দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
ন্যায়বিচারের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইসলাম অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায়ানুগ হওয়া আবশ্যক। ন্যায়পরায়ণতা বিবেকের শক্তি ও ভালো কাজের দীপ্তি। ন্যায়পরায়ণতা ও ইনসাফ এমন নিক্তি যার মাধ্যমে মানবতা আজ কিছুটা হলেও জিন্দা। কোনো সমাজে যদি ইনসাফ ও ন্যায়পরায়ণতা না থাকে, তাহলে সেটা কোনো আদর্শ সমাজ হতে পারে না। বরং জুলুম-অত্যাচার, প্রভাব-বলয় প্রতিষ্ঠার কেন্দ্র হয়ে যায়। সুরা মায়িদায় মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর জন্য ন্যায়ের সাথে সাক্ষ্যদানকারী হিসেবে সদা দন্ডায়মান হও। কোনো কওমের প্রতি শত্রæতা যেন তোমাদেরকে কোনোভাবে প্ররোচিত না করে যে, তোমরা ইনসাফ করবে না। তোমরা ইনসাফ কর, তা তাকওয়ার নিকটতর এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে সবিশেষ অবহিত।’ (সুরা মায়িদা : ৮) মহান আল্লাহর এই কথার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা। রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, গোলাম-মনিব, বিচারক-আসামী এগুলোর মধ্যে কোনো তফাৎ না করা।
পৃথিবীতে ন্যায়বিচারের অনন্য নজির স্থাপন করে গেছেন মহানবী (সা.)। তাঁর সময়ের বিচারব্যবস্থা এতটাই ইনসাফপূর্ণ ছিল যে তাতে সবাই সমান আস্থা রাখত। কারণ তিনি ছিলেন একজন নিরপেক্ষ বিচারক। তাই তো মহান আল্লাহ নবীজিকে বারবার ন্যায়বিচারের তাকিদ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘বল, আমার প্রভু! আমাকে ন্যায় বিচার করার নির্দেশ দিয়েছেন। তোমরা যখন বিচার কর, ন্যায় বিচার কর। তোমাদের মধ্যে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমি আদিষ্ট হয়েছি।’ (সুরা শুআরা : ১৫) অন্যত্র এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর আপনি যদি ফয়সালা করেন, তবে ন্যায়সংগত ফয়সালা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মায়িদা : ৪২) সাহাবায়ে কেরামও ন্যায়বিচারের প্রতি অত্যন্ত যতœবান ছিলেন। হজরত ওমর (রা.)-এর ন্যায়পরায়ণতা তো খুবই প্রসিদ্ধ। নিজের আত্মীয়ের বিপক্ষে গেলেও ন্যায়বিচার করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনগণ, তোমরা ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী হয়ে যাও আল্লাহর সাক্ষীরূপে; যদিও তা তোমাদের নিজের অথবা মাতা-পিতার ও আত্মীয়-স্বজনের প্রতিকূল হয়। কেউ যদি সম্পদশালী কিংবা দরিদ্র হয়, তাহলে আল্লাহ তোমাদের চেয়ে তাদের ব্যাপারে অধিক কল্যাণকামী। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ কর না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কর্ম সম্পর্কেই অবগত।’ (সুরা নিসা : ১৩৫) সুরা আনআমেও আত্মীয় হলে ন্যায়বিচারের তাকিদ দেওয়া হয়েছে, ‘যখন কোনো (বিবদমান) বিষয়ে তোমাদের কোনো কিছু বলতে কিংবা মীমাংসা করতে হয়, তখন ন্যায়বিচার করবে যদিও (বিবদমান পক্ষ) তোমাদের কোনো নিকটাত্মীয় হয়।’ (সুরা আনআম : ১৫২) ন্যায়পরায়ণতা এমন এক গুণ, মানুষের মাঝে এই একটি মাত্র গুণ থাকলেই সে আর কোনো অপরাধ করতে পারবে না। ন্যায়পরায়ণতা মানুষের মাঝে সুস্থ বিবেক তৈরি করে এবং মানুষে মানুষে সৃষ্ট ভেদাভেদ মিটিয়ে দেয়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনকে দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসংগত কাজ ও অবাধ্যতা করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা স্মরণ রাখ।’ (সুরা নাহল : ৯০) নীতিবান শাসক তারা যাদেরকে মানুষ ভালোবাসে। আর নিকৃষ্ট শাসক তারা যাদেরকে মানুষ ঘৃণার চোখে দেখে। আওফ ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুল (সা.)-কে বলেতে শুনেছি, তিনি বলেন, তোমাদের সর্বোত্তম শাসক হলো তারা, যাদের তোমরা ভালোবাস এবং তারাও তোমাদের ভালোবাসে। তোমরা তাদের সাথে মিলিত হও এবং তারাও তোমাদের সাথে মিলিত হয়। আর তোমাদের সর্বনিকৃষ্ট শাসক হলো তারা, যাদের তোমরা ঘৃণা কর এবং তারাও তোমাদের ঘৃণা করে। তোমরা তাদের লানত কর এবং তারাও তোমাদের লানত করে।’ (মুসলিম : ১৮৫৫) নীতিবান বিচারকের অনেক মূল্যবান পুরস্কার রয়েছে মহান আল্লাহর কাছে। কিয়ামতের দিন তাদের রবের সান্নিধ্য লাভের অপূর্ব সুযোগ হবে। আবু সাঈদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘কিয়ামতের দিন লোকদের মাঝে ন্যায়নিষ্ঠ শাসকই হবে আল্লাহ তায়ালার সবচেয়ে প্রিয় ও নিকটে উপবেশনকারী। আর তাদের মাঝে অত্যাচারী শাসকই হবে আল্লাহতায়ালার সবচেয়ে ঘৃণিত ও দূরে।’ আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘ন্যায় বিচারকগণ (কিয়ামতের দিন) আল্লাহ তায়ালার নিকট নুরের মিম্বারে মহামহিম দয়াময় প্রভুর ডানপাশে উপবিষ্ট থাকবে-আর তাঁর উভয় হাতই ডান হাত (তথা সমান মহিয়ান)-যারা তাদের শাসনকার্যে তাদের পরিবারের লোকদের ব্যাপারে ও তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বসমূহের ব্যাপারে সুবিচার করে।’ (মুসলিম : ১৮২৭) নীতিবান শাসক মহান আল্লাহর ছায়া পাবেন হাশরের দিন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যেদিন আল্লাহর ছায়া ব্যতীত অন্য কারও ছায়া বাকি থাকবে না, সেদিন আল্লাহতায়ালা সাত ব্যক্তিকে ছায়া দেবেন। একজন হলো ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ।’ (বুখারি : ৬৬০) পক্ষান্তরে অত্যাচারী, স্বৈরাচার শাসকের জন্য রয়েছে পরকালে শাস্তির হুশিয়ারি। ইহকালেও নেমে আসতে পারে যেকোনো বিপদ-মুসিবত। রাসুল (সা.) বলেন, ‘কোনো বান্দাকে যদি আল্লাহ জনগণের নেতৃত্ব প্রদান করেন, আর সে যদি কল্যাণ কামনার সঙ্গে তাদের তত্ত¡াবধান না করে, তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না।’ (বুখারি : ৭১৫০)। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি মুসলিম জনসাধারণের দায়িত্ব লাভ করল আর তার মৃত্যু হলো এই অবস্থায় যে, সে ছিল খেয়ানতকারী, তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’ (বুখারি : ৭১৫১)। ন্যয়বিচার করলে আল্লাহর সাহায্য নেমে আসে। আর জুলুম-অত্যাচার করলে আল্লাহর সাহায্য ওঠে যায়। শয়তান হয়ে যায় সাথী। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আউফা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা একজন বিচারকের সাথে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ তিনি বিচারকাজে জুলুম-অত্যাচারের ঊর্দ্ধে থাকেন, যখন তিনি জুলুম ও বেইনসাফি করেন তখনই আল্লাহ তার থেকে পৃথক হয়ে যান এবং শয়তান এসে তার সাথী হয়ে যায়।’ (তিরমিজি : ১৩৩০)। তাই সব শ্রেণির শাসকদের দায়িত্বকে তাদের আমানত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পদ-পদবীগুলোতেও সর্বাধিক যোগ্য লোকদের নিয়োগ দিতে হবে। তাহলেই সমাজ থেকে স্বজনপ্রীতি, ঘুষ-উৎকোচসহ সব রকমের অনৈতিকতা প্রশ্রয় পাবে না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।