Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উত্তরে কমছে মধ্যাঞ্চলে অবনতি

| প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০১৭, ১২:০০ এএম

বন্যার শঙ্কায় ঢাকার চারপাশ : গঙ্গা-পদ্মায় পানি বাড়ছেই : ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও সুরমা-কুশিয়ারায় কমলেও বিপদসীমার ওপরে : বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ ঘনীভূত হলে এবং আসন্ন অমাবশ্যায় বন্যার অবনতি ঘটতে পারে : সর্বত্র ভয়াবহ ভাঙন : ২১ নদী ৩০টি পয়েন্টে বিপদসীমার ওপরে : পানি বাড়ছে ৪৩ ও কমছে ৪৬ পয়েন্টে : ভাটিতে ঘূর্ণিস্রোতে ব্যাহত নৌ চলাচল : খাদ্য পানি ওষুধ সঙ্কটে বন্যার্তদের হাহাকার
ইনকিলাব ডেস্ক : দেশের উত্তরাঞ্চলে প্রবল বন্যা এখন ছড়িয়ে পড়ছে দেশের মধ্যাঞ্চলে। এরই মধ্যে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল ও ফরিদপুরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে পাঠানো সর্বশেষ বুলেটিনেও বলা হয়েছে, দেশের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলোতে এ পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ এবং বিভিন্ন শাখা উপনদী ছাড়াও গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি তীব্রবেগে ভাটির দিকে নামছে। এরফলে ঢাকার চারপাশ ও মধ্যাঞ্চলে পানির চাপ বেড়ে গেছে। শীতলক্ষ্যা নদী গাজীপুরের কাপাসিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলে যমুনা, কুড়িগ্রাম ফেরীঘাট পয়েন্টে ধরলা, চিলমারী পয়েন্টে ব্রক্ষপুত্র, গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা, নঁওগায় আত্রাই নদীর, ছোট যমুনা, নাটোরের নলডাঙ্গায় বারনই, সিংড়ায় আত্রাই, গাইবান্ধায় ব্র্র্রক্ষপুত্র, করতোয়া, ঘাঘটের পানি, ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে, গোবিন্দগঞ্জে করতোয়া নদীর কাটাখালী পয়েন্টে সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করে বিপদ সীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যাকবলিত মানুষের সংখ্যা অর্ধকোটি ছাড়িয়ে গেছে। সরকারি হিসেবে বন্যায় মৃতের সংখ্যা ৩৯ থেকে বেড়ে ৬১ জনে দাঁড়ালেও বেসরকারি হিসেবে তা ৮০ ছাড়িয়ে গেছে। আর বন্যার কারণে দেশের এক-তৃতীয়াংশ বাঁধ ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ফলে ভেসে গেছে অনেক রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ট্রেন লাইন। অচল হয়ে পড়েছে বিভিন্ন জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা। বন্যার পানি আর ভাঙনে বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় হাজার হাজার মানুষ নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবার-পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি, উঁচু জমি ও বাঁধে পলিথিন মোড়ানো খুপড়ি ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। এদের অধিকাংশই রয়েছেন খোলা আকাশের নিচে। রাতে মানুষ তাদের গবাদি পশু নিয়ে একই স্থানে গাদাগাদি করে কোন রকমে রাত পার করছে। খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, জ্বালানী ও গো-খাদ্যের চরম সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন জেলায় হাঁস, মুরগিসহ বিভিন্ন মৃত পশু পানিতে ভাসছে। ফলে আশপাশের এলাকা দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। দুষিত হচ্ছে পরিবেশ ও পানি। দেখা দিচ্ছে বিভিন্ন রোগব্যাধি। অনেক স্থানে মেডিকেল টিম গঠন করলেও তা পর্যাপÍ নয়। সরকারি ত্রাণ অপ্রতুল হওয়ায় সবার ভাগ্যে জুটছেনা ত্রাণ। ত্রাণের জন্য হাহাকার চলছে। কোন ট্রলার বা নৌকা দেখলে অনাহারে থাকা লাখ লাখ মানুষ ছুটছে সামান্যতম খাবারের আশায়। কিছু খাবার, বিপরীতে অনেকজন হাত পেতে বসে আছে। ফলে দীর্ঘসময় উপোষ আর পানির মধ্যে দাড়িয়ে থেকে যে ত্রাণ পাওয়া যায় তা প্রয়োজনের তুলনাই খুবই অপ্রতুল। এরকমই হাহাকারে দিন কাটছে বন্যার্ত মানুষগুলোর। অনাহারে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। বন্ধ রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভেসে লাখ লাখ হেক্টর ফসলি জমি ও খামারের মাছ। দুচিন্তায় কৃষকের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। স্থগিত হয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত সকল পরীক্ষা। এসব মানুষের দুঃখ কষ্ট নিয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য নিয়ে রিপোর্ট:
বিশেষ সংবাদদাতা, চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, নদ-নদীসমূহের কোথাও পানি হ্রাস কোথাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দেশে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। অধিকাংশ নদ-নদী এখনো বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হলেও উত্তর জনপদে পানি ধীরে ধীরে কমছে। তবে মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি অব্যাহত রয়েছে। বন্যার শঙ্কায় এখন ঢাকার চারপাশের এলাকাগুলোও। গতকাল (শুক্রবার) সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তে গঙ্গা-পদ্মায় পানি টানা বাড়ছেই। এতে করে ফুঁসে উঠছে পদ্মার ভাটি এলাকাগুলো। পদ্মা ও মেঘনার ভাটিতে প্রচÐ ঘূর্ণি¯্রােত সৃষ্টি হয়েছে। ফলে ব্যাহত ও ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে লঞ্চ-স্টিমার নৌযান ফেরি চলাচল। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ এবং সুরমা-কুশিয়ারা নদীতে পানি কমলেও বিপদসীমার উপরে রয়েছে। এদিকে গতকাল সকালে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। এটি ঘনীভূত হয়ে শক্তি সঞ্চয় করে মৌসুমি নি¤œচাপে পরিণত হলে এবং আসন্ন অমাবস্যায় ভরা জোয়ারে সাগর যদি উত্তাল হয়ে উঠে তাহলে মধ্যাঞ্চল, মধ্য-দক্ষিণ ও দক্ষিণের অংশে বন্যার অবনতি ঘটতে পারে। অব্যাহত বন্যায় সর্বত্র ভাঙন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রাম-জনপদ, শহর-বন্দরে হাজারো বসতঘর, হাট-বাজার, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা। গতকাল সর্বশেষ তথ্যে ২১টি নদী ৩০টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ৯০টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে পানি বৃদ্ধি ৪৩টিতে ও হ্রাস ৪৬টিতে। এ যাবত ২৬টি জেলায় অন্তত ৬০ লাখ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ মুহূতে পানিবন্দী মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যা ৬ লাখেরও বেশি। বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে খাদ্য নেই বিশুদ্ধ পানি নেই ওষুধ নেই। বন্যার্তদের মাঝে শুধুই হাহাকার বিরাজ করছে। সরকারি ত্রাণ তৎপরতা নামেমাত্র এবং খুব সীমিত। বেসরকারি ত্রাণ বিশেষত এদেশের ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের বলতে গেলে যেন কানে পৌঁছছে না বন্যার্তদের আহাজারি!
এদিকে রাজধানী ঢাকা এখনও বন্যা কবলিত না হলেও গতকাল সর্বশেষ নদ-নদী প্রবাহের তথ্য-পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ঢাকার চারদিকেই এবং দেশের মধ্যাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি অব্যাহত রয়েছে। রাজধানী ঢাকার চারপাশে থাকা নদ-নদীগুলোতে পানি বাড়ছেই। ঢাকা ও চারপাশের ৮টি নদী এখন পর্যন্ত বিপদসীমার নিচে থাকলেও তা ২৩ সেমি থেকে ১৩০ সেমি নিচে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীগুলোর মধ্যে বুড়িগঙ্গা ১৩০ সেমি নিচে, ডেমরায় বালু নদী ৪৮ সেমি নিচে, নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী ২৩ সেমি নিচে আছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদ এবং বিভিন্ন শাখা উপনদী ছাড়াও গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি তীব্রবেগে ভাটির দিকে নামছে। এরফলে ঢাকার চারপাশ ও মধ্যাঞ্চলে পানির চাপ বেড়ে গেছে। যা পদ্মা থেকে মেঘনার মোহনায় পর্যন্ত পানি বৃদ্ধির কারণ। গঙ্গা-পদ্মার উজানভাগে নেপাল এবং ভারতের বিহারের ঢলের চাপে অন্যতম প্রধান গঙ্গা-পদ্মা অববাহিকায় প্রতিটি পয়েন্টেই পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। এদিকে তৃতীয় দিনের মতো গতকালও ব্রহ্মপুত্র ও যমুনায় পানি আরো কমছে। যদিও বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমার উপরে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সাব-হিমালয় পাদদেশ, চীন তিব্বত, নেপাল, ভূটান ও ভারতে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে চলতি কিংবা আগামী দুই বা তিন সপ্তহে আবারো অতিবর্ষণ হলে বাংলাদেশে উজানের ঢলে বন্যা হতে পারে আরো ভয়াবহ।
দেশের প্রধান নদ-নদীর প্রবাহ ও বন্যার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা এই তিন অববাহিকার মধ্যে গঙ্গার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ব্রহ্মপুত্রের উজানে ভারতীয় অংশে এবং মেঘনা অববাহিকার ভারতীয় ও বাংলাদেশ অংশে পানি হ্রাস অব্যাহত আছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদীর ভারতীয় অংশে আসামের গোয়াহাটিতে ৩৩ সেমি, পান্ডুতে ২২ সেমি, গোয়ালপাড়ায় ২৭ সেমি এবং ধুবরীতে ১৮ সেমি হারে পানির সমতল হ্রাস পেয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানির সমতল নুনখাওয়া, চিলমারী, বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি এবং সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে হ্রাস পাওয়া অব্যাহত আছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি হ্রাস অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে। তিস্তা-ধরলা-দুধকুমার অববাহিকার নদীর পানি হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে বন্যার উন্নতি বজায় থাকবে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পদ্মা নদী তিনটি পয়েন্টেই বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং পানি আরও বেড়ে গেছে। আর পদ্মার উজানভাগ গঙ্গায় পানি বাড়লেও বর্তমানে বিপদসীমার ৫৪ থেকে ১২২ সেমি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে মেঘনা অববাহিকায় বন্যা পরিস্থিতির আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় উন্নতি অব্যাহত থাকবে।
সার্বিক নদ-নদী পূর্বাভাসে জানা গেছে, ব্রহ্মপুত্র- যমুনার ভারতীয় অংশে আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টায় গড়ে ২১ সেমি পানি হ্রাস পেতে পারে। বাংলাদেশ অংশে বিভিন্ন পয়েন্টে আগামী ৭২ ঘণ্টায় পানি হ্রাস অব্যাহত থাকবে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি আগামী ৪৮ ঘণ্টায়ও অব্যাহত থাকবে। তবে এই নদীর পানি বৃদ্ধির হার আগের তুলনায় কমে আসছে এবং বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। মেঘনা অববাহিকায় পানি আগামী ৪৮ ঘন্টায় হ্রাস অব্যাহত থাকবে। দেশের উত্তরাঞ্চলের বর্তমান বন্যা পরিস্থিতি বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জে উন্নতির দিকে থাকবে। দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের বিশেষত মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মুঞ্জিগঞ্জ, শরীয়তপুর অঞ্চলের নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অবনতির দিকেই থাকবে। মধ্যাঞ্চলের ঢাকার চারদিকের নদ-নদীর পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মধ্যাঞ্চলে কালিগঙ্গা নদীতে পানি আরও বেড়ে বিপদসীমার ৬১ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ঢাকা বিভাগের নদী ধলেশ্বরী মধ্যাঞ্চলে টাঙ্গাইলের এলাসিনে পানি আরও কিছুটা বেড়ে বিপদসীমার ১১২ সেমি উপর দিয়ে এবং দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলে তিতাস নদীর পানি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আরও বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩৫ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
প্রধান নদ-নদীসমূহের মধ্যে বিপদসীমার উপরের অবস্থানে থাকে- ব্রহ্মপুত্র নদ কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী পয়েন্টে গতকাল পানি আরও হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ৩৪ সেমি উপরে প্রবাহিত হচ্ছিল। যমুনা নদের পানি ৫টি পয়েন্টেই হ্রাস পাওয়া অব্যাহত রয়েছে। যমুনা বাহাদুরাবাদে বিপদসীমার ৯৫ সেমি উপরে, সারিয়াকান্দিতে ৯৪ সেমি উপরে, কাজীপুরে ১৩৪ সেমি উপরে, সিরাজগঞ্জে ১৩৫ সেমি উপরে এবং ভাটির দিকে আরিচায় ৭৪ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পদ্মা নদীর পানির প্রবাহ গতকালও তিনটি পয়েন্টে আরো বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরমধ্যে গোয়ালন্দে ১০৬ সেমি উপরে, ভাগ্যকুলে ৪০ সেমি উপরে এবং সুরেশ্বরে ৩১ সেমি উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পদ্মার উজানভাগের গঙ্গা নদী পাংখা পয়েন্টে ১২২ সেমি, রাজশাহীতে ১২০ সেমি এবং হার্ডিঞ্জ ব্রিজপয়েন্টে ৫৪ সেমি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এই তিনটি পয়েন্টেই বাড়ছে গঙ্গার পানির সমতল।
উত্তর জনপদে ধরলা, যমুনেশ্বরী, ঘাগট, মেঘনা অববাহিকায় সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। তবে বিপদসীমার উপরে রয়েছে। হ্রাস অব্যাহত থাকবে। নেত্রকোণা জেলায় কংস নদীর পানি ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত ছিল বিপদসীমার ১০৪ সেমি উপরে। মৌলভিবাজারে মনু নদীর পানি হঠাৎ ফের গতকাল বৃদ্ধি পায়। তবে বিপদসীমার নিচে প্রবাহিত হচ্ছিল।
বগুড়া ব্যুরো জানায়, বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১০২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যাকবলিত এলাকায় সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে ত্রান তৎপরতার তেমন কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছেনা। ত্রানের জন্য বানভাসী মানুষের দুর্দশা চরমে পৌঁছে গেছে। বিশুদ্ধ পানিসহ খাবার সংকট রয়েছে। দেড় হাজার হেক্টর জমির ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি প্রবেশ করায় ৮৫ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী জানান, সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১৩১সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে, পানি কমলেও বন্যার্ত মানুষের দুঃখ দুর্দশা কমেনি। তাদের পানিবাহিত রোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র, ত্রাণ, খাবার স্যালাইন, বিশদ্ধ পানি ও গোখাদ্য সংকটে ভুগছে বানভাসি মানুষেরা। অপরদিকে, জেলার দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষের দুর্গতির শেষ নেই। সিরাজগঞ্জ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভাঙন আতংকে রয়েছে জেলাবাসী।
শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, কুড়িগ্রাম ফেরীঘাট পয়েন্টে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৩২ সে.মি এবং চিলমারী পয়েন্টে ব্রক্ষপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৪৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে বাপক ভাঙ্গন। পুরোপুরি পানি না নামা পর্যন্ত ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ মেরামতের সুযোগ নেই। ত্রাণ অপ্রতুল হওয়ায় দুর্গম অঞ্চলে মানুষগুলো অনাহারে দিন কাটছে। তারা অভিযোগ করছে তাদের শুধু খবর নিয়ে যায় বিনিময়ে কোন ত্রান পায় না। এমন কি বন্যার এ দিন গুলিতে কোন জনপ্রতিনিধি তাদের দেখতে পর্যন্ত আসেনি। গত বৃহষ্পতিবার পানিতে ডুবে দ্ইু শিশু মারা গেছে। বন্ধ রয়েছে ৯২৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পানিতে তলিয়ে গেছে ৪৭ হাজার হেক্টর জমির আমন ক্ষেতসহ ৫০ হাজার হেক্টর জমির ফসল।
আতাউর রহমান আজাদ, টাঙ্গাইল জেলা থেকে জানান, “আল্লাহ ছাড়া আমাগোরে দেখার কেউ নাই। বানের পানি ধরে রাখতি আমরা হগলে মিলা কাজ করতাছি। তাও যদি শেষ রক্ষে হয়।” আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন, টাঙ্গাইলের নদী তীরের বাঁধে আশ্রয় নেওয়া সত্তুরোর্ধ বৃদ্ধ রহমান মিয়া। টাঙ্গাইলে যমুনা নদীর পানি বিপদ সীমার ১০৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। টাঙ্গাইল-তারাকান্দি সড়ক ভেঙে যাওয়ায় বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ভূঞাপুর, গোপালপুরের বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। শহর রক্ষা বাঁধটি হুমকিতে রয়েছে। ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধুসেতু হয়ে উত্তরবঙ্গের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মহাসড়কটি বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নাজিম বকাউল, ফরিদপুর জেলা থেকে জানান, গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মার পানি বিপদসীমার ৯২ সেন্টিমিটার, চরভদ্রাসন উপজেলায় ১০৬ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এত গত দুই থেকে তিন দিনে ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলার ১০ টি ইউনিয়নে পানি প্রবেশ করেছে। ডুবে গেছে বিভিন্ন এলাকার অন্তত ১০ টি পাকা সড়ক। এদিকে বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকার মানুষ ত্রাণ না পাওয়ার অভিযোগ করেছে। বিভিন্ন উপজেলার রাস্তার সাথে পদ্মা নদী একাকার হয়ে রয়েছে। জেলা শহরের সাথে বিভিন্ন এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
নওগাঁ জেলা সংবাদদাতা জানান, আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ২০৩ সেন্টিমিটার, ছোট যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনার বন্যা নিয়ন্ত্রন এবং ভেরী বাঁধ ভেঙ্গে গিয়ে ওইসব অঞ্চল প্লাবিত হয়। এখনো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। জেলা সদরের সাথে আত্রাই উপজেলার ও নাটোর জেলার সাথে সড়ক যোগাযোগ এখনো বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে ১০৯টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ফসল বিনষ্ট হয়েছে ৩ হাজার ৯শ ৯২ হেক্টর জমির। গত ২ দিনে বন্যার পানিতে ডুবে ২ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে।
মোঃ আজিজুল হক টুকু নাটোর থেকে জানান, নাটোরের নলডাঙ্গায় বারনই নদীর পানি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি ও সিংড়ার আত্রাই নদীর পানি বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে করে নদী তীরবর্তী জনগণের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়ে শত শত বিঘা আমন ধান তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে শতাধিক পুকুরের মাছ। দরিদ্র অসহায় মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
এম সাঈদ আহমাদ শিবচর, (মাদারীপুর) থেকে জানান, পদ্মা ও আড়িয়াল খা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নদী ভাঙ্গনের ব্যাপকতা বেড়েছে। ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের মাদারীপুরের শিবচরে আড়িয়াল খা নদের উপর নির্মানাধীন ২য় সেতুর স্টোকইয়ার্ড ১শ-দেড়শ মিটার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। উপজেলার ৫ টি ইউনিয়ন আক্রান্ত হয়ে ২টি মাদরাসা, ১ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২ শতাধিক ঘর-বাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনা বিলীন হয়েছে। পানির নিচে কাঠালবাড়ির ৩টি ফেরি ঘাট সংলগ্ন পল্টুন ও সড়ক। ফলে যাত্রীদের দূর্ভোগ দেখা দিয়েছে।
গাইবান্ধা জেলা সংবাদদাতা জানান, গাইবান্ধায় ব্র্র্রক্ষপুত্র নদীর পানি বিপদ সীমার ৭০ সে: মিটার, করতোয়ার পানি বিপদ ৬৯ সে: মি. ও ঘাঘটের পানি বিপদ সীমার ৫২ সে: মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল সকালে গোবিন্দগঞ্জের করতোয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ১ শ মিটার জায়গা ভেঙে ইউনিয়ন দুটিতে পানি প্রবেশ করছে। ডুবে গেছে ফসলি জমি ও ঘরবাড়ী। বন্যার পানিতে ডুবে মারা গেছে দুই শিশুসহ তিন জন। বন্যার্ত এলাকার নিরাপদ পানি সংকট রযেছে। স্থগিত করা হয়েছে জেলার ২৫৮ টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২য় সাময়িক পরীক্ষা।
মুক্তার হোসেন রানা ফুলছড়ি (গাইবান্ধা) উপজেলা থেকে জানান, গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার তিস্তামুখ ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বলে বানভাসীরা অভিযোগ করছেন। ফুলছড়িতে বন্যার্তদের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করলেন ডেপুটি স্পিকার।
রবিউল কবির মনু, গোবিন্দগঞ্জ(গাইবান্ধ)উপজেলা থেকে জানান, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে করতোয়া নদীর কাটাখালী পয়েন্টে সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গকরে বিপদ সীমার ৭৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ১৯৮৮ সালে এ পয়েন্টে সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল বিপদ সীমার ৬১ সেন্টিমিটার। অব্যাহত পানি বৃদ্ধিতে গোবিন্দগঞ্জে অর্ধ শতাধিক গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। মারাত্মক ফাটল দেখা দিয়েছে করতোয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রন বাঁধে।
আবুল হাসান সোহেল মাদারীপুর থেকে জানান, পদ্মায় পানি বেড়েছে ১২ সে.মি.। পানির তোড়ে মাদারীপুর জেলার শিবচরের পদ্মা বেষ্টিত চরাঞ্চলে ব্যাপক নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। নদী ভাঙ্গণে আক্রান্ত হয়েছে মাদরাসাসহ শতাধিক বাড়ি ঘর। নদী ভাঙ্গন মারাত্মক আকার ধারণ করায় আক্রান্তরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। অপর দিকে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির কারণে কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুটে কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের পন্টুন নিমজ্জিত হওয়ায় যানবাহন ফেরিতে লোড আনলোড করতে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে যে কোন সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।
বি এম হান্নান চাঁদপুর জেলা থেকে জানান, উজানের নেমে আসা পানির প্রবল স্রোতে পদ্ম-মেঘনা চাঁদপুরে ৪টি গ্রামের প্রায় দেড়শ’ বসতবাড়ি নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। এখনো ঝুঁকিতে রয়েছে পাঁচ শতাধিক পরিবার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উত্তরে কমছে মধ্যাঞ্চলে অবনতি
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ