Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

বৃষ্টি ও ভারতের ঢল : বাড়ছে নদ নদীর পানি

তলিয়ে যাচ্ছে চর ও নিম্নাঞ্চল ফসলের ক্ষতির শঙ্কা

ইনকিলাব রিপোর্ট | প্রকাশের সময় : ২৯ মে, ২০২০, ১২:৪৯ এএম

ঘূর্ণিঝড় আম্পান চলে গেলেও তার প্রভাব এখনো কাটেনি। সারাদেশে এখনো ঝড়ো হাওয়া ও ভারি বর্ষণ হচ্ছে। এ ছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এসব অঞ্চলে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে উজান থেকে নেমে আসছে ঢল। উজানের দেশ ভারত অন্যান্য বছর মে-জুন মাসে গজল ডোবার ব্যারেজের সøুইসগেইট বন্ধ থাকে, যেন ভাটিতে বাংলাদেশ পানি না পায়। এবার আম্পানের প্রভাবে অতি বৃষ্টির কারণে পশ্চিমবঙ্গ আসামকে বন্যামুক্ত রাখতে ব্যারেজের সবকটা সøুইসগেইট খুলে দিয়েছে ভারত। এতে নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিলেট, ও সুনামগঞ্জ জেলার নদ ও নদীর পানি বর্ষার আগেই বাড়ছে।

দেশের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বৃষ্টিপাত ও নদ নদীর অবস্থার পূর্বাভাসে জানিয়েছে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা আরও দুই দিন অব্যাহত থাকবে। ভারি বৃষ্টির কারণে উত্তরের তিস্তা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও এর শাখা নদীর পানি বর্ষার আগেই বাড়ছে। তাতে আগাম বন্যার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নদী তীরের নীচু এলাকাসহ চরের চাষিদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। ভারি বর্ষণ ও বজ্রপাতে প্রাণহানির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত এক সপ্তাহে নৌকাডুবি, ঝড় ও বজ্রপাতে বেশ কয়েকজন মারা গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বৃষ্টিপাত ও পানিবৃদ্ধিতে বিভিন্নস্থানে নদী ভাঙন শুরু হয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, ময়মনসিংহ, পাবনা, যশোর, নোয়াখালী, চিলমারি, বগুড়া, ঢাকা, ফরিদপুর, ভৈরববাজার, দেওয়ানগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, রাজশাহী, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কক্সবাজারে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে। একই সময়ে ভারতের চেরাপুঞ্জি ও শিলংয়েও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে। এই বৃষ্টিতে ৯৩টি স্টেশনের মধ্যে ৮১টি স্টেশনের পানি বেড়েছে। আর ১০টি স্টেশনের পানি কমেছে এবং একটি স্টেশনের পানি অপরিবর্তিত রয়েছে। এদিকে আবহাওয়া অধিদফতর বলেছে, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবল বর্ষণ হয়েছে। এ বৃষ্টিপাতপাত আগামী দু’দিন অব্যাহত থাকতে পারে।

বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের বরাক ও ত্রিপুরা অববাহিকায় মাঝারি থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস আছে। ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টায় কুশিয়ারা, মনু ও খোয়াই নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে।

বগুড়া ব্যুরো প্রধান মহসিন রাজু জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বগুড়া, নীলফামারী ও ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজে দফতরের সূত্রগুলো জানিয়েছে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ঘাঘট, বাঙালী ও করতোয়া নদীতে পানি বেড়েছে।

তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের রেকর্ড অনুযায়ী এই পানিবৃদ্ধি গতকাল পর্যন্ত বিপদ সীমার ২ দশমিক ৩৫ মি.মি নিচে ছিল। হঠাৎ বৃদ্ধি পাওয়া পানির এই ঢল আর ভারি বৃষ্টি না হলে ২/৪ দিনের মধ্যে নেমে যাবে। স্বাভাবিক বর্ষা মৌসুমের আগে আর বন্যা পরিস্থিতির উদ্ভব হবেনা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বগুড়া অঞ্চলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহাবুবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, আম্পানের প্রভাবে শুধু উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোই নয় বরং পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম এলাকায় ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে। মূলত আসাম অঞ্চলের পাহাড়ী ঢল ও সেই সাথে ভারি বৃষ্টিপাতের গড়ানো পানি তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ঘাঘট ও বাঙালী নদী দিয়েই বঙ্গোপসাগরের চলে যায়।

এদিকে নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যরাজের উজানে ভারতের গজলডোবা এলাকার বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, এই সময়টায় গজলডোবার ব্যারেজের সøুইসগেইট বন্ধ থাকে, যেন ভাটিতে বাংলাদেশ পানি না পায়। তবে আম্পানের প্রভাবে অতি বৃষ্টির কারণে পাশ্চিমবঙ্গ আসামকে বন্যামুক্ত রাখতে এবার বর্ষার আগেই ব্যারেজের সবকটা সøুইসগেইট খুলে রেখেছে ভারত। আর সে কারণেই বর্ষার আগেই হঠাৎ পানি বেড়েছে, নীলফামারী, গাইবান্ধা ও বগুড়া জেলা দিয়ে প্রবাহিত নদ ও নদীগুলোতে।

এদিকে হঠাৎ এই ভারি বর্ষণে পানি বৃদ্ধির কারণে ছোটবড় নদ-নদীগুলোর পাড় ঘেষা নিচু জমির বোরো ধান, কাউনসহ চরাঞ্চলের হাজার হাজার একর জমির চীনাবাদাম, মরিচসহ বিভিন্ন জাতের ফসলের ক্ষতি শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কৃষি অফিসের তথ্য মতে, চলমান বৃষ্টিপাতের ধারা অব্যাহত থাকলে জমিতে থাকা পাকা ধান পচে নষ্ট হয়ে যাবে ।

এদিকে এবার বৈশাখ মাসটা মোটামুটি শান্তভাবে পার হলেও জৈষ্ঠ্যের শুরু থেকে কাল বৈশাখী ঝড়ে বাড়িঘর ফসলের ক্ষতির পাশাপাশি নৌকাডুবি ও বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে । গত এক সপ্তাহে বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে পৃথক দুটি নৌকাডুবির ঘটনায় বগুড়া ও সিরাজগঞ্জে ১ শিশুসহ ৬ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। গত ২৭ মে বগুড়ার ধুনট উপজেলায় একটি গ্রামীণ বাজারে বজ্রপাতের ঘটনায় ফজর আলী ও হাফিজুর রহমান নামের দুজনের মৃত্যু হয়েছে।

আমাদের সিরাজগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা সৈয়দ শামীম শিরাজী জানান, সিরাজগঞ্জ জেলার নদী তীরবর্তী ৫টি উপজেলায় যমুনা নদীর ভাঙন তীব্র হচ্ছে। জেলার শাহজাদপুর ও কাজিপুর উপজেলায় নদী তীর সংরক্ষণ এলাকা ছাড়াও অন্যত্র নদী ভাঙন থামছে না। চৌহালী উপজেলায় এ যাবৎ প্রায় ১৫-২০ বার ভাঙন দেখা দিয়েছে। বেলকুচি এনায়েতপুরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হুমকির মুখে রয়েছে। এবার পুরো বর্ষা মৌসুমে তা ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

শাহজাদপুরে যমুনা নদীতে ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। এতে উপজেলার কৈজুরী, খুকনি ও জালালপুর এ তিনটি ইউনিয়নের দশটি গ্রাম ভাঙ্গনের কবলে পড়ে ক্রমশ মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। এসব গ্রামের প্রায় ১৫ হাজার মানুষ করোনাভাইরাস আতঙ্কের চেয়ে বাড়িঘর সহায়-সম্বল হারানোর আতঙ্কেই এখন দিশেহারা।

এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ভাঙ্গনে এসব গ্রামের কমপক্ষে চার শতাধিক বাড়িঘর ২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ১টি চিকিৎসাকেন্দ্র, ২টি মসজিদ, ২টি ঈদগাহ মাঠ, ৫০টি তাঁত কারখানা, ৪০০ বিঘা আবাদি জমি, ৩ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক, ১টি মাদ্রাসা, ১টি কবরস্থান, ১টি শশ্মান ঘাট, ১টি মন্দির ও কয়েক শতাধিক গাছপালা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

খুকনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুল্লুক চাঁদ মিয়া, জালালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাজী সুলতান মাহমুদ ও কৈজুরি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম জানান, যমুনা নদীতে এই অসময়ে ভাঙ্গন নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। বর্তমানে যেভাবে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে তাতে লোকজন করোনা আতঙ্কের চেয়ে বাড়িঘর হারানোর আতঙ্কে বেশি দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তাই দ্রæত ব্যবস্থা না নিলে এবারের বর্ষায় এ গ্রামগুলো মানচিত্র থেকে চিরতরে মুছে যাবে।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, এখানকার ভাঙনরোধে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের মধ্যে ব্রাহ্মণ গ্রাম থেকে পাঁচিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকার তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ, চর ড্রেজিং ও নদী শাসন রয়েছে। এ প্রস্তাবটি একনেকে খসড়া আকারে অনুমোদন হয়েছে। এখন একনেকে পাস হলেই পরবর্তী প্রক্রিয়া শেষ করে কাজ শুরু করা হবে। এছাড়া এবছর বর্ষার আগে ভাঙ্গন ঠেকাতে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে বালুর বস্তা ফেলার কাজ শুরু করা হবে।

নেত্রকোনা জেলা সংবাদদাতা এ কে এম আব্দুল্লাহ্ জানান, অবিরাম বৃষ্টি, বড় বড় ঢেউ আর প্রবল ¯্রােতের কারণে নেত্রকোনা জেলার ধনু নদীর ভাঙন তীব্র রূপ নিয়েছে। গত পাঁচ দিনে খালিয়াজুরি উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রামের ৫৭টি পরিবারের সমস্ত ভিটেমাটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয় ইউপি সদস্য জিয়াউর রহমানসহ চরপাড়া গ্রামের ক্ষতিগ্রস্থ লোকজন জানান, গাজীপুর ইউনিয়নের চরপাড়া গ্রাম ঘেঁষে বয়ে গেছে খর¯্রােতা ধনু নদী। অবিরাম বৃষ্টি আর বাড়ন্ত পানির প্রবল স্রোতে গত রোববার সকাল থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত গ্রামটির কামাল মিয়া, বকুল মিয়া, সামছু মিয়া, ফুল মিয়া, সাজু মিয়া, আলী উসমান, সুলেমান মিয়া, ফারুক মিয়া, হেলাল মিয়া, হেকিম মিয়া, মালেক মিয়া, মাসুক মিয়া, খালেক মিয়াসহ ৬৭টি পরিবারের ভিটে বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়াও বিগত কয়েক মাস আগে ধনু নদীর অব্যাহত ভাঙনে গ্রামের আরো প্রায় অর্ধ-শতাধিক ঘরবাড়ি নিচিহ্ন হয়ে যায়। গ্রামবাসীর আশংকা, ধনু নদীর অব্যাহত ভাঙন অবিলম্বে বন্ধ না করা হলে প্রায় ৬শ পরিবারের পুরো গ্রামটিই ক্রমান্বয়ে নদী গর্ভে হারিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ এইচ এম আরিফুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি নদী ভাঙনের কথা স্বীকার করে বলেন, নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ড গ্রামবাসির সঙ্গে একমত হয়ে গ্রাম থেকে দূরে পানি প্রবাহের লক্ষ্যে নদী খনন করতে ইতিমধ্যে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এ প্রস্তাবে খালিয়াজুরীর কৃতি সন্তান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সুপারিশও রয়েছে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বৃষ্টি

৫ অক্টোবর, ২০২২
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ