Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

২৫ চক্রে সক্রিয় ২০০ সদস্য

জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি বিক্রির কারণে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

দুই হাজার টাকা দামের স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। তবে সেগুলো আসল নয়, জাল। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সারা দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে এসব জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি। এই চক্রের রয়েছে নিজস্ব এজেন্ট ও প্রেস। রাজধানীর ফকিরাপুল, আশুলিয়া, সাভার ও পুরান ঢাকাসহ ১০টি জায়গায় জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরির কারখানার সন্ধান পেয়েছে গোয়েন্দারা। সারাদেশে ২৫টি চক্রের ২০০শতাধিক সদস্য সক্রিয় রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত শাটার নামিয়ে ভেতরে ছাপা হয় জাল স্ট্যাম্প। চক্রের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হলেও এরা জামিনে রেবিয়ে এসে আবারও একই অপরাধের সাথে জড়িত পড়ে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জাল স্ট্যাম্পের তদন্ত নিয়ে কাজ করছেন এমন ডিবির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক অসাধু আইনজীবী, ভেন্ডার ও দলিল লেখকও জড়িত এই চক্রের সঙ্গে। এদের অনেকে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে গেলেও জামিনে বের হয়ে একই কাজ করছে।

সূত্র জানায়, ১৮ কোটি টাকা মূল্যের জাল স্ট্যাম্প, ডাক টিকিট, কোর্ট ফি জালিয়াত চক্রের সঙ্গে একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যোগসাজশ পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ১৯ নভেম্বর এমন একটি চক্রকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) রমনা বিভাগ। চক্রটি জাল স্ট্যাম্প, ডাক টিকিট, কোর্ট ফি তৈরি করতো। রাজধানীর পল্টন ও আশুলিয়া থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সময় ১৮ কোটি টাকা মূল্যের জাল স্ট্যাম্প, ডাক টিকিট, কোর্ট ফি উদ্ধারের পাশাপাশি জাল স্ট্যাম্প প্রস্তুতের জন্য ব্যবহৃত একটি কম্পিউটার, একটি প্রিন্টার, দুটি বড় ইলেকট্রিক সেলাই মেশিন ও একটি ভারী সেলাই মেশিন উদ্ধার করা হয়। এছাড়া গত ২৭ আগস্ট রাতে রাজধানীতে অভিযান চালিয়ে জাল স্ট্যাম্প, ডলার, কোর্ট ফি তৈরি ও বিক্রির একটি চক্রের হোতা দেওয়ান মাসুদ রানা (৩৭) ও খুচরা বিক্রেতা আলফাজ উদ্দিনকে (৬০) গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা থানা। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর ফকিরাপুল শুক্কুর পাগলার গলির জেবি প্রিন্টার্সে অভিযান চালিয়ে জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ছাপানোর সরঞ্জামসহ প্রেসের কর্মী হাবিবুর রহমান (৫৫), মো. অভি (২০) ও রোজিনা আক্তারকে (৫০) গ্রেফতার করে পুলিশ। উদ্ধার করা হয় বিপুল পরিমাণ জাল স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি এবং এসব তৈরির সরঞ্জাম।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, আলফাজ উদ্দিন গত ২৭ বছর ধরে ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনে হিসাবরক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তাকে গ্রেফতারের পরই মাসুদের তথ্য পাওয়া যায়। জিজ্ঞাসাবাদে আলফাজ জানান, তিনি গত ৬ থেকে ৭ মাস ধরে জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি বিক্রি করে আসছিলেন। একসময় আসলগুলো বিক্রি করলেও মাসুদের প্ররোচনায় পরে জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি বিক্রি শুরু করেন। অনেক আইনজীবী জেনেবুঝেই কম দামে তার কাছ থেকে এসব কিনত। ফকিরাপুলের ওই প্রেস থেকে দীর্ঘদিন ধরেই ছাপা হচ্ছিল জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) এ কে এম হাফিজ আক্তার গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি জালিয়াত চক্রগুলো অত্যন্ত ধূর্ত। এরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি তৈরি করে সাধারন মানুষদের প্রতারিত করছে। একই সাথে সরকার বিপুল পরিমান রাজস্ব হারাচ্ছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি জালিয়াত চক্রের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যহত রয়েছে। তবে স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি আধুনিক সিস্টেমের মাধ্যমে এর প্রতিরোধ করতে হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, এ চক্রের হোতা মাসুদ রাজধানীর যাত্রাবাড়ী বিবির বাগিচা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে গড়ে তোলেন জাল স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি, ডলার ও টাকা তৈরির কারখানা। তার বাসায় এগুলো ছাপানোর প্লেট ও ফিল্ম পাওয়া গেছে। ছাপানোর কাজে সেন্টু নামে এক ব্যক্তির সহায়তা নিতেন মাসুদ। সেন্টু বিভিন্ন ছাপাখানা থেকে এগুলো ছাপিয়ে দিত। কম দামের স্ট্যাম্প বেশি ছাপাত চক্রটি। ২০০ পিসের এক পাতা জাল স্ট্যাম্প ছাপাতে মাসুদের খরচ হতো ৮ থেকে ১০ টাকা। এগুলো খুচরা বিক্রেতার কাছে প্রতি পাতা বিক্রি করত ৬০ থেকে ৬৫টাকায়। এ চক্রের অন্তত ৭ থেকে ৮ সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছে। এদের মাধ্যমেই মাসুদ সারাদেশে ছড়িয়ে দিত জাল স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি। চক্রের প্রধান মাসুদ রানা নিজেই কম্পিউটারে স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফির নকশা তৈরি করে পাশাপাশি বসিয়ে ছাপার উপযোগী আকারে েেমকআপ দিত। এরপর তা পাঠাত জেবি প্রিন্টার্স বা অন্য কোনো ছাপাখানায়। এজেন্ট বা বিক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যক স্ট্যাম্প ও কোর্ট ফি ছাপানো হতো। এরপর তা মজুদ করা হয় রাজধানীর উত্তর যাত্রাবাড়ীর বিবির বাগিচার ১ নম্বর গেট এলাকার একটি বাসায়। মাসুদ নিজেও সেখানে থাকত। এর আগে একাধিকবার জালিয়াতি করে ধরা পড়লেও সে জামিনে বেরিয়ে পুরোনো কাজে জড়িয়ে পড়ে। ২০১৬ সালে ধরা পড়ার পর তার বিরুদ্ধে মিরপুর ও আশুলিয়া থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা হয়। সর্বশেষ রমনা থানায় তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে।

এ সংক্রান্ত একটি মামলার একজন তদন্ত কর্মকর্তা জানান, খুব অল্প দামে কিনে অনেক বেশি লাভে বিক্রি করা যায় বলেই মূলত জালিয়াতির কারবারে জড়ায় অনেকে। দুই হাজার টাকা দামের কোর্ট ফি বা স্ট্যাম্প পাইকারি বিক্রি হয় মাত্র ২০০ টাকায়। প্রেসে ব্যবহূত একটি প্লেটে ৫০ হাজার স্ট্যাম্প ছাপা যায়। ছাপা একটি পাতায় সাধারণত ২০০ স্ট্যাম্প থাকে। এক পাতায় কোর্ট ফি ছাপা যায় ৪০টি। এ রকম একটি পাতা ছাপতে খরচ হয় মাত্র ৩০ টাকা। ফলে গায়ের দামের েেয় কমে বিক্রি করেও চক্রের সদস্যরা অনেক টাকা হাতিয়ে নিতে পেরেছে। ঢাকার বিভিন্ন স্থান ছাড়াও গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ে অবস্থানরত এই এজেন্টদের শনাক্ত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

নাম প্রকাশের না করার শর্তে একজন প্রেস মালিক জানান, যথাযথ নজরদারির অভাবে কোনো কোনো প্রেস এসব ছাপার সুযোগ পায়। বিশেষ করে রাতে নির্দিষ্ট সময়ের পর সব প্রেস বন্ধ হয়ে যায়। তখনও জরুরি কাজের অজুহাতে কেউ কেউ থেকে যায়। অনেকেরই ধারণা, রাতে লোকজন কম থাকার সুযোগে অসাধু প্রেস মালিকরা অবৈধ জিনিসপত্র ছাপে। অবৈধ মুদ্রণ রোধে ছাপাখানাগুলোয় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ