Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

বহুল আলোচিত মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যাকান্ড নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। গতকাল সোমবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে প্রতিবেদন জমা দেন কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) ও সরকারের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় তার সঙ্গে ছিলেন কমিটির সদস্য সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রতিনিধি সেনাবাহিনীর লে. কর্নেল এস এম সাজ্জাদ হোসেন। ৮০ পৃষ্টার মূল প্রতিবেদনের সঙ্গে ৫৮৬ পৃষ্টার সংযুক্তিও জমা দেয়া হয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে প্রতিবেদনের ১৩টি সুপারিশ করেছে এ কমিটি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটির অপর দুই সদস্য হলেন- কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শাহজাহান আলী ও পুলিশ বাহিনীর প্রতিনিধি অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেন খান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের সম্মেলন কক্ষে তদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে বলেন, পুলিশের গুলিতে মেজর (অব.) সিনহার নিহতের ঘটনা তদন্তে যে কমিটি করা হয়েছে, সে কমিটি আমাদের কাছে রিপোর্ট দিয়েছে। তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশ করেছেন। সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে।
তিনি বলেন, রিপোর্টের ভেতরে কী আছে আমরা এখনও দেখিনি। এখন আমাদের সচিব এটা বিশ্লেষন করে দেখবেন। আপনারা জানেন আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী একটি তদন্ত চলছে। সেজন্য আমরা প্রকাশ্যে কিছু জানাতে পারবো না। আমরা আদালতকে জানিয়ে দেবো এ বিষয়ে। আদালত মনে করলে আমাদের কাছ থেকে অফিসিয়ালটি নিয়ে যাবেন। এটা আদালতের এখতিয়ার ।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা কমিটিকে কিছু গাইডলাইন দিয়েছি। হত্যার কারণ উদঘাটন করে এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, তার জন্য সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে। কমিটির সুপারিশ আমরা বাস্তবায়ন করব। সিনহা হত্যাকান্ড একটি দুঃখজনক ঘটনা। আমরা চাই, এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে। সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে চমৎকার পরিবেশ ও সম্পর্ক রয়েছে। ঘটনার পর দুই বাহিনীর প্রধান একসঙ্গে সংবাদ সম্মেলন করে তাদের বক্তব্য দিয়েছেন।
পুলিশের ভূমিকাকে ম্লান করবে নাঃ সিনহা হত্যাকান্ডের ঘটনা পুলিশের ভূমকিাকে ম্লান করবে না বলে মন্তব্য করেছেন এ-সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তরের পর তিনি এ মন্তব্য করেন। তদন্ত কমিটি প্রধান আরো বলেন, আমরা চারজন কমিটির সদস্য এক মাসের বেশি সময় ধরে আমরা যে কাজটি করেছি, যে রিপোর্টটি প্রনয়ন করেছি, সেটি হস্তান্তর করতে পেরেছি। আমাদের প্রথমে ৭কর্মদিবস সময় দেয়া হয়েছিল। ১আগস্ট আদেশটি হয় সেদিন ছিল ঈদের দিন। আমি আমার মাকে দেখার জন্য গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। কমিশনার স্যার আমাকে বললেন, তোমাকে অর্ডার দেয়া হয়েছে। আমি ২ তারিখ হোয়াটস অ্যাপে (কমিটি গঠনের অর্ডার) পাই। ৩ তারিখ (আগস্ট) আমরা নমিনেশনের জন্য চিঠি লিখি, ৩ তারিখরই সশস্ত্র বহিনী বিভাগ ও পুলিশ থেকে আমাদের দুজন সহকর্মীর নাম আমাদের দেয়া হয়। আমরা ৪ তারিখে (আগস্ট) কক্সবাজারে গিয়ে প্রথম সভা করি।
অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মিজানুর রহমান বলেন, আমরা একটা কর্মপরিকল্পনা করি, আমি সংযুক্তিতে দিয়েছি-আমরা ৩ তারিখ থেকে আজ পর্যন্ত কী কী করেছি। আমরা বিস্তারিত ক্যালেন্ডারের মতো করেছিলাম, সেটি সংযুক্তিতে আছে। আমি একটি কথা বলব, আমাদের পুলিশ বাহিনী যে আইনশৃঙ্খলার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে, এই ঘটনাটি (সিনহা হত্যা) কোনোভাবেই তাদের ভূমিকাকে ম্লান করবে না। আমরা দেখেছি তারা পরিশ্রম করে।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা চেয়েছি আমাদের মন্ত্রণালয় যেটি নির্দেশনা দিয়েছে, এটির উৎস কী, কারণ কী, এই ধরনের ঘটনার প্রতিকারের ব্যাপারে কী ধরনের সুপারিশ করা যায়, সেই ব্যাপারে আমরা চারজন পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছি।
এসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে উদ্দেশ করে কমিটির প্রধান বলেন, আমরা স্যার আপনার সদয় অবগতির জন্য বলব, কর্মপরিকল্পনায় আমরা নির্ধারণ করেছি কারা কারা এই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এ রকম একটা সম্ভাব্য তালিকা করেছি। এটি ইনক্রিমেন্টাল ছিল, শেষ পর্যন্ত ৬৮ জনে এটি দাঁড়িয়েছে। এই ৬৮ জনকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেছি। এছাড়া আমরা ঘটনাস্থলগুলোতে রাত ৯টার দিকেও গিয়েছি। সাংবাদিক বন্ধুরা আমাদের সবসময় পাহারা দিয়েছেন, কিন্তু ওনারা আমাদের ধরতে পারেননি।
তিনি বলেন, আমরা রাতে এপিবিএনের (আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন) ফোর্স নিয়ে ডেমো করেছি, বোঝার চেষ্টা করেছি। যে পাহাড়ে মেজর (অব.) সিনহা গিয়েছেন সেই পাহাড়ে গিয়েছি। ওখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে উৎস, কারণ ও আমাদের সুপারিশ প্রণয়ন করেছি। কতটি সুপারিশ করেছেন, প্রতিবেদন কত পৃষ্ঠার- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান বলেন, আমি তো হস্তান্তর করে দিয়েছি, এখন স্যারদের ব্যাপার। আমার তরফ থেকে আর কোনো বক্তব্য নেই। উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই রাত ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন সিনহা। এ ঘটনা প্রকাশের পর দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠলে ঘটনার উৎস, কারণ ও ভবিষ্যতে এমন ঘটনা যেন না ঘটে সেই বিষয়ে সুপারিশ দিতে ২আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় একটি ৪ সদস্যের কমিটি গঠন করে। সাত কর্মদিবস অর্থাৎ ১০ আগস্টের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় বেঁধে দেয় মন্ত্রণালয়। এরপর প্রথমবার কমিটির সময় বাড়ানো হয় ২৩আগস্ট পর্যন্ত। পরে কমিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সময় ফের ৩১আগস্ট পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এ সময়ের মধ্যে ঘটনার অন্যতম অভিযুক্ত টেকনাফ থানার বহিষ্কৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বক্তব্য গ্রহণ করতে না পারায় কমিটির মেয়াদ সর্বশেষ ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ২ সেপ্টেম্বর কমিটি কক্সবাজার জেলা কারাগার ফটকে প্রদীপ কুমার দাশের বক্তব্য গ্রহণ করে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ডাকাত আসার তথ্য সঠিকভাবে ভেরিফাই (যাচাই) না করেই অভিযান শুরু করা হয়। অভিযান শুরুর আগে অতিরিক্ত ফোর্স নেয়া হয়নি। পর্যাপ্ত প্রস্তুতি না নিয়ে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের না জানিয়ে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত শুধু কৃতিত্ব পাওয়ার আশায় গুলিবর্ষণের মতো হটকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কিনা সেটা ফৌজদারি তদন্তে বের করে আনতে হবে। নিছক আত্মরক্ষার্থে গুলি করেছিলেন কিনা বা অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল কিনা তাও ফৌজদারি তদন্ত করে বের করতে হবে। মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থেকে নামার সময় অস্ত্র নিয়ে নেমেছিলেন নাকি পুলিশ সদস্যরা তার হাতে অস্ত্র দিয়েছিলেন সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা হয়নি প্রতিবেদনে।
সূত্র আরো জানায়, প্রতিবেদনে বলা হয়, এ বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থাকায় তা ফৌজদারি তদন্তে বের করতে হবে। পাহাড়ে ডাকাত উঠেছে বলে গ্রামের লোকদের মাইকিং এবং পুলিশকে ডাকাতের তথ্য দেয়ার বিষয়ে বলা হচ্ছে- এলাকাবাসী কি ভুলক্রমে পুলিশকে খবর দিয়েছিলেন নাকি এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল তা ফৌজদারি তদন্ত ছাড়া বের করা সম্ভব নয়। সিনহার গাড়ি থেকে উদ্ধার করা ইয়াবা ও গাঁজা পুলিশ পরিকল্পিতভাবে দিয়েছিল। এ বিষয়ে সিনহার সহযোগী সিফাতের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, এত গাঁজা গাড়িতে থাকার কথা নয়। ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার ও একাধিক সাক্ষীর বরাত দিয়ে বলা হচ্ছে- ঘটনার পর সিনহার গলায় পা দিয়ে চাপ দেয়া হয়েছে। এতে গলায় দাগ পড়ে গেছে। তবে সিনহার গলায় কে পা দিয়ে চাপ দিয়েছে তা নিশ্চিত করতে পারেনি তদন্ত কমিটি। ঘটনার পর সিনহাকে কেন দেরি করে হাসপাতালে পাঠানো হল? এটা ইচ্ছাকৃত কিনা তা ফৌজদারি তদন্তে বের করতে হবে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ