু হওয়া ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৭ তরুণীর মৃতদেহে শুক্রাণুর উপস্থিতি পায় সিআইডি। আর ডিএনএ বিশ্লেষণে ৭টি লাশেই একই ব্যক্তির শুক্রাণু পায়। সিআইডি বিষয়টি নিয়ে নড়েচড়ে বসে। তদন্তে ভয়ঙ্কর এক সিরিয়াল কিলারের খোঁজ করতে গিয়ে বের হয়ে আসে আসল রহস্য।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেছেন, ৩১ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত সেনা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার পর ক্রসফায়ারের সংখ্যা কমেছে। তবে দেশে সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। করোনা মহামারির কারণে অনেকে চাকরি ও আয়ের উৎস হারিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে খুন, ধর্ষণ, পারিবারিক সহিংসতা, চুরি ও অলিগলিতে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার অভাব ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর না হওয়ায় খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনা বাড়ছে। বছরের পর আদালতের মামলা চলায় ভুক্তভোগীরা বিচার পাওয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়ছে। মামলার সাক্ষী হাজিরে অনীহা এবং আলামতও নষ্ট হওয়ার ফলে সাজা পাওয়ার হার খুবই কম। দীর্ঘসূত্রতা এবং বিচারহীনতার কারণে ভুক্তভোগীরা অধিকাংশ মামলা করতেই চায় না। এসব ঘটনার দ্রুত বিচার হয়ে দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে অপরাধীরা ভয় পেতে এবং খুন-ধর্ষণের মত অপরাধ কমে যেত।
মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বলছে, ২০১৯ সালে এক হাজার ৪১৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর ২০২০ সালের ১১ মাসেই ধর্ষণের শিকার হয় ১ হাজার ৫৪৬ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫১ জনকে। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিলো মাত্র ৭৩২ জন। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৮১৮ জন নারী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭ বছর বয়স থেকে ১৮ বছরের শিশু ও কিশোরীরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন ২২০ জন। এরমধ্যে প্রথম সাত মাসে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২১০ জন। তবে ৩১ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত সেনা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান ক্রসফায়ারে মৃত্যুর পর পরবর্তী চার মাসে মাত্র ১০ জন ক্রসফায়ারে মারা গেছে। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ক্রসফায়ারের সংখ্যা ছিল ১৬০ জন। জুলাই মাসে ৫০ জন ক্রসফায়ারের শিকার হয়ে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ২১০ জনে। ক্রসফায়ারে আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ৩ জন করে এবং সর্বশেষ নভেম্বরে মারা গেছেন ১ জন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হত্যা-ধর্ষণ

১ জানুয়ারি, ২০২১
আরও পড়ুন