Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯ আশ্বিন ১৪৩১, ২০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ফুলশিল্পে অশনি সঙ্কেত

প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ৩০ লাখ মানুষ জড়িত প্লাস্টিকের ফুল ধ্বংস করছে সকল সম্ভাবনা

মিজানুর রহমান তোতা | প্রকাশের সময় : ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

কথায় আছে-দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা দেয়া হয় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বাংলায় বিভিন্ন সম্ভাবনাময় শিল্প গড়ে ওঠে যুগে যুগে। কিন্তু যথাযথ দৃষ্টি না দেয়ায় কালের গর্ভে অনেক শিল্প হারিয়ে যায়। বর্তমানে ফুল একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। ফুল শুধু সৌন্দর্য, উৎকর্ষতা ও স্নিগ্ধতার প্রতীকই শুধু নয়, এর বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিরাট।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, নিকট অতীতেও কোটি কোটি টাকার ফুল আসতো প্রতিবেশি ভারত থেকে। কর্মবীর কৃষকরা সেটি বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। কোনরূপ সাহায্য সহযোগিতা কিংবা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই তারা সীমান্তবর্তী যশোরের গদখালিতে বাণিজ্যিকভাবে ফুল উৎপাদন করে বিপ্লব ঘটিয়ে সৃষ্টি করেছেন রঙিন ইতিহাস। কিন্তু শিল্পটিতে অশনি সঙ্কেত ধ্বনিত হচ্ছে ফুল রফতানির প্রতিবন্ধকতা ও প্লাস্টিকের ফুল আমদানির কারণে।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি জানায়, ফুল উৎপাদনের সূতিকাগার যশোরের অনুকরণে দেশের ২৫টি জেলায় ফুল উৎপাদন বিস্তৃতি ঘটেছে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমিতে রকমারি ফুল উৎপাদন হচ্ছে। সরাসরি ২০ হাজার কৃষক কাজ করছেন। এর বাইরে ফুল উৎপাদন, বিপননসহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ৩০ লাখ মানুষ। তাদের জীবিকা নির্বাহ হচ্ছে ফুল শিল্পে। বহু মানুষের ভাগ্য বদলের মাধ্যম ফুল। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে শিল্পটি মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর পর্যায় সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম দৈনিক ইনকিলাবকে জানান, যশোর, ঝিনাইদহ, মহেশপুর, কালীগঞ্জ, সাভার, মানিকগঞ্জ ও চুয়াডাঙ্গাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে ব্যাপক আকারে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ হচ্ছে। ফুলের ব্যাপক চাহিদার কারণে আগের চেয়ে উৎপাদন হচ্ছে অনেক বেশি। তাছাড়া ফুল ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হয়েছে। ঘটছে নীরব বিপ্লব। নিকট অতীতে এতো ব্যাপক আকারে বানিজ্যিকভাবে ফুল চাষ হতো না। চাহিদা মিটতো আমদানি করা ফুলে। কয়েক বছরের ব্যবধানে কৃষির এই খাতটিতে সফলতা এসেছে। দেখা দিয়েছে বিরাট সম্ভাবনা। ইতোমধ্যে যশোরে ২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এলজিইডি আধুনিক ফুল প্রক্রিয়াজতকরণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। ঢাকা গাবতলী ভেড়িবাঁধের পাশে স্থায়ীভাবে ফুলের একটি পাইকারি মার্কেট স্থাপন হচ্ছে। ঢাকা সেন্ট্রাল মার্কেটের লিংকে যশোর, চুয়াডাঙ্গা ও সাভারে আরো ৪টি ফুল মার্কেট হবে।

সূত্র জানায়, এই মুহূর্তে শিল্পটি ধ্বংসের পথে ধাবিত হচ্ছে সরকারি পৃষ্টপোষকতা ও সুদৃষ্টির অভাবে। ফুল ব্যবসায়ীরা সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন করে সরকারের কাছে দাবি জানায় প্লাস্টিকের ফুল আমদানি নিষিদ্ধ করা না হলে সেক্টরটি মুখ থুবড়ে পড়বে। তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে সম্ভাবনাময় ফুলশিল্পে প্লাষ্টিক ফুল কী কী ক্ষতি করছে, পরিবেশের জন্যই বা কতটা হুমকিস্বরুপ তা উল্লেখ করেছেন। প্লাস্টিক ফুল বন্ধ করতে ৫০০% ট্যাক্স ও ভ্যাট আরোপ করার পরামর্শও দেওয়া হয়। কিন্তু ৫ মাসেও তা কার্যকর হয়নি বা দাবি পুরণ হয়নি। সংশ্লিষ্টরা জানান, কাঁচা ফুলের আকার আকৃতির প্লাস্টিকের ফুল আমদানি করছেন ঢাকা ও চট্রগ্রামের কিছু স্বার্থান্বেষি ইভেন্ট কোম্পানি। সংশ্লিষ্টরা সবাই একবাক্যে বলেছেন, ফুলের বাজার নষ্ট করছে প্লাষ্টিকের ফুল। চীন ও থাইল্যান্ড থেকে প্লাস্টিক ফুল ব্যাপকভাবে আমদানি হচ্ছে। প্লাস্টিকের ফুলের কারণে ফুল উৎপাদনের ভরা মৌসুমে এবারের বিজয় দিবসে আশানুরূপ ফুল বিক্রি হয়নি। সাধারণত বিজয় দিবস, বসন্ত , ভালোবাসা দিবস, একুশে ফেব্রæয়ারি, স্বাধীনতা দিবস এবং বাংলা ও নববর্ষে ফুল বেচাকেনা হয় বেশি। নানা সমস্যা সঙ্কট তো আছেই তাছাড়া ফুল রফতানির প্রতিবন্ধকতা দুর হয়নি।

ফুলশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানান, প্রতিবছর গড়ে ১৪ শ’ কোটি টাকার ফুল উৎপাদন হচ্ছে দেশে। এর মধ্যে মাত্র আড়াইশো’ কোটি টাকার ফুল রফতানি হয়। তাও সবজি ও পান হিসেবে। জানা যায়, কাতার, দুবাই, সউদী আরবসহ বিভিন্ন দেশে ফুলের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। কিন্তু রফতানির নীতিমালার অভাবে নামকাওয়াস্তে ফুল রফতানি হয়। বাংলাদেশের ফুলের চেয়ে তুলনামূলক নিম্মমানের ফুল উৎপাদন করে ভারত বিদেশে রফতানি করে কাড়িকাড়ি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক পার্থপ্রতিম সাহা জানান, যশোরের মাটি ফুল উৎপাদনের জন্য খুবই সহায়ক। এখানকার রজনীগন্ধা খুবই হৃষ্টপুষ্ট।

অপূর্ব সৌন্দর্য্য ও রঙিন ইতিহাস সৃষ্টিকারী ফুলরাজ্য যশোরের গদখালিতে সরেজমিন দেখা গেছে, সেখানে চলছে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ। যশোর-বেনাপোল আন্তর্জাতিক সড়কের গা ঘেঁষে ঝিকরগাছা উপজেলাধীন গদখালী। গদখালী বাজার পয়েন্ট থেকে সোজা দক্ষিণে পটুয়াপাড়া, হাড়িয়া, নীলকন্ঠনগর, পানিসারা, কাউরা, নারাঙ্গালী, কৃঞ্চচন্দ্রপুর, কুলিয়া. চাদপুর, কানাইরালি, আশশিংড়ীসহ গ্রামের পর গ্রামের মাঠে মাঠে শুধু ফুল আর ফুল চাষ হচ্ছে। রজনীগন্ধার পাশাপাশি ঝাউ কলম ফুল, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, লিলিয়াম, লাল গোলাপ, সাদা গোলাপ, কালো গোলাপ, হলুদ গোলাপ, গাঁদা, জবা, জুই জারবেরা, কসমস, ডেইজ জিপসি, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুল উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু চাষিদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা। তাদের কথা, শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ফুলের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু চাহিদানুযায়ী সরবরাহ করা যাচ্ছে না।

ফুলকে ঘিরে চাষ, পরিচর্যা, ফুল তোলা, বান্ডিল করা, সংরক্ষণ, পরিবহন, ক্রয় ও বিক্রয়সহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান করে দিয়েছে এই খাতটি। প্রতিদিন উপজেলার পানিসারার শত শত ফুলচাষির আনাগোনা শুরু হয় গদখালীর বাজারে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোট-বড় পাইকাররাও সেখান থেকে ফুল কিনে নিয়ে যান। এরপর বিভিন্ন হাতবদল হয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ফুল ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। কিন্তু ফুল উৎপাদন ও বিকিকিনির সঙ্গে জড়িতদের মনোকষ্ট দিন দিন বাড়ছে। ফুলচাষি গদখালির হাড়িয়াখালি গ্রামের সাজেদা বেগম ও নারাঙ্গালী গ্রামের আবু তাহের জানান, সরকার প্লাস্টিকের ফুল আমদানি বন্ধ না করলে আমরা দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হবো। ফুলশিল্প পড়বে হুমকির মুখে।

যশোর মাইকেল মধুসূদন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ভ‚গোল ও পরিবেশ ভিাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর আব্দুল কাদের এ প্রসঙ্গে বলেন, প্লাস্টিক ফুল পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। মাটির ক্ষতি করে অপুরণীয়। মৃত্তিকা অণুজীবের ক্ষতি করে। প্লাস্টিকের কেমিক্যাল দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশের ক্ষতি করছে। প্লাস্টিক পচে না বিধায় পয়ঃনিষ্কাশনের চরম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

অর্থনীতিবিদ প্রফেসর সেলিম রেজা জানালেন, ফুল খাতটি খুবই সমৃদ্ধ। আমাদের দেশের ফুল বিদেশে চাহিদা বাড়ছে। এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহু লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। রঙিন ইতিহাসের পাশাপাশি অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিরাট। ফুলশিল্পটি বিকাশলাভ করার মুহূর্তে প্লাস্টিক ফুল আমদানি হচ্ছে আত্মঘাতি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ফুল

৮ জানুয়ারি, ২০২৩
২৯ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ