Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মধ্যাঞ্চলে বন্যার অবনতি

ভাঙনের মুখে চাঁদপুর সাইক্লোন শেল্টার হবিগঞ্জে বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন

ইনকিলাব রিপোর্ট | প্রকাশের সময় : ১৯ জুলাই, ২০২০, ১২:০০ এএম

বৃষ্টি আর ভারতের ঢলে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও তিস্তাসহ প্রধান প্রধান নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে পদ্মা ও মেঘনার পানি গত ২৪ ঘণ্টা ব্যাপক বৃদ্ধির ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে এবং তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। চাঁদপুরে নবনির্মিত সাইক্লোন শেল্টার কাম স্কুলের ভবনটি ভাঙনের মুখে। সব মিলিয়ে দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পর এবার দেশের মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃত হচ্ছে বন্যা। রাজধানী ঢাকার পূর্বাঞ্চলের নিচু এলাকায় পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকার চার পার্শ্ববর্তী নবাবগঞ্জ, দোহার ও মানিকগঞ্জের নিম্নাঞ্চল এখন বন্যার পানির নিচে।

গতকাল বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী দু’তিন দিনের মধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন এলাকার মধ্যে পানি চলে আসতে পারে। এরই মধ্যে কমপক্ষে ২১টি জেলার গ্রামের পর গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখ লাখ মানুষ। পানিতে তলিয়ে গেছে ফসলী জমি। ভেসে গেছে মৎস্য খামার। পানি বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন স্থানে তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন। বন্যা দুর্গত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এছাড়া গবাদিপশু নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন মানুষ। অনেক স্থানে কোন ত্রাণ পাচ্ছে না। ত্রাণের জন্য চলছে হাহাকার।

চাঁদপুর থেকে বি এম হান্নান জানান, পদ্মা-মেঘনার ভয়াবহ ভাঙনে নবনির্মিত ওমর আলী স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টারের তৃতীয়তলা ভবন উদ্বোধনের একমাসের মাথায় নদীতে বিলীনের পথে। ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত ভবনটি যেকোনো সময় গিলে ফেলবে পদ্মা-মেঘনা। মাত্র ১ মাস আগে দৃষ্টিনন্দন এই ভবনটি কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এছাড়াও কয়েক দিনের ভাঙনে প্রায় ২ শতাধিক বসতবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। বর্তমানে আরো প্রায় ৫শ’ বাড়িঘর ভাঙনের মুখে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা ভিটেমাটি রক্ষায় স্থায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে। সদর উপজেলার মেঘনা নদীর পশ্চিমপাড় রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নে চলতি বর্ষায় আবারো পদ্মা মেঘনার ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়েছে। উত্তরাঞ্চল থেকে নেমে আসা বন্যার পানির প্রবল স্রোতে গত ১০/১২ দিন ধরে তীব্র নদীভাঙন দেখা দেয়।

কুড়িগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম বেবু জানান, এখনও ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৩ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়ায় বিপদসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ও ধরলার পানি ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে বইছে। বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে এখনও প্লাবিত হয়েছে চিলমারী উপজেলা শহর। কুড়িগ্রামে ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি কমতে থাকলেও মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। প্রথম দফায় ১২ দিন এবং পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফায় এক সপ্তাহ ধরে পানি অবস্থান করছে বিপদসীমার অনেক ওপর দিয়ে। ফলে দুর্ভোগে রয়েছে জেলার ৩ লাখ মানুষ। প্রায় ৫০ হাজার বাড়িঘর নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০ হাজার জমির ফসলী ক্ষেত। ৩৭ কিলোমিটার সড়কপথ এবং সাড়ে ৩১ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরো ১৩৯টি বিদ্যালয়।

টানা বন্যায় বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সঙ্কট। সরকারিভাবে বরাদ্দ ত্রাণ অপ্রতুল বলে জানিয়েছে বানভাসীরা। এখনো অনেকে ত্রাণ পায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। বন্যার ফলে রৌমারী ও চর রাজিবপুর উপজেলার অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অনুরূপ অবস্থা বিরাজ করছে চিলমারী উপজেলায়। এই তিন উপজেলায় নতুন করে আরো ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। চিলমারীতে পাট জাগ দিতে গিয়ে বন্যার পানিতে ডুবে মো. সুরুজ্জামান মিয়া (৪৫) নামে এক গ্রাম পুলিশের মৃত্যু হয়েছে।

নওগাঁ থেকে এমদাদুল হক সুমন জানান, ছোট যমুনা নদীর নান্দাইবাড়ি-কৃষ্ণপুর-মালঞ্চি বেড়িবাঁধ ভেঙে বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে প্রায় ১০টি গ্রাম। পানিতে নষ্ট হয়েছে আউশ ধানের ক্ষেত, পটল, বেগুন, কাঁচা মরিচসহ বিভিন্ন সবজির ক্ষেত আর তলিয়ে গেছে আমন ধানের বীজতলা। এছাড়াও ভেসে গেছে শতাধিক পুকুরের মাছ।
ফরিদপুর জেলা সংবাদদাতা নাজিম বকাউল জানান, জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সদর উপজেলার নর্থচ্যানেল, চরমাধদিয়া, ডিক্রিরচর ও আলিয়াবাদ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি রাস্তা তলিয়ে গেছে। মধুমতি ও আড়িয়াল খাঁর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সদর উপজেলা ছাড়াও সদরপুর, চরভদ্রাসন ও আলফাডাঙ্গায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে।

সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী জানান, জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। পানিবন্দি হয়ে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ নানা সমস্যায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নিম্নাঞ্চলের মানুষের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বন্যার শুরুতে সিরাজগঞ্জ সদরের শিমলা, এনায়েতপুর রাউতারা বাঁধ, বৈন্যারেহাই-বিনানই সড়কের সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়ক, এনায়েতপুর থানার ব্রাহ্মণ গ্রাম থেকে পাচিল পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার এলাকা যমুনার ভাঙনে বিলীন হয়েছে।

কুড়িগ্রামের উলিপুর থেকে হাফিজুর রহমান সেলিম বলেন, উপজেলার পৃথক স্থানে বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার চিড়াখাওয়ার পাড় এলাকায় ও চর বাগুয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র নদ বেষ্টিত উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের চর বাগুয়া গ্রামের মোস্তাজুল ইসলামের পুত্র বায়জিদ (৮) সকলের অজান্তে বন্যার পানিতে পড়ে ডুবে যায়। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এছাড়া উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের চিড়াখাওয়ার পাড় এলাকায় নানার বাড়িতে বেড়াতে এসে মুন্নি নামের দেড় বছরের এক শিশু বাড়ির উঠানে বন্যার পানিতে ডুবে মারা যায়।

হবিগঞ্জ জেলায় নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। টানা বৃষ্টি আর ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হবিগঞ্জের বিভিন্ন নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। নদীগুলোর পানি উপচে জেলার চার উপজেলার ফসলি মাঠ, গ্রামীণ সড়কসহ বিস্তৃীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এসব উপজেলার বাসিন্দাদের। পানিতে তলিয়ে বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এছাড়া হবিগঞ্জ-সুজাতপুর সড়কের বিশাল অংশ পানির নিচে রয়েছে। লাখাই, বানিয়াচং এবং আজমিরীগঞ্জ উপজেলার গ্রামীণ অনেক সড়ক পানিতে তলিয়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। হাওর এলাকায় গো-খাদ্যের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ