প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কের মাত্র এক চতুর্থাংশ ইউক্রেনকে দিচ্ছে পশ্চিমারা
ব্রিটেনের সানডে টাইমস রোববার জানিয়েছে, এপ্রিলের শুরুর মধ্যে ইউক্রেন পশ্চিম-প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কগুলোর এক চতুর্থাংশের কম পাবে। এতে
এখন ফেব্রুয়ারি মাস। বাংলায় ফাল্গুন। পুরো বাংলাদেশে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার বুকে যেন সাজ সাজ রব পড়ে গেছে ভাষা আন্দোলনের সেই বিশেষ দিনটি পালনের জন্য।
রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই।
দেশের কথা বলতে চাই।
আমরা সবাই ভাই ভাই।
যতো আদর্শবাদের বুলি যেন অপেক্ষা করে থাকে এই বিশেষ দিনটির জন্য।
তারপর!
দিনক্ষণ দেখে, খৈ-এর মতো ফুটতে থাকে অনর্গল- বিশ্রান্ত দেশ প্রেম।
ভালোবাসা। মা। আত্মত্যাগ। সব যেন একসাথে এসে ঠেলাঠেলি শুরু করে দেয়।
ঘেন্না ধরে গেছে রিফাতের অতিরিক্ত কথা বলা মানুষগুলোর ওপর।
পাঁচিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রিফাত শীলার ঘরটা। দোতলা বাড়ি। জানালার পাশে রকিং চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছে আর পড়ছে শীলা। ১৬ বছরের কিশোরী। দুটো বেণী দুলছে বুকের দুপাশ দিয়ে। এই বয়সেই চশমা নিয়েছে শীলা। খুব পড়ে বোধ হয়। হয়তো বা ক্লাসের সেরা ছাত্রী। সেরা বক্তা। সেরা ব্যক্তিত্ব। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ঘেন্নার হাসি হাসলো রিফাত।
আজকাল আবার এসবের কোন দাম আছে নাকি? এই পুরুষ শাসিত সমাজে, যেখানে বিচরণ করছে জিভ লকলক করা নেকড়ে কিংবা হায়েনার মতো কিছু জন্তু।
শীলা তখনো স্বভাব সুলভ চঞ্চলতা নিয়ে দুলছে আর পড়ছে।
ওকি তবে কোন কবিতা পড়ছে?
রিফাতের চোখ দুটো একটু ভিজে আসতে চাইলো। একটু চিন চিন করে উঠলো বুকের ভেতরটা। কিন্তু পরক্ষণেই অত্যন্ত কঠোরভাবে নিজেকে সামলে নিল।
শীলা রিফাতের নাড়ী ছেড়া ধন। রিফাতের জীবন মরণ। হৃদপিন্ডের স্পন্দন। শীলা রিফাতের একমাত্র সন্তান। শীলার এই সহজ সরল জীবন, এই দোল খাওয়া চঞ্চল দুটো চোখ, বেনীতে জড়ানো পবিত্র স্বপ্ন। যদি কোনদিন অপমানিত আর অবহেলিত হয়? নিঃশ্বাসটা যেন একটু বন্ধ হয়ে আসে রিফাতের।
না! ওই চাঁপা কলির মতো মেয়েটাকে নিয়ে আর কিছু ভাবতে পারে না রিফাত। আর কিছু ভাবতে চাও না। কারণ একটি মাত্র বিশ্বাস আর ভরসা নিয়েই তো সে বেঁচে আছে।
শুনছে, মায়ের প্রতিটি নিঃশ্বাস সন্তানের জন্যে দোয়া হয়ে আসে।
সেই মা-রিফাত।
প্রতিক্ষণ, প্রতি মুহূর্ত, আশীর্বাদের সমুদ্রে ডুবিয়ে রাখবে রিফাত তার শীলাকে। সৃষ্টিকর্তার কাছে এই একটি মাত্র কথাই তো বলছে রিফাত গত ১৫টি বছর ধরে।
কাছে থেকে, দূরে থেকে কখনো রাস্তায়-কখনো পাঁচিলের পাশে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে, কখনো স্কুলের গেটের সামনে, শয়নে, স্বপনে জাগরণে জীবনের সমস্ত সুখ শান্তি, প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি রক্ত বিন্দুর বিনিময়ে বিধাতার কাছে শীলার শান্তিময় জীবন কামনা করেছে রিফাত।
এছাড়া আছেই বা কি রিফাতের জীবনে।
প্রথমে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং পরে একটি এতিমখানার সাথে জড়িত গত ১০ বছর থেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকস মেয়ে ছিল রিফাত। রিফাত জাহান। প্রদীপ্ত তারুণ্যের ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত ছিল রিফাত। ভালো বক্তা ছিল। আবৃত্তি করতো চমৎকার। সাহস ছিল দুর্বার। সভা-সমিতি, আন্দোলন-মিছিল, প্রভাত ফেরী, কোনটাতেই ক্লান্তি ছিল না রিফাতের।
হলে থাকতো। বাবা মা ছিলেন না। গার্জেন ছিলেন এক মামা।
এক ২১ ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরির শেষে শহীদ মিনারে প্রথম দেখা হয়েছিল ছাত্রনেতা হাসিবের সাথে। রিফাত বলেছিল,
: আপনার গাইবার উদাত্ত ভঙ্গিটি ভারী চমৎকার।
: তাই নাকি ?
: মনে হচ্ছিল আপনি ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় যোদ্ধা।
: হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।
এরপর ক্যাম্পাসেই দেখা হতো মাঝে মাঝে।
একসাথে গলা মিলিয়ে শ্লোগান দিয়েছে। গেয়েছে জাগবার গান। এবং একদিন পাশাপাশি চলতে চলতে একে অন্যের হাত ধরে ফেলেছিল অজান্তে।
এরপর!
একদিন কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করলো ওরা।
রক্তে তখন দারুণ নেশা। হাসিবের সব কাজের সঙ্গী এবং প্রেরণা শুধু রিফাত। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের দামামা বাজলো। সাজ সাজ রব পড়ে গেল চারদিকে। রিফাতের কোলে তখন শীলা নামের ফুটফুটে একটি মেয়ে।
অবস্থা যখন সঙ্গীন তখন শহর থেকে গ্রামে চলে গেল সবাই। মামার বাড়িতে। এ গ্রাম থেকে সে গ্রামে দল গঠন করছে তখন দেশের তরুণরা। ছাত্রনেতা হাসিবও তাদের একজন। ওই টুকুন শিশু কোলে রিফাতও সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে হাসিবের সহকর্মীদের। কোন অবস্থাতেই বসে থাকেনি রিফাত।
হাসিবের অস্থিরতা দেখে ভীষণ খারাপ লাগতো রিফাতের। ভাবতো, কবে হবে যুদ্ধের অবসান? কবে আসবে স্বাধীনতা? কবে আবার খুব কাছে পাবে হাসিবকে?
হঠাৎ, হঠাৎ রাতে আসতো হাসিব।
রিফাতের কাছে মনে হতো ওই সময়টুকুই তার স্বর্ণ মুহূর্ত। এমনি করে কেটেছে প্রায় ন’মাস। মুক্তি প্রায় আসন্ন। এরই মধ্যে আসলো সেই অমানিশার রাত। সন্ধ্যা রাতে এসে গেছে হাসিব।
সেই সুখটুকুন নিয়ে বোধ হয় সুখনিদ্রা এসেছিল রিফাতের চোখে। আর সেই সুখনিদ্রা ভাঙ্গিয়ে ঘরে ঢুকলো কারা যেন। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখতে পায়নি রিফাত। কিন্তু অনুমান করতে পেরেছিল। এবং ঘটেছিল সেই ঘটনা।
ওরা তুলে নিয়ে গেল রিফাতের মুখে কাপড় গুঁজে। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল রিফাত।
এর পরের ঘটনা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এরপর এলো ১৬ ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হলো।
অনেকেই ঘরে ফিরে এলো। হাসিবও এলো এবং দেখলো। বুঝলো সব। কী অবস্থা হয়েছিল তখন যুদ্ধেজয়ী সৈনিক হাসিবের? রিফাত তা জানে না। বেশ কয়েকদিন পর ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় রিফাত এসে দাঁড়ালো বাড়ির দরজায়। ঘরেই ছিল হাসিব। দরজা খুলেই দেখলো ঝড়ে আহত পাখি রিফাতকে।
কিছুক্ষণ কারো মুখেই কথা সরলো না। রিফাতের মনে হলো কোথায় যেন কাঁশর বাজছে। ঝাঝরা বাজছে। রিফাত যেন সেই অসহ্য ঝনঝনানি শুনতে শুনতে তলিয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে এই লোকালয় থেকে।
হাসিব স্তব্ধ। পাথর।
ক্ষত বিক্ষত রিফাতের দৃষ্টি তখনো স্থির হয়ে আছে হাসিবের চোখে। দুটো কম্পিত বাহু প্রসারিত করলো রিফাত। ওর স্থির বিশ্বাস, এখনই ব্যাকুল তৃষ্ণার্ত প্রেমিক স্বামী হাসিব ওকে আকুল হয়ে বুকে টেনে নেবে। কিন্তু কই? হাসিব কি তবে সত্যি পাথর হয়ে গেছে? কোথায় সে ব্যগ্রতা, তৃষ্ণা, আর প্রিয়া মিলনের আনন্দ?
হাসিব কি তবে বিশ্বাস করতে পারছে না যে তার রিফাত ফিরে এসেছে। কিন্তু না। হাসিব পাথর হয়ে যায়নি। হাসিব ঘামছে। পেশীর স্থূল বাহু দুটি স্থির। মুষ্টিবদ্ধ। কিন্তু পাঞ্জাবীর আড়ালে বুকের ভেতরটাও কি স্থির? অবিচল?
এ কোথায় এসেছে রিফাত? কার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দুবাহু বাড়িয়ে দিয়েছে? ভুল করেনি তো রিফাত? একি সেই হাসিব?
এরপর কখন রিফাতের প্রসারিত দুটো বাহু সংকুচিত হয়ে এসেছে আপনা থেকে, কখন জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেছে দোর গোড়ায় ও জানে না।
যখন জ্ঞান ফিরে এসেছে তখন সে একটা নার্সিং হোমে।
মোটা অংকের একটা চেক পাঠিয়েছে হাসিব; নার্সিং হোমের ডাক্তার রকিব চৌধুরীকে দিয়ে। রিফাতের নামে। না-একটুও কাঁদেনি রিফাত। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সেই চেকটা ফেরত দিয়েছে ডা. চৌধুরীর হাতে। বলেছে: ‘ধন্যবাদ। আমার পাওনা আমি পেয়ে গেছি ডা. চৌধুরী। তবে আপনার কাছে আমার একটি প্রার্থনা, আমার নিজের কোন ঠিকানা থাকুক না থাকুক-কিন্তু আপনার এই ঠিকানা থেকে আমি আমার মেয়ের খবর নিয়মিত নেব। বলুন পাব তো’?
কথা দিয়েছিলেন ডা. চৌধুরী।
নার্সিং হোম থেকে বেরিয়ে কয়েক বছর একটা মাতৃ সদনে ছিল রিফাত।
তারপর থেকেই পুরোপুরিভাবে একটি অনাথ আশ্রমে। এবং এই অনাথ আশ্রমের কোলাহলের মধ্যেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে ভার্সিটির চৌকস সংগ্রামী মেয়ে রিফাত। আর দিন রাত এই সব শিশুদের মাঝে খুঁজেছে শীলাকে। একটি দেশকে অপবিত্রতা থেকে বাঁচাবে বলে যুদ্ধ করেছে যে দেশের তরুণরা তাদেরই একজন একটি জীবনকে ঘরে ঠাঁই দিতে পারলো না। ছিঃ ঘৃনা ধরে গেছে রিফাতের হাসিবের মতো মেরুদন্ডহীন পুরুষদের ওপরে।
কারো স্ত্রী প্রিয়া হয়ে থাকতে না পারলেও মা হয়ে সে বেঁচে থাকবে। কাছে না থাকুক দূর থেকেই শীলার চারদিকের বায়ুমন্ডলে শুভাশীষের দেয়াল তুলে দেবে রিফাত আজীবন ধরে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।