পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
‘এই নিয়েছে ঐ নিলো যাঃ! কান নিয়েছে চিলে/চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে/কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে/আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে’ (শামসুর রাহমান)। ‘পন্ডশ্রম’ নামের এই কবিতায় বাঙালির গুজবে কান দেয়ার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই কবিতার মতোই লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রামের বুড়িমারীতে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়িয়ে শহীদুন্নবী জুয়েল হত্যা করে চেলাকাঠ-পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। তবে কবিতার চিলের পিছে কানের খোঁজে ছোটার সঙ্গে শহীদুন্নবী জুয়েল হত্যা ঘটনার তুলনা চলে না। চিলের পিঠে ছোটা বোকামি। কিন্তু জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যার পর পুড়িয়ে মারা ভয়ঙ্কর অপরাধ। এই ঘটনাকে লোমহর্ষক, পৈশাচিক, মর্মান্তিক, নিষ্ঠুরতা, বেদনাদায়ক, হৃদয়বিদারক শব্দগুলো উদাহরণ হিসেবে জুতসই। লালমনিরহাটের বুড়িমারীর ঘটনা সারা দেশের মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে তোলপাড় ও প্রতিবাদের পাশাপাশি ধিক্কার দেয়া হচ্ছে। এর আগে দেশে কখনোই মসজিদে কোরআন অবমাননা করার গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটেনি। ফলে সাধারণ মানুষ তো বটে; আলেম সমাজও প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করে প্রকৃত দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
বিজ্ঞানের বদৌলতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার শক্তিশালী গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে। এসব মাধ্যমে তথ্যের অবাধ আদান প্রদান হচ্ছে। এই সামাজিক মাধ্যমকে ব্যবহার করে অপরাধের ঘটনাও কম ঘটছে না। ২০১৯ সালের ২১ জুলাই ছেলে ধরা গুজব ছড়িয়ে রাজধানীর বাড্ডায় তাসলিমা বেগম রানু নামের এক নারীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে গুজব ছড়িয়ে নেত্রকোনায় একবাচ্চার মাথা কেটে ফেলার লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কক্সবাজারের বৌদ্ধ মন্দিরসহ অনেকগুলো হামলার ঘটনা ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর কারণে। প্রতিটি গুজব ছড়ানোর পর মানুষ সত্যমিথ্যা যাচাই না করেই হুজুগে রাস্তায় নেমে তান্ডব চালিয়েছে। এই গুজবকে কেন্দ্র করে কিছু সুযোগসন্ধানী মানুষ ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ড চালিয়েছে। বিভিন্ন সময় গুজব ছড়িয়ে নানা ধরণের অপকর্ম এবং সরকারকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। তবে আল্লাহর ঘর মসজিদের পবিত্র কোরআন অবমাননার গুজব ছড়ানোর ঘটনা অতীতে ঘটেনি।
বাংলাদেশের মানুষের সাম্প্রদায়িক সম্পৃতি পৃথিবীতে উদাহরণ। মুসলিম-হিন্দু-খ্রিষ্টান-বৌদ্ধসহ সব ধর্মের মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করেন। সাধারণ মানুষ ধর্মভীরু তবে ধর্মান্ধ নয়। সাধারণ আলেম-ওলামা, ইসলামী চিন্তাবিদ তথা ইসলামী স্কলাররা কখনোই উগ্রতাকে প্রশ্রয় দেননি। ইসলাম অবমাননা, বর্ণবাদ, যুদ্ধ-বিগ্রহসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন তোলপাড় আন্দোলন হয়েছে; তখন আমাদের আলেম সমাজ শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেই মিছিল-প্রতিবাদ করেছে। তারা কোরআন ও হাসিদের আলোকে জীবন যাপনের কথা প্রচার করলেও কখনোই উগ্রতা পছন্দ করেন না। যার কারণে পশ্চিমারা যুগের পর যুগ ধরে বাংলাদেশের ওপর জঙ্গীবাদের তকমা দেয়ার চেষ্টা করেও সফল হয়নি।
কিছু সংগঠন ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যা করেছে; বোমা মেরেছে, আন্তর্জাতিকভাবে দেশকে জঙ্গীবাদের স্বার্গভূমি হিসেবে চিত্রায়ণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু দেশের আলেম-ওলামা এবং সাধারণ তৌহিদী জনতা উগ্রবাদীদের প্রশ্রয় দেয়নি। আলেম সমাজ প্রথম জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদ করেছে। ইসলামী সভা-সমাবেশ ও জলসায় জঙ্গীবাদকে ইসলাম সমর্থন করে না প্রচার করেছেন। কার্যত সে কারণেই দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জঙ্গীবাদ দমনে নিরবচ্ছিন্ন অভিযান চালিয়ে সফল হয়েছেন।
আর লালমনিরহাট তো সারাবিশ্বের কাছে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির উদাহরণ। একশ বছর ধরে লালমনিরহাট শহরের কালীবাড়ি পুরান বাজার জামে মসজিদ ও কালীবাড়ী কেন্দ্রীয় মন্দির একই উঠানে। ভারতে বাবরী মসজিদ ভেঙে যখন মন্দির নির্মাণ করা হয়; তখন লালমনিরহাটে একই আঙিনায় মসজিদ ও মন্দির। সময়মতো মসজিদে নামাজ হচ্ছে এবং নিয়মমাফিক চলছে পূজার আয়োজন। বিরল এই সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির নজির যে লালমনিরহাটে সেখানে মসজিদে কোরআন পোড়ানোর গুজব ছড়িয়ে মানুষ হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলার পৈচাসিক ঘটনা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।
আগেই বলেছি বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু; কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। ইসলামের বিরুদ্ধে বিশ্বের কোথাও কিছু ঘটলে তারই প্রতিবাদে মসজিদে নামাজ শেষে বের হয়ে মুসুল্লিরা মিছিল করেন; বিচারের দাবি জানান। এটা সারাবিশ্বেই হয়ে থাকে। কিন্তু মসজিদ থেকে হুজুগ এবং গুজব সৃষ্টির ঘটনা কখনো ঘটেনি। লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারীতে গণপিটুনিতে শহীদুন্নবী জুয়েলের নিহত এবং লাশ পুড়িয়ে ফেলার ঘটনার প্রকৃত রহস্য খুঁজে বের করা উচিত। তবে আশার কথা হলো ঘটনার পর সরকার সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পর স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যাক্তি ও আলেম সমাজ, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের নিয়ে পাটগ্রাম উপজেলা পরিষদে বৈঠক করেছেন। ওই বৈঠকে প্রশাসন স্পর্শকাতর বিষয়টি সুরাহার লক্ষ্যে সবার সহায়তা চেয়েছেন। আলেম সমাজও ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীর বিচারের দাবি জানিয়েছেন।
ইতোমধ্যেই প্রশাসন থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় মানবধিকার কমিশন এতোদিন ঘুমিয়ে থাকলেও লালমনিরহাটের ঘটনা তদন্ত করে দাবি করেছে ‘জুয়েল কোরআন অবমাননা করেনি। তার বিরুদ্ধে কোরআন অবমাননার গুজব ছড়ানো হয়েছে।’ মিডিয়াগুলোতে খবর বের হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করে জানিয়েছে ‘নিহত যুবক শহিদুন্নবী জুয়েল রংপুর শহরের শালবন মিস্ত্রীপাড়া এলাকার আব্দুল ওয়াজেদ মিয়ার ছেলে। তিনি রংপুর ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র। চাকরিচ্যুত হওয়ায় তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন। জুয়েল কোরআন অবমাননা করেননি’।
লোমহর্ষক হত্যাকান্ড নিয়ে নিহতের পরিবার, বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদ ও পুলিশ বাদী হয়ে তিনটি মামলা দায়ের করেছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যেই পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। ঘটনা এখনো তদন্তাধীন। আমাদের প্রত্যাশা প্রকৃত ঘটনা বের হয়ে আসুক। পরিকল্পিতভাবে এই পৈশাচিক ঘটনা ঘটেছে; নাকি হঠাৎ ঘটেছে তা পরিস্কার হওয়া উচিত। নেপথ্যে থেকে কেউ জনতাকে উষ্কে দিয়েছে কি-না সেটাও দেখা উচিত। একই সঙ্গে রংপুর শহরের জুয়েল কেন বুড়িমারীতে এলো? তাকে মারধরের সময় সঙ্গী তাকে রক্ষার চেষ্টা করেছে কি-না? বুড়িমারী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন আফিজ উদ্দিন হঠাৎ কেন ক্ষিপ্ত হলেন? আবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তি হঠাৎ করে কেন তাকে মারধর করল? নিহত জুয়েল কোরআন অবমাননা করেছে কি-না? ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হাফিজুল কেন জুয়েলকে দীর্ঘক্ষণ পরিষদে আটকিয়ে রাখলেন? দেরিতে কেন পুলিশকে খবর দেয়া হলো? বহিরাগত বিক্ষুব্ধ জনতা কার ডাকে এলেন? গুজব ছড়িয়ে হত্যাকান্ডের নেপথ্যে কারও ইন্ধন আছে কি না এসব বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। সৌহার্দ্য সম্পৃতির এই দেশে মসজিদ থেকে কোরআন পোড়ানোর গুজব ছড়ানোর রহস্য উদ্ঘাটন হওয়া প্রয়োজন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।