Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

এক ধাপ পেরুলেই গ্রেটেস্ট বোল্ট

প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শামীম চৌধুরী : সেই পরিচিত স্টাইল, পরিচিত বৈশিষ্ট্য। তার ইভেন্ট দেখতে দর্শকে ভরে যাবে স্টেডিয়াম, রিও অলিম্পিকে দর্শকখরায়ও ব্যতিক্রম উসাইন বোল্টের ইভেন্ট! তার নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠবে সবাই, দর্শক তুলবে রিদম, স্টার্টিং পয়েন্টে নিজের মার্কে অবস্থান নেয়া থেকেই চোখ নিবিষ্ট থাকবে তার লেনের দিকেÑ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিক থেকে এমন দৃশ্যের সঙ্গে পরিচিত হয়ে গেছে বিশ্ব! বিশ্বের সেরা স্পোর্টস শোম্যানশিপে অনন্য হয়ে ওঠা জ্যামাইকান গতিদানবের অলিম্পিকে শেষ ব্যক্তিগত ইভেন্টেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বরং চেনা উৎসবে দিয়েছেন নতুনত্ব, সমর্থকদের কাছে ছুটে যেয়ে তাদের আবদার রক্ষা করতে দিয়েছেন সেলফি তোলার সুযোগ, নিজেও তাদের মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে তুলে দিয়েছেন সেলফি।
সেমিফাইনাল থেকে মার্কিন অ্যাথলিট জাস্টিন গ্যাটলিন এবং জ্যামইকান ইয়োহান ব্লেক বাদ  বাদ পড়ায় ২০০ মিটার স্প্রিন্টে একতরফা ফাইনালের যে আবহ ছিল, সেটাই প্রতীয়মান হয়েছে। ২০ সেকেন্ডের নিচে ২০০ মিটার পাড়ি দেয়ার ক্ষমতাটা ২০০৯ বার্লিনে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে দেখিয়ে জন্ম দিয়েছেন বিশ্বরেকর্ড, সেই থেকে এই ইভেন্টে ফেভারিট উসাইন বোল্ট রিওতেও সময় নিয়েছেন ২০ সেকেন্ডের কম। এমনিতে বৃষ্টিতে ভিজে ট্র্যাকটা হয়ে উঠেছে ভারী, তার উপর বইছে বাতাস। ৬ নম্বর লেন থেকে টার্নিং নিয়ে বাঁ পাশের দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে টপকে যাওয়া সহজ নয়, সেই কাজটিই সহজ করে দেখিয়েছেন উসাইন বোল্ট রিও অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। সেমিফাইনালে কানাডার ডি গ্রেস ১৯.৭৮ টাইমিংয়ে ২০০ মিটার পার করে ফাইনালে উসাইন বোল্টকে দিয়েছিলেন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ফাইনালে বোল্টের কাছে পাত্তাই যে পেলেন না এই কানাডিয়ান! রৌপ্য জিততে ২০.০২ সেকেন্ডে শেষ করলেন ইভেন্টটি! ১৯.১৯ সেকেন্ডে বিশ্বরেকর্ড, ১৯.৩০ সেকেন্ডে অলিম্পিক রেকর্ডটি তার দখলে, অলিম্পিক ক্যারিয়ারে শেষ ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণজয়ে সেখানে টাইমিং ১৯.৭৮! তাই অলিম্পিকের শেষ ব্যক্তিগত ইভেন্টে স্বর্ণজয়ে পুরোপুরি তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারেননি উসাইন বোল্টÑ‘এই টাইমিং নিয়ে আমি সন্তুষ্ট হতে পারছি না। বিশ্বরেকর্ড করার পরও আরো দ্রুত দৌড়ানোর চেষ্টা থাকার কথা। কিন্তু আমার পা কাজ করছিল না। দৌড়ের শেষ অংশে আমি ফর্ম হারিয়েছি। তবে স্বর্ণ পদক জিততে পেরেছি, এটাই বড় ব্যাপার।’   
৩০-এ পা দেননি এখনো, দেয়ার আছে তাই আরো কিছু। তাকে ঘিরে অলিম্পিকে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডের সেরা তিনটি ইভেন্টে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা জ্যামাইকানদের দাবি ২০২০ টোকিও অলিম্পিকেও পা পড়–ক বোল্টের। তবে গতকাল ২০০ মিটার জিতে ৬ নম্বর লেনে ট্র্যাকে চুমো খেয়ে আগেভাগেই বিদায়ের ঘোষণা দিয়েছেনÑ‘আমার কোচ আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, তবে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি এটাই আমার শেষ। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে প্রথম রাউন্ডের বাধাই পেরুতে পারিনি। তারপরও আমি ২০০ মিটারে দৌড়ানোর পণ করেছি, এবং আরো একবার ইভেন্টটি থেকে জিতলাম ম্বর্ন। অলিম্পিকে এটাই আমার শেষ ব্যক্তিগত ইভেন্ট। রিলেতে কেউ বলতে পারে না কী ঘটবে, তাই আজই গুডবাই জানাচ্ছি।’
কি চ্যালেঞ্জটাই না ছুঁড়ে দিয়েছিলেন গ্যাটলিন? রিও অলিম্পিক স্টেডিয়ামে উসাইন বোল্টের সঙ্গে পাল্লা দিতে এসে পেয়েছেন দর্শকের দুয়োধ্বনি, সেখানে ৮৬ হাজার দর্শকের সমস্বরে ‘বোল্ট, বোল্ট’ চিৎকার! ৯.৮১ সেকেন্ডে ১০০ মিটার পাড়ি দিয়ে অলিম্পিকে গতিমানবের স্বর্ণজয়ের হ্যাটট্রিক। অলিম্পিকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট ১০০ মিটার স্প্রিন্টে টানা তিনবার স্বর্ন জয়ে নুতন ইতিহাস রচনার পর বাকি ছিল ২০০ মিটার স্প্রিন্টেও একই অধ্যায় রচনার। সেই ইতিহাসও রচিত হলো এই জ্যামাইকানের পারফরমেন্সে!
২০০৮ এবং  ২০১২ লন্ডন অলিম্পিকে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের সেরা তিনটি ইভেন্ট থেকে উসাইন বোল্টের ৬টি স্বর্ন জয়ে সারা বিশ্ব যখন বোল্ট বন্দনায়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের কিংবদন্তি অ্যাথলিট কার্ল লুইসের মুখ থেকে প্রশংসার বদলে ছিল সমালোচনা। ৪টি অলিম্পিক (১৯৮৪ লস এঞ্জেলস, ১৯৮৮ সিউল, ১৯৯২ বার্সেলোনা এবং ১৯৯৬ আটলান্টা) থেকে ৯টি স্বর্ণজয়ের রেকর্ডের পাশে এক জ্যামাইকান কেন বসাবে ভাগ? এটাই মানতে পারেননি কার্ল লুইস। মার্কিন গ্রেট অ্যাথলিটের ওই মন্তব্যই তাতিয়ে দিয়েছে উসাইন বোল্টকে। লং জাম্পে কখনোই নেননি অংশ বোল্ট, সেই ইভেন্টে ৪টি অলিম্পিক থেকে ৪টি স্বর্ন। কিন্তু অন্য কোন ইভেন্টে তো অলিম্পিকে ২টির বেশি স্বর্ণ নেই লুইসের। লুইসকে জবাব দিতে তাই ব্যক্তিগত ইভেন্ট, ১০০ এবং ২০০ মিটার স্প্রিন্টে হ্যাটট্রিক বোল্টের। বাকি মাত্র একটি দৌড়, আজ সকালে ৪*১০০ মিটার রীলেতে স্বর্ন জিতলে এই ইভেন্ট থেকেও অলিম্পিকে হ্যাটট্রিকটা হয়ে যাবে বোল্টের। তিনটি ইভেন্টের সব ক’টিতে হ্যাটট্রিক হয়ে গেলে ৯টি স্বর্ণজয়ে অলিম্পিকের  ট্র্যাক এন্ড ফিল্ড থেকে কার্ল লুইসের রেকর্ড ৯টি স্বর্ণজয়ে বসাবেন ভাগ! ১৯৮৮ সিউল অলিম্পিকে কার্ল লুইস স্বর্ণ হারিয়েছেন ২০০ মিটার স্প্রিন্টেÑঘোষনা দেয়া অলিম্পিকের শেষ ইভেন্টে স্বর্ণ জিতলে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়েই যে থাকবেন উসাইন বোল্ট।
অ্যাথলেটিক্সে গতি দানব হয়েও গ্রেটেস্ট হতে বাকি আছে এক ধাপ। খেলাধুলায় বক্সিং কিংবদন্তি মোহাম্মদ আলীর তিন বারের হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গর্ব কিংবা ফুটবল জাদুকর পেলের তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নের গর্বে এই দু’জন গ্রেটেস্ট হিসেবে উচ্চারিত হচ্ছেন বছরের পর বছর। তাদের কাতারে উঠে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে অলিম্পিককে বিদায় জানাতে প্রস্তুত বোল্টÑ‘প্রমাণ করেছি বিশ্বে আমিই সেরা। তা প্রমাণ করতেই এখানে আমার আসা। তাই বলছি, এটাই আমার শেষ অলিম্পিক। কারন আর কিছু প্রমানের বাকি নেই আমার।  অলিম্পিকে ৮টি স্বর্ণ অনেক বড় অর্জন। আমি আমার সেরাটা দিতেই চেষ্টা করেছি। এমন কিছু বাকি নেই, যা আমি পারিনি। গ্রেটেস্ট প্রমানে আর কি বাকি আছে? আমি এখন গ্রেটেস্ট মোহাম্মদ আলী এবং পেলের মতো  একজন হওয়ার চেষ্টা করছি। এই গেমসের পর ব্রাকেটে আমার নাম উঠবে, সে প্রত্যাশাই করছি। আগামীকাল (আজ) সেটাই লেখা হবে, সে অপেক্ষায়ই আছি। আমি আমার পুরো ক্যারিয়ারে এমন একটি ক্ষণের অপেক্ষায় কাজ করেছি। খেলাধুলায় অন্যতম সেরা ব্যক্তি হিসেবে আমার নামটি পড়বে বলে আশা করছি।’
অলিম্পিকের সমাপনী দিনে (২১ আগস্ট) ৩০ তম জন্মদিন পালিত হবে তার গেমস ভিলেজে। আজ ৪*১০০ মিটার রিলে জিতে অলিম্পিক ক্যারিয়ারটা শেষ করতে পারলে জন্মদিন উদযাপনে সেরা উপলক্ষ পাবেন উসাইন বোল্ট।
অলিম্পিকের ৪ আসরে ২৩টি স্বর্ন জয়েও যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতার কিংবদন্তি মাইকেল ফেল্পসকে উসাইন বোল্টের সঙ্গে তুলনায় এনেছে বিশ্ব। তবে ফেল্পসের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সম কাতারেই নিজেকে রাখছেন বোল্টÑ‘সুইমিং এবং ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড দুটি পৃথক ইভেন্ট, এমন পার্থক্য করব না আমি। সন্দেহাতীতভাবে সে (ফেল্পস) বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রমাণ করেছে। খেলায় কর্তৃত্ব করে অনেক অনেক পদক জিতেছে। আমরা দু’জনই স্ব স্ব ক্ষেত্রে সেরা।’ পার্থক্য একটাই, শোম্যান শিপ। স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে অ্যাথলেটিক্সে অন্য এক মাত্র দিয়েছেন, টেনেছেন দর্শক, এখানেই অন্য একটি ধারা তৈরি করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছেন বোল্টÑ‘প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে, কঠোর পরিশ্রম করে অনেক কিছু অর্জন করা যায়, তা প্রমাণ করেছি। খেলাটিকে আমি দিয়েছি উত্তেজনা, খেলা দেখতে এসেছে দর্শক।  খেলাটিকে ভিন্ন পর্যায়ে নিয়ে আসতে পেরেছি, ভিন্ন একটা ধারা তৈরি করেছি।’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: এক ধাপ পেরুলেই গ্রেটেস্ট বোল্ট
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ