Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সউদীতে ৫০ হাজার নারী কর্মী বিপাকে

সম্মতি ছাড়াই ইকামার মেয়াদ বৃদ্ধি করোনার অজুহাতে কাজে বাধ্য করা হচ্ছে

শামসুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

বিশ্বের সর্ববৃহৎ শ্রমবাজার সউদী আরব। দেশটিতে প্রায় বিশ লাখ বাংলাদেশি নারী-পুরুষ কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে প্রচুর রেমিট্যান্স দেশে পাঠাচ্ছে। কিন্তু কতিপয় কফিলের স্বেচ্ছাচারিতার দারুণ দেশটিতে কর্মরত প্রবাসী বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীরা নানাভাবে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অনেকেই নিয়মিত বেতন ভাতাও পাচ্ছে না। দু’বছর চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও জিম্মিদশায় অনেক নারী গৃহকর্মীকে কাজ করাতে বাধ্য করা হচ্ছে। ফলে প্রবাসী নারী গৃহকর্মীদের আত্মীয়-স্বজন ও রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাঝে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে। আত্মীয়-স্বজনরা সউদীতে কর্মরত নারী গৃহকর্মীদের চাকরির মেয়াদ দু’বছর সম্পন্ন হবার পর তাদের দেশে ফেরত আনার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে প্রতিনিয়ত চাপ দিচ্ছে। এ জন্য অনেক রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট অফিসে অভিযোগপত্রও দাখিল করছেন স্বজনরা। এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে প্রতি নিয়ত তুমুল বাকবিতন্ডা হচ্ছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মিশনের শ্রম উইংগুলোর গতি বাড়াতে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। বিদেশে নিয়োগকর্তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা এবং বাংলাদেশি শ্রমবাজারের সফলতা তুলে ধরতে পারলে জনশক্তি রফতানিতে গতি বাড়বে। করোনা পরবর্তী বহির্বিশ্বের শ্রমবাজার ধরে রাখতে মিশনের শ্রম উইংগুলোকে ব্যাপক তৎপর হতে হবে বলেও বায়রার একাধিক সূত্র অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

করোনা মহামারি কিছুটা শিথিল হওয়ায় গত দু’মাস ধরে ছুটিতে আটকে পড়া প্রবাসী কর্মী ও নতুন কর্মীরা দেশটিতে যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকাস্থ সউদী দূতাবাসে কর্মীদের ভিসা ইস্যু প্রক্রিয়ায় সপ্তাহে এক দিন বিশটি পাসপোর্ট জমা দেয়ার নিয়ম চালু করায় প্রবাসী কর্মীদের হয়রানি ও ভোগান্তি দিন দিন বাড়ছে। সউদী নিয়োগ কর্তারা (কফিল) কোনো জবাবদিহিতার আওতায় না থাকায় চুক্তি লঙ্ঘন করে বাংলাদেশি নারী কর্মীদের জোরপূর্বক কাজ করাতে বাধ্য করছে। এতে সউদীতে কর্মরত প্রায় ৫০ হাজার নারী কর্মী বিপাকে পড়েছে।

বিএমইটির সূত্র জানায়, ২০১৫ সাল থেকে সউদী আরবে দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী মুসানেদ প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি মহিলা গৃহকর্মী প্রেরণ শুরু হয়। ১৯৯১ সাল থেকে ২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত দেশটিতে ৩ লাখ ৫১ হাজার ৯৫০ জন মহিলা কর্মী চাকরি লাভ করেছে। এর মধ্যে ২০১৫ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত সউদীতে ৩ লাখ ১৯ হাজার ৮১৩ জন মহিলা গৃহকর্মী চাকরি পেয়েছে। ২০১৯ সালে সউদীতে ৬২ হাজার ৫৭৮ জন মহিলা গৃহকর্মী চাকরি লাভ করেছে। একই বছর জর্ডানে চাকরি লাভ করেছে ১৯ হাজার ৭০৬ জন মহিলা কর্মী।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এক কোটিরও বেশি কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আয় করছে। রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই একের পরে এক রেকর্ড গড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। প্রথমবারের মতো ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করেছে রিজার্ভ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন বৈধপথে রেমিট্যান্স আসছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরে ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। একক মাস হিসেবে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এ যাবৎ কালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ। এর আগে সর্বোচ্চ রেকর্ড রেমিট্যান্স এসেছিল চলতি বছরের জুলাইয়ে। ওই মাসে রেমিট্যান্স আসে ২৫৯ কোটি প্রায় ৫ লাখ ডলার। এর আগের মাস জুনে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮৩ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
এদিকে চলতি অর্থবছরের ৩ মাসে জুলাই-সেপ্টেম্বর রেমিট্যান্স এসেছে ৬৭১ কোটি ৩০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময় রেমিট্যান্স এসেছিল ৪৫২ কোটি ডলার। সেই হিসেবে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৪৮.৫৭ শতাংশ।

দ্বি-পাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী দু’বছর কাজ করার পর নিয়োগকর্তা (কফিল) গৃহকর্মীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ এবং বিমানের টিকিট দিয়ে দেশে পাঠানোর কথা। কিন্তু করোনা মহামারির অজুহাতে দু’বছর মেয়াদ শেষ হবার পরেও নারী কর্মীদের কর্মস্থল থেকে অব্যহতি দিচ্ছে না কফিলরা। কর্মরত গৃহকর্মীদের সম্মতি ছাড়াই কফিলরা কৌশলে দু’বছরের অতিরিক্ত ইকামার মেয়াদ বাড়িয়ে কাজ করাতে বাধ্য করছে। এতে প্রবাসী নারী গৃহকর্মীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সউদী নিয়োগকর্তারা (কফিল) কোনো প্রকার জবাবদিহিতার আওতায় না থাকায় তারা বাংলাদেশি নারী কর্মীদের ওপর জুলুম করতে সাহস পাচ্ছে। অনতিবিলম্বে ক‚টনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে সউদীতে দু’বছর মেয়াদ সম্পন্ন কর্মরত নারী কর্মীদের স্বেচ্ছায় দেশে আনার বাস্তবমুখী উদ্যোগ নিতে হবে। ফিমেল ওয়ার্কার্স রিক্রুটিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ফোরাব) এর মহাসচিব মহিউদ্দিন এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, মহিলা কর্মীদের দুই বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও চুক্তিবহির্ভূতভাবে তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। অনেক মহিলা কর্মীকে ঠিক মতো বেতন ভাতাও দিচ্ছে না কফিলরা। এতে সউদীতে কর্মরত মহিলা কর্মীরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে মহাসচিব মহিউদ্দিন বলেন, প্রবাসী মহিলা কর্মীদের স্বার্থ রক্ষায় সউদী কফিলদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। সউদী থেকে পুরোনো মহিলা কর্মীদের দেশে আসার সুযোগ দিলে তারা পুনরায় ১২শ’ থেকে ১৩শ’ রিয়াল বেতনে দেশটিতে যেতে পারবে। এতে দেশে রেমিট্যান্সের আয়ের পরিমাণও বাড়বে। তিনি বলেন, রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত জাভেদ পাটওয়ারীকে মৌখিকভাবে অবহিত করা হয়েছে। ফোরাবের পক্ষ থেকে শিগগিরই সউদীতে কর্মরত দুই বছর মেয়াদ অতিক্রম হওয়া মহিলা কর্মীদের দেশে ফেরার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন পেশ করা হবে।

নগরীর ফকিরাপুলস্থ একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে সউদীতে যাওয়া কেরাণীগঞ্জের আলো সনিয়াকে দীর্ঘ চার বছর পর জেদ্দাস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেটের লেবার কাউন্সেলর (শ্রম) মো. আমিনুল ইসলামের সহযোগিতায় গত ২৪ অক্টোবর দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আলো সনিয়ার কফিলকে জেদ্দাস্থ দূতাবাসে ডেকে তার বকেয়া বেতনের ৯৭ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। তার প্রতি মাসে বেতন ছিল ৮শ’ রিয়াল। বর্তমানে সে ১২ রিয়াল বেতনে সউদীর অন্য কফিলের অধীনে চাকরি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এদিকে, চুক্তির মেয়াদ দুই বছর পূর্ণ হওয়ায় মহিলা গৃহকর্মী বেদানা খাতুন, রিনা বেগম ও হাফসা বেগমকে দেশে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য জেদ্দাস্থ লেবার কাউন্সেল (শ্রম) এর সহায়তা কামনা করা হয়েছে।

রিক্রুটিং এজেন্সি ঐক্য পরিষদ সভাপতি এম টিপু সুলতান ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশি যে সমস্ত রিক্রুটিং এজেন্সি সউদী আরবে মহিলা কর্মী প্রেরণ করে তারা মুসানেদ এর মাধ্যমে মহিলা কর্মীদের ২ বছরের জন্য পাঠায়।’ সউদী নিয়োগকর্তাদের অনেকেই মহিলা কর্মীদের অবগত না করে তাদের অনুমতি না নিয়ে বিভিন্ন অপকৌশলে করোনার ভয় দেখিয়ে তাদের ২ বছর অতিক্রম হওয়ার পর ও দেশে ফেরত না পাঠিয়ে অতিরিক্ত সময় তাদের সউদীতে অবস্থানে বাধ্য করছে। তিনি বলেন, বিশ সহস্রাধিক মহিলা কর্মীর চাকরির মেয়াদ দুই বছর পূর্ণ হবার পরেও তাদেরকে দেশে পাঠানো হচ্ছে না।

ঐ সমস্ত মহিলাদের পরিবারগুলো কফিলদের অপকৌশল অবগত না হয়ে বাংলাদেশের এজেন্সির নামে ব্যুরো এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিকট নানা অভিযোগ দায়ের করে সংশ্লিষ্ট এজেন্সিকে হেনস্তা করছে। ২ বছর অতিক্রম করলে মহিলাদের দেশে পাঠালে আবার নতুন মহিলা নিতে সউদী নিয়োগকর্তার আবার প্রায় ২ লাখ টাকা খরচের হাত থেকে বাঁচার জন্য এই অপকৌশল অবলম্বন করছে। পরিবারের চাপে অধিকাংশ মহিলা প্রেরণকারী এজেন্সি এখন আর মহিলা প্রেরণে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। আর সউদী সরকার মহিলা কর্মী ছাড়া পুরুষ কর্মী নিতে অনাগ্রহী। এতে সউদী আরবের এই বৃহৎ শ্রম বাজারের মুখথুবড়ে পরার উপক্রম হয়েছে। অভিজ্ঞ মহিলা কর্মীর বেতন ১২০০ সউদী রিয়াল বা তদুর্ধ হওয়ায় দেশ হারাচ্ছে প্রচুর রেমিট্যান্স।

টিপু সুলতান বলেন, দেশীয় এজেন্সিগুলোকে অহেতুক হয়রানির শিকার না করে যেসব মহিলা কর্মীর মেয়াদ দুই বছর শেষ হয়েছে, তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রয়োজনী উদ্যোগ নেয়ার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীকে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নিতে হবে।



 

Show all comments
  • কি হচ্ছে ৫ জানুয়ারি, ২০২১, ১:৪৬ পিএম says : 0
    বধির সরকার আমাদের,
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সউদী আরব


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ