Inqilab Logo

রোববার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

স্বাস্থ্য সেবা অধিদফতরে বিতর্কিত কর্মকর্তার এডিজি হিসাবে যোগদান

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২০ আগস্ট, ২০২০, ৮:০৪ পিএম

স্বাস্থ্য অধিদফতরে অতিরিক্ত মহাপরিচাক (এডিজি) হিসাবে বৃহষ্পতিবার (২০ আগস্ট) যোগাদান করেছেন বিতর্কিত কর্মকর্তা প্রফেসর ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। গত ১৩ আগষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপণ জারি করা হয়। যদিও এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে, অনিয়ম, সরকারি কর্মচারি বিধি-বিধান না মানা এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকে অভিযোগ পর্যন্ত রয়েছে। তবে সব কিছুকে গোপন করে একাধিক যোগ্য ও দক্ষ বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করে অযোগ্য, অদক্ষ ও বিতর্কিত এই কর্মকর্তাকে এই পদে পদায়ন করা হয়েছে। এতে অধিদফতরের সর্বস্তরে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

অধিদফতরের বিভিন্ন স্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসে চাকরিতে যোদগদানকারি এই কর্মকর্তার চাকরি স্থায়ী হয় ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল। মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপসচিব হুমায়ন কবীর স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপানে চাকরি স্থায়ীকরণ করা হয় তবে বিসিএসে আত্তীকরণ হননি। অর্থাৎ তিনি বিসিএস’র বিবেচনায় নন ক্যাডার ও জুনিয়র। পুরো চাকরিজীবনে একদিনের জন্যেও মাঠ পর্যায়ে চাকরি করেননি। এমনকি উপজেলা, জেলা বা মেডিকেল কলেজ পর্যায়ে ও নয়। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, বিভাগীয় পরীক্ষা, সিনিয়র স্কেল পরীক্ষার মতো বাধ্যতামূলক মৌলিক বিষয়গুলি তিনি সম্পন্ন করেননি। এমনকি এগুলো থেকে তিনি প্রমার্জনাও পাননি।

সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা জানান, সরকারি সব ধরনের নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে তাকে এই পদে পদায়ন করা হয়েছে। তারা বলেন, দি বিসিএস রিক্রুটমেন্ট রুলস ১৯৮১ এবং দি বিসিএস এক্সামিনেশন ফর প্রমোশন রুলস ১৯৮৬, এজ এমেনমেন্ড আপটু আগষ্ট ১৯৯৯’ অনুযায়ী কাউকে অতিরিক্ত মহাপরিচালক হতে হলে, তাকে অবশ্যই কমপক্ষে ১৮ বছরে চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এছাড়া অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালক, চিকিৎসা শিক্ষা জনশক্তি উন্নয়ণ, প্রাইমারি হেলথ কেয়ার, রোগনিয়ন্ত্রন, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, আইপিএইচএন, আইপিএইচ, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেকোন একটির পরিচালক হিসাবে কমপক্ষে দুই বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এছাড়া মেডিকেল কলেজ, নিপসম, এনআইসিভিডি, আরআইএইচডি, এনআইও, আইডিসিএইচ, অথবা মেডিকেল কলেজের ভাইস-প্রিন্সিপালবা প্রিন্সিপাল হিসাবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। অথবা নিপসমের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, অতিরিক্ত পরিচালক হিসাবে নিপসম দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু এর কোনটির অভিজ্ঞতা তার ছিল না।

বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের শিডিউলভুক্ত পদে নন বিসিএস (স্বাস্থ্য) কর্মকর্তা পদায়ন বাতিলের দাবি জানিয়েছে বিসিএস হেলথ এসোসিয়েশন। কারণ স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা অধিকার বঞ্চিত হওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হচ্ছে যা কর্মস্পৃহা নষ্ট করছে। গতকাল বুধবার তারা এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে চিঠি দিয়েছে। বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার এসোসিয়েশন সভাপতি প্রফেসর ডা. আ ম সেলিম রেজা স্বাক্ষরিত ওই চিঠির অনুলিপি বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবকেও দেয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাকরিতে যোগদানের পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি বিদেশ গমন করেন। লিয়েন শেষে ২০০৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সহযোগী অধ্যাপক (চ:দা:) হিসাবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ এন্ড সোসাল মেডিসিন-নিপসমে যোগদান করেন। ২০০৯ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ক্ষতিগ্রস্থ কর্মকর্তাদের তালিকা প্রণয়ন করা হলে তিনিও অবেদন করেন। ২০১০ সালের ১৪ জানুয়ারি মন্ত্রনালয়ের প্রশাসন-১ শাখা থেকে এ সংক্রান্ত রিভিউ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, ডা. মীরজাদী সেব্রীনা ফ্লোরার ব্যক্তিগত নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তার পদোন্নতির বিষয়ে কোন আবেদন নেই। সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে তিনি নিয়মিত হননি। বিষয়ভিত্তিক সিনিয়রিটিতে তার অবস্থান ৪র্থ। তার থেকে সিনিয়র আরও ৩ কর্মকর্তা বর্তমানে কর্মরত আছেন। অর্থাৎ ক্ষতিগ্রস্থ হিসাবে আবেদন করলেও তিনি ক্ষতিগ্রস্থ ছিলেন না।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ এন্ড সোসাল মেডিসিন-নিপসমে চাকরিকালীন সময়ে তিনি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সহযোগী প্রতিষ্ঠানে (বিআইএসচএস) চাকরি করেছেন, নিয়মিত বেতন নিয়েছেন। সেই সময়ে গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত সংবাদ প্রকাশ হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারি চাকরিতে কর্মরত অবস্থায় ২০০৮ সালে তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্স-এ ‘এপিডেমিওলজি এন্ড বায়োস্টাস্টিক্স’ বিভাগের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন। প্রতিষ্ঠানটি তৎকালী পরিচালক প্রফেসর ডা. লিয়াকত আলী স্বাক্ষরিত নিয়োগ পত্রে দেখা যায়, প্রথমে তাকে ১ বছরের জন্য সেখানে নিয়োগ প্রদান করা হয়। নিয়োগ পেয়ে তিনি যেখানে নিয়মিত কাজ শুরু করেন। ২০০৯ সালে ৩ জানুয়ারি তার স্বাক্ষরিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের এক নম্বর পত্রে তার প্রমান রয়েছে। একই বছর ৪ মে তার স্বাক্ষরিত নোটিশেও তার প্রমান মেলে। এছাড়া তিনি নিয়মিত ভাবে সেখনে কোর্স পরিচালনা করেন এবং সব ধরনের একডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে যুক্ত থাকে। এমনকি বিআইএইচএস এর হয়ে ‘ফোর্থ কনটিনিউইং পাবলিক হেলথ এডুকেশন (সিপিএইচই)’ এর অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ২০১১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠানটির এপিডেমিওলজি বিভগের বিভাগীয় প্রধান হিসবে দায়িত্ব পালন করেণ। যদিও একই সময়ে তিনি নিপসমের হাজিরা খাতায়ও স্বাক্ষর করেন। এরপর ২০১২ সালের ২৯ মে সেব্রিনা ফ্লোরা সহযোগী অধ্যাপক (চলতি দায়িত্ব) থেকে সহযোগী অধ্যাপক হিসাবে পদোন্নতি পান এবং নিপসমের এপিডেমিওলজি বিভাগে তার পদায়ন হয়।

সেই সময়ে এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। দুদকের তৎকালীন মহাপরিচালক আবু মো. মোস্তফা কামাল স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের সচিবকে অবগত করা হয়। পরবর্তিতে মন্ত্রনালয়ের তৎকালীন উপসচিব খাজা আব্দুল হান্নান বিষয়টি তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রনালয়ে জমা দিতে মহাপরিচাকে অনুরোধ জানান। তবে অদৃশ্য কারণে এই তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।

এ বিষয়ে সরকারের সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, সরকারের অনুমতি ছাড়া কোন সরকারি কর্মকর্তা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারবেন না। তদন্তে বিষয়টি প্রমানিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। সেখানে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা বা শাস্তি প্রদান করা হবে। কিন্তু কেউ যদি এ বিষয়টি গোপন করেন তাহলে যিনি বা যারা গোপন করেছেন তাদেরও শাস্তি আওতায় আনতে হবে।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদফতরের কর্মকর্তারা বলেন, প্রফেসর ফ্লোরা আইইডিসিআর পরিচালক থাকাবস্থায় প্রতিষ্ঠানের ম্যান্ডেট অনুযায়ী করোনা প্রস্তুতি ও পূর্বাভাস দেয়ার কাজে সঠিক তথ্য, উপাত্ত, প্রজেকশন সরকারকে না দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন। সঠিক তথ্য না দিয়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে দেরি করিয়েছেন। ল্যাবরেটরীতে নমুনা পরীক্ষা, সম্ভাব্য রোগীর সংখ্যা সম্পর্কে প্রজেকশন, কন্টাক্ট ট্রেসিং, হাসপাতালে কোভিড রোগীদের প্রয়োজনীয় শয্যা সংখ্যা সম্পর্কে যথাযথ প্রজেকশন প্রদান করা ইত্যাদি না করে তিনি মিডিয়ার সামনে ব্রিফিং করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রয়োজনের তুলনায় করোনা পরীক্ষা না করতে পারায়, কন্টাক্ট ট্রেসিং করতে না পারায়, কীটের স্বল্পতা, হাসপাতালে করোনা রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করলে পরবর্তিতে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তত্ত্বাবধান করতে শুরু করেন। তার নির্দেশে অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।



 

Show all comments
  • Kamrul ২১ আগস্ট, ২০২০, ৭:৪২ পিএম says : 0
    অধ্যাপক খুরশীদ(ডিজি) স্যারের মত যোগ্য কেউ কি এডিজি হওয়ার মত নাই?
    Total Reply(0) Reply
  • মাসুদ করিম ২২ আগস্ট, ২০২০, ১১:০৮ পিএম says : 0
    এটি একটি অন্যায়,সজনপ্রীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহা।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: স্বাস্থ্য সেবা অধিদফতর
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ