বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আরবের সীমানা পেরিয়ে সুদূর আবিসিনিয়া পর্যন্ত প্রাথমিক যুগেই ইসলামের আলো পৌঁছে যায়। এটি হিজরত-পরবর্তী ঘটনা, কিন্তু হিজরতের পূর্বে মে’রাজের বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেছিল, যাতে পাঞ্জেগানা নামাজ ফরজ হওয়া ছাড়াও বহু অদ্ভুত ও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছিল এবং হুজুর (সা.)-এর প্রত্যক্ষ করা বহু আজব ঘটনা তাঁরই জবানে বর্ণিত হয়েছে। মক্কার কাফের-মুশরেকদের নিষ্ঠুর নির্যাতন ও প্রতিরোধের ফলে হুজুর (সা.) মক্কায় প্রকাশ্য ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে পদে পদে কঠিন বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তার সে পয়গাম আকাশ-মহাকাশ ভেদ করে আরশে মোআল্লাকেও আলোড়িত করে তুলেছিল। এ পর্যায়ে শবে মে’রাজের রহস্যময় সিন্দুকের নেপথ্য ঘটনাটি নি¤œরূপ :
দোজাহানের শাহেনশাহ হুজুর (সা.) যখন শবে মে’রাজে প্রথম আসমানে পদার্পণ করেন তখন প্রত্যক্ষ করেন যে, উটের একটি সারি একদিক থেকে আসছিল এবং অপরদিকে চলে যাচ্ছিল। এ সারি এতই সুদীর্ঘ যে, সমগ্র আসমানকে বেষ্টন করার পরও তার শুরু ও শেষ অজানা ছিল। উট অগ্র-পশ্চাতে যাচ্ছিল, একটির লাগাম অপরটির লেজের সাথে বাঁধা। জিবরাইল (আ.) হুজুর (সা.)-এর বোরাকের লাগাম ধারণ করে আছেন। তিনি যখন উটের সারির নিকটবর্তী হন, তখন তিনি হুজুর (সা.)-এর খেদমতে আরজ করেন, হে আল্লাহর রাসূল! যেদিন থেকে খোদা আমাকে সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকে আমি দেখে আসছি যে, এসব উট অবিরাম পথ অতিক্রম করে চলেছে। আমি চলাফেরা করে দেখলাম এর সন্ধান পাওয়া যায় কি না, এসব উট কোথা থেকে যাত্রা করেছে এবং কোথায় ওদের গন্তব্য। কিন্তু আমার উড়াল শক্তি লোপ পেয়ে যায় কিন্তু এ কথা জানা যায়নি যে, এসব কোথা থেকে আসছে এবং কোথায় যাচ্ছে। প্রতিটি উট দুইটি করে সিন্ধুক বহন করে যাচ্ছে, আল্লাহ জানেন এসব সিন্ধুকে কি সামান রয়েছে।
জিবরাইল (আ.) আরো বলেন, আমি যখন উটগুলোর রহস্য অবগত হতে পারলাম না, তখন আমি আদম (আ.) থেকে ঈসা (আ.) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলের নিকট জানতে চাই, তখন তাঁরা সকলেই কানে আঙ্গুল দিয়ে বলেন, ‘আমরা এ সম্পর্কে বিলকুল কিছু জানি না।’ তখন আমি আল্লাহর দরগাহের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করি এবং উটসমূহের বিষয়টি আরজ করি। জবাব আসে, ‘মোহাম্মদ (সা.)-কে সৃষ্টি না করলে আমি কিছুই সৃষ্টি করতাম না।’ এ সমস্ত কারিশমা তার ইজাত-সত্তার সাথে সম্পৃক্ত। বলা হয়, আল্লাহ বলেন : এক রাতে আমি তাকে ঊর্ধ্ব গগনে সফর করার জন্য নিজের সান্নিধ্যে ডাকব। আমার প্রিয় হাবিব যখন প্রথম আসমানে পৌঁছবেন এবং উটের সারি তার পাশ দিয়ে অগ্রসর হবে তখন তাঁর নিকট সেই রহস্যের বিষয় জানতে চাওয়া হবে, তখন তিনি তা বলে দেবেন। জিবরাইল (আ.) বলেন, হে মোর্শিদ রাসূল (সা.) এখন সময় এসেছে, অনুগ্রহপূর্বক উটগুলোর এবং সিন্দুকসমূহের রহস্য আমাদের অবহিত করুন।’ জিবরাইল (আ.)-এর এ প্রশ্ন শুনে হুজুর (সা.) মুচকি হাসলেন এবং বললেন : ঠিক আছে, উটের সারি হতে একটি উট খুলে আমার নিকট নিয়ে আসা হোক। জিবরাইল (আ.) দ্রæত গিয়ে একটি উট সারি হতে আলাদা করে হুজুর (সা.)-এর সামনে হাজির করেন। হুজুর (সা.) বলেন : এবার তার পাশে যে সিন্ধুক রয়েছে তার তালা খোলা হোক। ঢাকনা সরানো হোক এবং সিন্ধুকের ভেতরে কি রয়েছে তা ঝুঁকে দেখা হোক তার ভেতর কি রহস্য লুকায়িত আছে। জিবরাইল (আ.) নির্দেশ পালন করলেন। তখন প্রত্যক্ষ করলেন সিন্ধুকের মধ্যে রয়েছে আরশে-কুর্সি, লৌহ-কলম, সপ্ত আসমান, সপ্ত জমিন, সাগরসমূহ, পর্বতমালা, শহর, কসবা, গ্রাম, মসজিদ, বুতখানা, খানা-ই-কাবা, মদীনা, দোজখ, বেহেশত এবং সমগ্র বিশ^। চুতর্দিক হতে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে। আরো বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, সিন্ধুকের ভেতরও শবে মে’রাজ এবং হুজুর (সা.) ও জিবরাইল (আ.)-এর ঝিলিকও অবিকল দৃশ্যমান। এ দৃশ্য দেখে জিবরাইল (আ.) মোহিত হয়ে পড়েন। হুজুর (সা.) বলেন : হে রুহুল আমীন! যথেষ্ট হয়েছে, আমাকে এখনো অনেক দূর যেতে হবে। হুজুর (সা.)-এর সতর্ক বার্তায় জিবরাইল (আ.) চমকে উঠেন এবং সিন্ধুক বন্ধ করে উটটিকে উটের কাতারে বেঁধে দিয়ে হুজুর (সা.)-এর নিকট হাজির হন। তিনি বলেন : হে জিবরাইল! দেখলেন তো আমার ক্ষমতা, আমার রাষ্ট্র এবং আমার রেসালত হতে কেউ বাইরে নয়।
আসমানি জগতের এসব বিবরণ বিভিন্ন গ্রন্থে সিন্ধুকে জমান। দুনিয়ার যেসব বিবরণ ছিল তার বর্ণনা রয়েছে এবং সবকিছু খোদা তাআলার অসীম কুদরত-কারিশমা ও হুজুর (সা.)-এর রেসালতের ঝিলিক রয়েছে। ফের তিনি জিবরাইল (আ.)-কে লক্ষ করে বলেন : হে জিবরাইল (আ.)! এ যাবত আপনি খোদার অসীম কুদরত এবং আমার রেসালতের কিছু আলো কণিকা প্রত্যক্ষ করেছেন, এবার অগ্রসর হোন। আপনি যখন সিদরাতুল মোন্তাহা অতিক্রম করবেন, তখন আপনাকে আমার রহস্যময় ‘কামালাত’-এর আরো একটি নিদর্শন দেখাব। জিবরাইল (আ.) বললেন : এবার সামনে অগ্রসর হওয়া আদবের ব্যাপার। আমি আর অগ্রসর হতে পারব না। কিন্তু হুজুর (সা.) জিবরাইল (আ.)-কে সঙ্গে রাখেন এবং মুহূর্তের মধ্যে একটি নূরানী ময়দানে পৌঁছে যান যেখানে ‘বাদে নাসীম’ (ভোরের সমীরণ) প্রবাহিত হচ্ছিল, আকাশ-বাতাসের বিক্ষিপ্ত বায়ুর ঝাপটা প্রবাহিত হচ্ছিল, ময়দানের মাঝখানে একখানা রাজকীয় খাট পাতানো ছিল, যা সকল প্রকারের কারুকার্য ফুলদ্বারা সুসজ্জিত ছিল। হুজুর (সা.) জিবরাইল (আ.)-কে বললেন : আপনি খাটের নিকট গমন করুন এবং তথায় শায়িত যে ব্যক্তির মুখ ঢাকা আছে, তা উল্টে দেখুন, তথায় কে শায়িত। জিবরাইল (আ.) অতি আগ্রহে ব্যাকুল হয়ে দৌড়ে গিয়ে খাটে শায়িত ব্যক্তির শির মোবারক দেখেন। খোদ রাসূলুল্লাহ (সা.) তাতে আরাম করছেন। জিবরাইল (আ.) তাঁর প্রতি দরূদ পাঠ করে বললেন; ‘হে আল্লাহর রাসূল! আনন্দের বিষয়, আজ সমস্ত কিছুতেই আপনাকে দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি বললেন : আজ থেকে নয়, আযল (আদি) থেকে অন্ত পর্যন্ত সর্বত্র আমার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত এবং আমি অথবা আমার উম্মত।
আল্লাহ বলেন : ওরাফানা লাকা জিকরাক, অর্থাৎ আমি আপনার স্মরণকে সমুন্নত করেছি। তিনি ছিলেন দোজাহানের শাহেনশাহ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।