Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাঘের সাজা

প্রকাশের সময় : ১ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আ ব্দু স সা লা ম
এক দেশে বড় একটি বন ছিল। সেই বনের মাঝে একটি উঁচু পাহাড় ছিল। পাহাড়ের চারপাশটা ঘন গাছপালায় পরিপূর্ণ। আর তার পাদদেশে পড়ে ছিল বড় বড় পাথরের খ-। কোনো প্রয়োজন না হলে ওই পাহাড়ে কোনো পশুপাখি উঠত না। বনটি ভয়ংকর ও নিরীহ পশুপাখিতে পরিপূর্ণ ছিল। বনে বাস করত বাঘ, সিংহ, হাতি, ভাল্লুক, শিয়াল, হরিণ, খরগোশ এবং নানান প্রজাতির পাখি। বাঘ ও সিংহ মাংসাশী প্রাণী। তারা সুযোগ পেলেই নিরীহ প্রাণীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। তাই বনের নিরীহ প্রাণীরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকত। বাঘ সিংহের অত্যাচার থেকে তাদের বাঁচার কোনো উপায় ছিল না।
বনের ভিতর একটি বৃদ্ধ বাঘ বাস করত। বাঘটি বেশ বুদ্ধিমান ছিল। একসময় সে খুব শক্তিশালী ছিল। বৃদ্ধ হওয়ার কারণে তার শক্তি-সামর্থ্য কমে গিয়েছিল। তার শারীরিক অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছিল। ক্ষুধা নিবারণের জন্য তেমন কোনো প্রাণী শিকার করতে পারত না। প্রায়ই তাকে উপোষ থাকতে হতো। তাই সে মনে মনে ভাবলÑ আমাকে এমন একটা উপায় বের করতে হবে যাতে বসে বসে খাওয়া যায়। তার এই পরিকল্পনা সফল করতে হলে বনের অন্যান্য পশুপাখির সহযোগিতা প্রয়োজন হবে। বিষয়টি নিয়ে সলাপরামর্শ করার জন্য একদিন বাঘটি এক সিংহের সাথে দেখা করল। বাঘের পরিকল্পনার কথা শুনে সিংহটি খুব খুশি হলো। সে ভাবল বাঘের মতামতটা খারাপ না। একবার যদি উপায়টা বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে বৃদ্ধ বয়সে তারও কোনো চিন্তা থাকবে না। তারা দুজনে সিদ্ধান্ত নিল যে, বনের সকল পশুপাখির সমর্থনে পরিকল্পনাটি বাস্তবায়ন করবে। এর জন্য তারা একটি কৌশল অবলম্বন করল।
পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক সিংহ সব পশুপাখিকে নিয়ে বনের মধ্যে একটি সাধারণ সভা আহ্বান করল। নির্ধারিত দিনে সকল পশুপাখি সভায় উপস্থিত হলো। সভায় উপস্থিত নিরীহ পশুপাখির সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। তারা কেউই জানত না যে, কী বিষয়ে আলোচনা হবে। যাহোক, সভা শুরু হলো। সিংহ সকলের উদ্দেশে বলল : আমরা মরণশীল প্রাণী। আমাদের সকলকে একে একে মৃত্যুবরণ করতে হবে। বৃদ্ধ বয়সে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। তেমন করে আমরা ক্ষুধা নিবারণ করতে পারি না। আমাদের অনেককে উপোষ থাকতে হয়। তাছাড়া নানান রকম সমস্যায় জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। আমরা এমন একটি উপায় বের করতে চাই যাতে এখন থেকে বৃদ্ধ বয়সে কাউকে আর কষ্ট করতে না হয়। আপনারা কি আমার সাথে একমত? আপনারা কি চান আমরা সেরকম একটি উপায় বের করি? সিংহের প্রশ্নের উত্তরে সকল পশুপাখি একযোগে বলল : হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমরা সকলেই চাই...। তারপর সিংহ বলল : আমরা সকলের সাথে আলোচনা করে আজকে একটা সিদ্ধান্ত নেব এবং সেই সিদ্ধান্তটি আমরা এখন থেকেই সকলে মেনে চলব। সিংহের প্রস্তাবে উপস্থিত পশুপাখিরা একমত পোষণ করল।
বাঘের আর তর সইল না। সে বলেই ফেলল যে, বৃদ্ধদের কষ্ট লাঘবের জন্য সভায় যে সিদ্ধান্তই গৃহীত হবে তা অবশ্যই আমি মেনে নেব। তবে আমার মতামত হলো বনের মধ্যে কে সবচেয়ে বৃদ্ধ তা আগে নির্বাচন করা হোক। অন্তত একজন হলেও তাকে এখন নির্বাচন করা জরুরি। বাঘের এ পরামর্শ পশুপাখিরা মেনে নিল। তারা বললো : ঠিক আছে। তাই হোক। তারপর পশুপাখিদের মধ্যে কে সবচেয়ে বৃদ্ধ তা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলো। উপস্থিত সকল পশুপাখির মতামত অনুযায়ী জানা গেল যে, সভায় উপস্থিত একমাত্র বুদ্ধিমান বাঘই হলো বনের পশুপাখিদের মধ্যে সবচেয়ে বৃদ্ধ প্রাণী। সকলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বুদ্ধিমান বাঘকে বনের সবচেয়ে বৃদ্ধ পশু হিসেবে নির্বাচিত করা হলো। বৃদ্ধ প্রাণী হিসেবে নির্বাচিত হতে পেরে বুদ্ধিমান বাঘ মনে মনে খুব খুশি হলো।
বাঘের বৃদ্ধ বয়সের জ্বালা-যন্ত্রণা কীভাবে লাঘব করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর সিংহ সকলের উদ্দেশে বললো : বৃদ্ধ বাঘের কষ্ট দূর করা আমাদের সকলের কর্তব্য। তার জন্য আমরা কী কী করতে পারি বা কী করা উচিত তা নিয়ে এখন আলোচনা হবে। সভার সিদ্ধান্ত আমরা সকলেই মেনে নেব। বৃদ্ধ বাঘসহ সকল পশুপাখি এটা মেনে নিল। প্রথমেই সিংহ তার মতামত জানাল। সে বলল : বৃদ্ধ বাঘকে এখন থেকে আর খাবারের জন্য বিভিন্ন জায়গাতে ঘুরে বেড়াতে হবে না। সে ঘরের মধ্যে বসে থাকবে আমরা তাকে খাবার জোগাড় করে দেব। অথবা আমাদের মধ্যে কেউ কেউ পালাক্রমে তার কাছে খাবার হয়ে যাব। আপনারা কী বলেন? উপস্থিত অন্যান্য বাঘ ও সিংহ একযোগে তার কথায় ঠিক ঠিক বলে সমর্থন জানাল। আর নিরীহ প্রাণীরা চুপ করে বসে থাকল। নিরীহ প্রাণীরা এ প্রস্তাবটি সমর্থন না করায় তা কার্যকর করা গেল না।
হাতি বলল : বাঘের খাবার জোগাড় করা খুব কঠিন কাজ। তার চেয়ে আরও কঠিন কাজ হলো খাবার হয়ে তার সামনে উপস্থিত হওয়া। প্রাণ যাওয়ার ভয়ে কেউ তার সামনে যেতে চাইবে না।
এ কথা শুনে সিংহ বলল : না, না। তা কেন হবে। বনের মধ্যে অনেক ছোট ছোট পশুপাখি রয়েছে। যাদেরকে আমরা খাবার হিসেবে বাঘের কাছে পাঠিয়ে দেব। তাদের এত বাঁচার কী দরকার। তারা তো ছোট প্রাণী। তাছাড়া আমরা তাদেরকে মিথ্যা কথা বলে বাঘের কাছে পাঠিয়ে দিতে পারব। তাতে আমাদের কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। এ প্রস্তাবে বৃদ্ধ বাঘ খুশিতে আটখানা। সে মনে মনে এরকম একটা প্রস্তাবই চাচ্ছিল। তার চোখে-মুখে খুশির রেখা ফুটে উঠেছে। কিন্তু সিংহের এ প্রস্তাবটি বাঘ ও সিংহ ছাড়া আর কেউই সমর্থন করল না। তাই এই প্রস্তাবটিও ভেস্তে গেল।
বাঘ ও সিংহের কৌশলটি চালাক শিয়াল বুঝতে পেরেছিল। সবকিছু শুনে সে বলল : আমার মত হলো, বৃদ্ধদের কষ্ট করে বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। মরতে যখন হবেই তখন কষ্ট করে কী লাভ। তার চেয়ে বরং বৃদ্ধরা যাতে দ্রুত মৃত্যুবরণ করতে পারে তার ব্যবস্থা করাই হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। তাহলে তাদের আর বৃদ্ধ বয়সের জ্বালা-যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না। অবশ্য এর পেছনে অনেক উপকারও আছে। কেননা বৃদ্ধরা বনের জন্য একটা বড় বোঝা। তাদের দ্বারা বনের বা পশুপাখিদের কোনো উপকার হয় না। কারণ উপকার করার মতো শক্তি-সামর্থ্য বৃদ্ধদের থাকে না। তাই মৃত্যু নিশ্চিত করার কাজে আমরা বৃদ্ধ বাঘকে সহযোগিতা করতে পারি। শিয়ালের এই প্রস্তাবে বৃদ্ধ বাঘ ভীষণ রেগে গেল। সে রাগে গড় গড় করতে থাকল। কিন্তু তার তখন কিছুই করার ছিল না।
শিয়ালের মতামতকে উপস্থিত নিরীহ পশুপাখিরা একযোগে সমর্থন করল। তারা চিৎকার করে বলল : উত্তম প্রস্তাব, উত্তম প্রস্তাব,...। নিরীহ প্রাণীরা সংখ্যায় বেশি ছিল। তাই কী আর করা। সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতকেই প্রাধান্য দিতে হলো। অবশেষে ‘এখন থেকে বৃদ্ধদের দ্রুত মৃত্যুবরণের ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে।’ মর্মে সভায় সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক এখন বাঘকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। মৃত্যুর কথা স্মরণ করে বৃদ্ধ বাঘ ভয়ে কাঁপতে থাকল। বাঁচার কোনো উপায় না দেখে বাঘটি সভা হতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সকলের কড়া নজরদারির কারণে বৃদ্ধ বাঘটি পালাতে পারল না। বনের পশুপাখিরা তাকে ধরে ফেলল। ধূর্ত বাঘের শাস্তি হবে জেনে বনের নিরীহ প্রাণীরা ভীষণ খুশি হলো। উপস্থিত সিংহ ও অন্যান্য বাঘেরা কিছুই করতে সাহস পেল না। তারাও ভয়ে চুপ করে থাকল। কারণ তারা সংখ্যায় খুব কম ছিল।
যাহোক, বৃদ্ধ বাঘের মৃত্যুর ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য আয়োজন করা হলো। বাঘের হাত-পা একটা শক্ত দড়ি দিয়ে বাঁধা হলো। আর বাঘটি খুব আফসোস করতে থাকল। সে মনে মনে বলল : কেন যে বনের পশুপাখিদের ঠকাতে চেয়েছিলাম। যার ফলাফল আমার মৃত্যুদ-। মৃত্যুর ভয়ে বাঘটি হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। তার কান্না শুনে কারোর মন গলল না। কেউই তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে এলো না। বনের পশুপাখিরা তাকে ধরাধরি করে সেই উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠাল। তারপর তাকে এক ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেওয়া হলো। নিচে পড়ার সাথে সাথে বৃদ্ধ বাঘের মৃত্যু হলো। এভাবে বাঘের মৃত্যু কার্যকর হওয়ার পর থেকে আর কখনো বনের কোনো পশুপাখি কাউকে ঠকানোর সাহস দেখায়নি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাঘের সাজা

১ আগস্ট, ২০১৬
আরও পড়ুন